ঢাকা, রবিবার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১
৭৪ বছরের কলঙ্কিত ইতিহাস

মেয়াদ শেষ করতে পারেননি কোনো পাক প্রধানমন্ত্রী, ইমরানও সেই পথে?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | প্রকাশের সময় : বৃহস্পতিবার ৩১ মার্চ ২০২২ ১০:২১:০০ অপরাহ্ন | আন্তর্জাতিক

 

পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) অন্যতম প্রধান মিত্র মুত্তাহিদা কউমি মুভমেন্ট-পাকিস্তান (এমকিউএম-পি) বিরোধীদের আনা অনাস্থা প্রস্তাবকে সমর্থন করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর দেশটির বিরোধী দলগুলো প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের পদত্যাগের দাবি তুলেছে। তারা বলছে, সংসদের নিম্নকক্ষ জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানো ইমরান খানের এখনই পদত্যাগ করা উচিত।

 

সংসদে বিরোধীদের আনা অনাস্থা প্রস্তাব ঘিরে ভোটাভুটির আগে এই দাবি আরও তীব্র হয়ে উঠছে। আগামী সোমবার অনাস্থা ভোট অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।

 

বুধবার জাতির উদ্দেশে ইমরান খানের ভাষণ দেওয়ার কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে তা বাতিল করা হয়। এরপর দেশটিতে ইমরান খানের পদত্যাগের বিষয়ে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। যদিও পাক প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও তথ্যমন্ত্রী ফাওয়াদ চৌধুরী বলেছেন, ক্রিকেট তারকা থেকে প্রধানমন্ত্রী বনে যাওয়া ইমরান খান শেষ বল পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবেন।

 

পাকিস্তানের ইতিহাসে কোনো প্রধানমন্ত্রীই তাদের ক্ষমতার পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা অথবা সামরিক অভ্যুত্থানের কারণে তারা ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হন। ইমরান খান যদি পদত্যাগ করেন, তাহলে কলঙ্কিত সেই তালিকায় যুক্ত হবে তার নামও।

 

১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পর পাকিস্তানের প্রায় প্রত্যেক ক্ষমতাসীন সরকারের দায়িত্বপালন কখনই সুখকর হয়নি। দেশটির সামরিক বাহিনীর অভ্যুত্থানের কারণে তখন থেকে পাকিস্তানের অন্তত চারটি বেসামরিক সরকার ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হয়েছে। ১৯৫০ এর অস্থিতিশীল দশকে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা পাকিস্তানের সংবিধান স্থগিত করেন এবং ১৯৫৮ সালে দেশটিতে মার্শাল ল জারি করেন।

 

মার্শাল ল জারির ১৩ বছর পর জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হন। ১৯৭৩ সালে বিশেষ ব্যবস্থায় সংবিধান পাশের পর তিনি প্রেসিডেন্টের পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন।

 

১৯৭৭ সালে পাকিস্তানের নির্বাচনে জয় লাভ করে ভুট্টো। একই বছর দেশটির সেনা জেনারেল জিয়া-উল-হকের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন ভুট্টো। ১৯৮৮ সালে বিমান বিধ্বস্তে জেনারেল জিয়া-উল-হকের মৃত্যুর পর জুলফিকার আলী ভুট্টোর মেয়ে বেনজির ভুট্টো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন। কিন্তু তার শাসনকাল মাত্র তিন বছর স্থায়ী হয়েছিল। ১৯৯০ সালে প্রেসিডেন্টের সাথে মতপার্থক্য দেখা দেওয়ায় জাতীয় পরিষদ ভেঙে দেওয়া হয়। ক্ষমতা থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন বেনজির ভুট্টোও।

 

সরকারি দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান এবং পাকিস্তানের অবকাঠামো উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বেনজির ভুট্টোর স্থলাভিষিক্ত হন নওয়াজ শরিফ। সামরিক বাহিনীর চাপের মুখে ১৯৯৩ সালে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করতে হয় নওয়াজ শরিফকেও। স্বাধীনতা লাভের পর থেকে পাকিস্তানের শাসনব্যবস্থায় সেনাবাহিনীর অদৃশ্য ছায়া অব্যাহত রয়েছে।

 

১৯৯৩ সালের নির্বাচনে বেনজির ভুট্টো জয়ী হতে পারেননি। তবে তার দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ায় আবারও দেশ শাসনের সুযোগ পান বেনজির। কিন্তু তার এই মেয়াদ ব্যাপক দুর্নীতি, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা এবং সন্ত্রাসী হামলার অভিযোগে পরিপূর্ণ ছিল।

 

১৯৯৬ সালের ৫ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট ফারুক লেঘারি জাতীয় পরিষদ ভেঙে দেওয়ায় ভুট্টোকে আবারও ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হয়। পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেশটির সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে নওয়াজ শরিফের পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) জয়ী হয়। কিন্তু ১৯৯৯ সালের অক্টোবরে তৎকালীন সেনা জেনারেল পারভেজ মুশাররফ দেশটিতে জরুরি অবস্থা জারি করে নওয়াজ শরিফকে ক্ষমতাচ্যুত করেন।

 

মুশাররফের শাসনামলে পাকিস্তানে তিনজন প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব পালন করেন। তারা হলেন, মীর জাফরুল্লাহ খান জামালি, চৌধুরী সুজাত এবং শওকত আজিজ।

 

২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে এবং ইউসুফ রাজা গিলানি দেশটির প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ২০১২ সালে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টে আদালত অবমাননার একটি মামলায় গিলানি দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগে পর্যন্ত তার মেয়াদ বেশ মসৃণভাবেই চলছিল। পরে তার ক্ষমতার বাকি মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেন রাজা পারভেজ আশরাফ।

 

২০১৩ সালে আবারও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন নওয়াজ শরিফ। কিন্তু পানামা পেপারস কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার দায়ে নওয়াজের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হওয়ায় তার ক্ষমতার মেয়াদ কমিয়ে আনা হয়। ২০১৭ সালে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট নওয়াজ শরিফকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দেন। পরবর্তীতে মেয়াদের বাকি সময় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন শহীদ খোকন আব্বাসি।

 

ইমরান খান ২০১৮ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। সাবেক এই ক্রিকেট তারকার প্রধানমন্ত্রীর মসনদে বসার পেছনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্যাপক সমর্থন ছিল বলে বিশ্বাস করা হয়। তার মেয়াদও দুর্নীতির অভিযোগে পরিপূর্ণ। অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এবং ভুল পররাষ্ট্রনীতির কারণে ব্যাপক সংকটের মুখোমুখি হয়েছে পাকিস্তান। দেশটির বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ঐকবদ্ধভাবে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার লক্ষ্যে অনাস্থা ভোটের প্রস্তাব তুলেছে।

 

বুধবার পিটিআই নেতৃত্বাধীন সরকারের অন্যতম জোটসঙ্গী মুত্তাহিদা কউমি মুভমেন্ট-পাকিস্তান (এমকিউএম-পি) জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় ইমরান খানের ক্ষমতা থেকে বিদায়ের দাবি আরও জোরাল হয়েছে।