শমসেরনগরে হায়েনাদের ঘাঁটিতে হামলার বিষয়ে রিপোর্ট পেশ করে কমলপুর ক্যাম্পে অবস্থান করছিলেন সরদার আজিজ। তখন অক্টোবর মাসের মাঝমাঝি সময়। নতুন কোনো অপারেশনের ডাক পড়ছে না। ক্যাম্পের ভেতরেই সময় কাটছে। ক্যাম্প থেকে বাইরে যাওয়া নিষেধ ছিল। সাধারণ মানুষের সাথে কোনো ধরণের কথাবার্তাও শেয়ার করা নিষেধ ছিল। এই অবস্থায় বাইরের অবস্থা জানার জন্যে মন ব্যাকুল হয়ে উঠে। দেশের অবস্থা জানতে অস্থিও হয়ে উঠেন সবাই।
অক্টোবর মাসের শেষ সময় পর্যন্ত ক্যাম্পে অবস্থানের সময় অস্থিরতার চিত্র ওইভাবে দৈনিক বায়ান্নের কাছে তুলে ধরেন বীর মুক্তিযোদ্ধা সরদার আজিজুর রহমান।
তিনি বলেন, ক্যাম্পের কাছে একটি বাড়ি ছিল। ওই বাড়িতে ছিল রেডিও। বাড়িটির সদস্যরা নিয়মিত খবর শুনতেন রেডিওতে। বিশেষ করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের খবর শুনতেন নিয়মিত। ওই খবরের শব্দ ক্যাম্পে শোনা যেতো। ক্যাম্পে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারা ওই খবর শোনার জন্যে নিয়মিত কান পাততেন। যেখানে কান পাততেন সেখানে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা জড়ো হয়ে শুনতেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের খবর। ওই খবর থেকে দেশ সম্পর্কে কিছুটা আঁচ করতে পারতেন। খবওে জানতে পারেন বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সামরিক চুক্তি হবে। ওই চুক্তির পর যৌথভাবে আক্রমণ শুরু হবে পাকিস্তানি হায়েনাদের বাড়িতে।
অক্টোবর মাসের শেষ দিকে ক্যাপ্টেন সাজ্জাদের তাবুতে ডাক পড়ে সরদার আজিজের। ক্যাপ্টেন আজিজ জানালেন শমসেরনগর এলাকা অবস্থা ভালো নয়। প্রতিদিনই পাকিস্তানি হায়েনাদের ৫০-৬০ জনের দল লোকালয়ে হামলা চালায়। ঘরবাড়ি জ¦ালিয়ে দেয়। ব্যাপক লুটপাট চালায়। নিরীহ লোকজনের উপর অত্যাচার করে। রাজাকারদের সহযোগিতায় হায়েনাদের তান্ডবে নিরীহ লোকজন দিশেহারা পড়েছেন। হায়েনাদের গাড়ি বহল শক্তিশালী নিরাপত্তায় শমসেরনগর ঘাঁটিতে প্রবেশ করে। এসব গাড়িতে থাকে অস্ত্রসহ রসদ। ওই অবস্থার প্রতিরোধ করার জন্যে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে বলেন সরদার আজিজকে। নির্দেশনা পেয়ে সরদার আরো চারজন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে পরামর্শ সভায় বসলেন। পরামর্শ সভায় সিদ্ধান্ত হয়-গাড়ি বহরে গ্রেনেড হামলা করবেন। পরিকল্পনা নেয়া হয় শমসেরনগর এলাকায় গিয়ে প্রথমে রেকি করতে হবে। রেকি করে স্থান নির্ধারণ করতে হবে। যে স্থান থেকে গ্রেনেড হামলা করা হবে। সিদ্ধান্ত অনুয়ায়ী ৫ জনের একটি দল শমসেরনগরে যাওয়ার পরিকল্পনা নেয়। সবাই পাঁচটি গ্রেনেড-৩৬ নেন। আত্মরক্ষার জন্যে নেন একটি করে এসএমজি। একজন চা শ্রমিক গাইড ডেকে আনা হয়। রাত আটটার দিকে একজন গাইডসহ মুক্তিযোদ্ধার দল রওয়ানা হন শমসেরনগরের উদ্দেশ্যে। সরদার আজিজের কাছে ছিল একটি রিভবলবার। এই রিভলবার সরদার আজিজের নামে বরাদ্দ ছিল।
শমসেরনগরে গিয়ে উঠলেন ক্যাপ্টেন সাজ্জাদের বাড়িতে। সংকেত পাওয়ার পর বাড়ির দরজা খুলে যায়। বাড়িতে কোনো মহিলা নেই। তবে ওইদিন ২-৩ জন মহিলা আসেন। রান্না-বান্না শেষে তারা আবার চলে যান। রান্না করা ভাত তরকারি বুঝয়ে দিয়ে যান। ওই ভাত তরকারি রাতে ও ভোর রাতে খেয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। সূর্য উঠার আগেই ৫ মুক্তিযোদ্ধা টুপি পাঞ্জাবি পড়ে প্রস্ত হন। হয়ে যান মৌলভীর দল। কোমড়ে বেঁধে নেন গ্রেনেড ও স্টেনগান। রওয়ানা হলেন মৌলভীবাজার-শমসেরনগর রাস্তার দিকে। রেকি করতে করতে উপযুক্ত স্থানও পেয়ে গেলেন। ওই স্থানটি শমসেরনগর ঘাঁটি থেকে এক মাইল দূরে। পাহাড়েরর উপরে জঙ্গলের ভেতরে নির্ধারিত দূরত্ব সৃষ্টি করে অবস্থান নিলেন পাঁচ মুক্তিযোদ্ধা।
সরদার আজিজ জানিয়ে দিলেন গাড়ির বহর এলে প্রথমজন গ্রেনেডটি নিক্ষেপ করার পরপরই দ্বিতীয়জন গ্রেনেড নিক্ষেপ করবেন। এভাবে ধারাবাহিকভাবে গ্রেনেড নিক্ষেপ করবে সবাই। প্রত্যেকে দুইটি করে গ্রেনেড নিক্ষেপ করবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী সবাই পজিশন নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। বেলা গড়িয়ে দুপুর হওয়ার আগেই দেখতে পেলেন শমসেরনগর অভিমুখি গাড়ির বহর এগিয়ে আসছে। পুরোপুরি প্রস্তুতি নিলেন মক্তিযোদ্ধারা। আয়ত্তে¡র মধ্যে গাড়ির বহর আসা মাত্র শুরু হয় গ্রেনেড হামলা। সরদার আজিজ জানান, ১৫ সেকেন্ডের মধ্যে গ্রেনেড যাতে লক্ষবস্তুতে পড়ে, সেই ধরণের প্রস্তুতি আগে থেকেই ছিল। টার্গেটের মধ্যে আসার পর প্রথমজন গ্রেনেড হামলা করে। এর দ্বিতীয়জন, তৃতীয়জন চতুর্থজন, পঞ্চমজন গ্রেনেড হামলা করে। পাঁচ মুক্তিযোদ্ধা এক মিনিটের মধ্যে পাঁচটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করেন।
গ্রেনেড হামলার তান্ডবে তিনটি গাড়িতে আগুন ধরে যায়। ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে গাড়ির বহর। হায়েনারা দল নিজেদের রক্ষা করতে, ও আক্রান্ত হওয়া হায়েনাদের উদ্ধারে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধার দল রশির সাহায্যে দ্রæত পাহাড় থেকে নেমে স্থান ত্যাগ করেন। গাইডের সাহায্যে দুই ঘন্টা হেঁটে গভীর জঙ্গলে চলেন মুক্তিযোদ্ধারা। ওই স্থানে বসে মুক্তিযোদ্ধারা শুনতে পাচ্ছিলেন হায়েনাদের ঝাকে ঝাকে গুলির শব্দ। দিন গিয়ে রাত নেমে আসে। একটু রাত হতেই গাইডের সাহায্যে শমসেরনগরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন তাঁরা। ক্যাপ্টেন সাজ্জাদের আত্মীয়র বাড়িতে উঠেন। রাতের খাবার খেয়ে তড়িঘরি করে ওই বাড়ি থেকে রওয়ানা হন কমলপুর ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে।
ওই বাড়িতে থাকা আর নিরাপদ নয়-এমনটি ভেবে স্থান ত্যাগ করেন। একদিনেই সফল অপারেশন শেষ করেন তাঁরা। ভোররাতে কমলপুর ক্যাম্পে পৌঁছেন মুক্তিযোদ্ধা দল। রিপোর্ট পেশ করেন ক্যাপ্টেন সাজ্জাদের কাছে।