ঢাকা, শুক্রবার ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১

রাজশাহী গোদাগাড়ীর এক গ্রামে দিনে ৭ লাখ টাকার টমেটো বেচা-কেনা

মোঃ মাসুদ (রাজশাহী ব্যুরো) : | প্রকাশের সময় : মঙ্গলবার ২১ ডিসেম্বর ২০২১ ০৪:৪৪:০০ অপরাহ্ন | অর্থনীতি ও বাণিজ্য
রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার ছোট্ট একটি গ্রাম "চর আষাড়িয়াদহ"। পদ্মার বুকে এ চরের অবস্থান।  সীমান্তবর্তী এ গ্রামে রয়েছে মোট সাড়ে ৪ হাজার পরিবার। গ্রামটির উপার্জনের একমাত্র পন্থা কৃষি কাজ। এই ছোট গ্রাম থেকে রবি মৌসুমে প্রতিদিন টমেটো বিক্রি হয় প্রায় ৫ থেকে ৭ লক্ষ টাকার। তবে গড়ে প্রতিদিন ৭ লাখ টাকার টমেটো বেচা-কেনা হয় বলে জানিয়েছে গ্রামের টমেটো চাষি ও ব্যবস্থায়ীরা। 
 
পদ্মাপাড়ের এই ছোট্ট গ্রামটিতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বিস্তৃর্ণ অঞ্চলের বেশিরভাগ এলাকাতেই হয়েছে টমেটোর চাষ। পদ্মাপাড়ে দেখা গেছে সারি সারি ট্রলার। তাতে কর্মব্যস্ত শ্রমিকেরা টমেটোর বোঝাই ট্রলি থেকে মাথায় করে নামাচ্ছেন টমেটোভর্তি বস্তা। নিয়ে গিয়ে ফেলছেন নৌকায়। এদিকে ঘাটে সারি সারি নৌকায় একে একে ভর্তি হচ্ছে টমেটোর বস্তা। সকাল থেকে সন্ধা পর্যন্ত চলে এখানে‌ টমেটোর বেচাকেনা। সবজির ব্যাপারি, শ্রমিক থেকে শুরু করে ঘাটের সিরিয়াল মাস্টার , মাঝিমাল্লা কারোরই যেনো বিন্দু মাত্র সময় নেই কথা বলার। 
 
 পদ্মাপাড়ের নৌকার সিরিয়াল মাস্টার আবুল কালাম আজাদ বলেন, এই ঘাটে প্রতিদিন হাজার হাজার টমেটোর বস্তা যায় রাজশাহী শহরসহ দেশের অভ্যন্তরীণ জেলায়। নদীর ওপারেই গেলেই টমেটোর বস্তা উঠে যাবে ট্রাকে। সেগুলো চলে যাবে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে। প্রতিদিন এই ছোট্ট গ্রাম থেকেই সবজির ব্যাপারিরা ৬ থেকে ৭ লাখ টাকার টমেটোই বিক্রি করেন। টমেটোর সাথে যায় অন্যান্য ফসলও।
 
পদ্মার চরাঞ্চল থেকে টমেটোর সংগ্রহ করছিলেন ব্যাপারি সোহরাব আলী। রাজশাহী থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শাক-সবজি কিনে সরবরাহ করেন তিনি। প্রায় ২০ বছর যাবত করছেন এই ব্যবসা। 
 
 তিনি বলেন, চরাঞ্চলের বিভিন্ন গ্রামের ক্ষেত থেকে টমেটো সংগ্রহ করে তা ট্রলিতে নেওয়া হয়। বস্তা প্রতি ২০ টাকা করে সেগুলো আনা হয় পদ্মাপাড়ে। এরপর নৌকা তোলা হয়। আবার বস্তা প্রতি নৌকার ভাড়া গুনতে হয় ১৫ টাকা করে। প্রতি বস্তায় প্রায় ২ মণ করে টমেটো ধরে। আজও হাজার বস্তা টামেটোসহ বিভিন্ন নিয়ে সবজি নিয়ে যাচ্ছি।
 
আষাঢ় মাস শেষে পদ্মার বুকে জেগে উঠে বিস্তৃর্ণ চরাঞ্চল। এসময় এই এলাকার মানুষ পার করেন ব্যস্ত সময়। সূর্য উঠার সাথে সাথে বেরিয়ে পড়েন মাঠে। লাঙ্গল আর কোদালের আঘাতে মৃত্তিকার বুক চিরে পত্তন করেন বীজ। এরপর পালা পরিচর্যার। দিনের পর দিন কৃষকের সযত্নে লালন-পালনে উর্বর মৃত্তিকা হয়ে উঠে সবুজের সমারোহ। মাঠে মাঠে ফলে বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজি। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে টমেটো। 
 
চর আষাড়িয়াদহ গ্রামের বাসিন্দা নাসির উদ্দিন। এবার ৩ বিঘা জমিতে চাষ করেছেন টমেটোর। টমেটোর চাষ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ৩ বিঘা জমিতে গাছের চারা, সার, কীটনাশক বাবদ খরচ হয়েছে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা। ৩ বিঘায় ফসল হবে প্রায় ১০ থেকে ১৫ মেট্রিক টন। এতে খরচ বাবদ লাভের আশা করছেন প্রায় লাখ খানেক। 
 
একই গ্রামের বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমার আড়াই বিঘা জমিতে টমেটোর চাষ করেছি। এবার অন্যান্য মৌসুমের চাইতে ফলনও বেশ ভালো। তবে উচু অঞ্চলের চাইতে আমাদের পদ্মা পাড়ের টমেটোর দাম কম। কারণ হিসেবে তিনি জানান, পরিবহন খরচের কারণে ব্যাপারিরা দাম কম দেন। 
 
এদিকে গোদাগাড়ী উপজেলার চর আষাড়িয়াদহ ইউনিয়নের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আবুল হোসেন বলেন, গোদাগাড়ী উপজেলার চর আষাড়িয়াদহ, চর নওশেরা ও দিয়ারমানিক চর এই তিনটি ব্লক রয়েছে। এর মধ্যে চর আষাড়িয়াদহ ব্লকে সবচেয়ে বেশি টমেটোর আবাদ হয়। এই ব্লকে ৬০০ হেক্টর আবাদযোগ্য জমি রয়েছে। হেক্টর প্রতি আবাদ হয় প্রায় ২৫ মেট্রিক টন। সেক্ষেত্রে প্রায় ১৫ হাজার মেট্রিক টন টমেটোর লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। কিন্তু এর বাইরেও কিছু চরাঞ্চল এলাকায় আবাদ হওয়ায় ও ফলন গত বছরের চাইতে বেশি হওয়ায় নির্ধারিত লক্ষমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন এই কৃষি কর্মকর্তা। 
 
তিনি আরো বলেন, মৌসুমের শুরুতে আগাম টমেটো ১০০০ থেকে ১২০০ টাকা মণ দরে বিক্রি হয়েছে। মাঝে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। বর্তমানে মণ প্রতি ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। কিছুদিন পর চারিদিকে টমেটো উঠে গেলে দাম কমে ৫০ থেকে ১৫০ টাকা দরেও মিলবে টমেটো ।
 
ছোট্ট গ্রামটিতে টমেটোর বাম্পার ফলনের বিষয়ে রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক মো. তৌফিকুর রহমান বলেন, রাজশাহী জেলার ৯টি উপজেলার মধ্যে গোদাগাড়ী উপজেলায় টমেটোর আবাদ ও ফলন সবচেয়ে বেশি। এরমধ্যে চর আষাড়িয়াদহ ব্লকে টমেটোর চাষ হয় সবচেয়ে বেশি। কারণ, বন্যা পরবর্তী সময়ে এ অঞ্চলের জমিতে পলি পড়ে। পলি পড়ার কারণে মাটি উর্বর হয়। এছাড়া পানির সহজ লভ্যতাও রয়েছে। একারণে উচু জমির চাইতে তুলনামূলক সার কম লাগে। তাই খরচও কম। 
 
তিনি বলেন, মূলত বিস্তৃর্ণ চরাঞ্চল, মাটির উর্বরতা, পানির পর্যপ্ততা ও স্বল্প খরচ হওয়ায় চাষীরা আবাদে বেশ লাভবান হয়। একারণে টমেটোর আবাদও এই অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি। তাছাড়া রবি মৌসুমে টমেটো ছাড়াও আলু, বেগুন, ফুলকপি, বাধাকপি, পটল, সিম, করলা ও মটরশুটির চাষ খুব ভালো হয়। তবে লাভ বেশি হওয়ায় টমেটোর চাষে বেশি আগ্রহী এ অঞ্চলের কৃষকেরা।