বৈশাখ মানেই ভিন্ন সাজে বাংলার প্রকৃতি। আকাশে গনগনে সূর্য। কাঠফাটা রোদ্দুরে তপ্ত বাতাস। গ্রীষ্মের এই নিস্তেজ প্রাণ রুক্ষতা ছাপিয়ে প্রকৃতিতে কৃষ্ণচূড়া নিজেকে মেলে ধরে আপন মহিমায়। রুদ্র গ্রীষ্ম কেবল আগুনই ঝরায় না, লাল রঙে কৃষ্ণচূড়ার পসরা সাজিয়ে মনও কাড়ে। এ যেন প্রকৃতিজুড়ে কৃষ্ণচূড়া ফুল গাছে।
রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার দীর্ঘতম সেতু" চুনিলাল সেতু" তার পাশেই কৃষ্ণচূড়ার কয়েকটি গাছ।লাল হয়েছে ফুলে ফুলে, দূর থেকে মনে হবে কৃষ্ণচূড়া ডালে ডালে আগুন লেগেছে। শাব্দিক অর্থে কৃষ্ণ যতই কালো হোক। চূড়ায় কেন রক্তিম আভায় লালে লাল ফুলের বাহার। প্রকৃতির এমন আচরণ কেন মানুষের মন ও নয়নযুগলকে রাঙিয়ে দেবে? প্রশ্ন হাজারো। বছর শেষে এই বৈশাখে কৃষ্ণ লাল রঙে রাঙাবেই। এটিই যেন তার ধর্ম।
কৃষ্ণচূড়া যে মানুষের মনে নতুনের দোলা দেয়, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ‘কৃষ্ণচূড়ার রাঙা মঞ্জুরি কর্ণে আমি ভুবন ভুলাতে আসি গন্ধে ও বর্ণে’ কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই মনোমুগ্ধকর গান আমাদের স্মরণ করে দেয় কৃষ্ণচূড়ার তাৎপর্য।
এই সময়টায় সারা দেশের মতোই রাঙ্গামাটি নানিয়ারচরের "চুনিলাল সেতু"র পাশেই কয়েকটি গাছে চোখ ধাঁধানো টুকটুকে লাল কৃষ্ণচূড়া ফুলে সেজেছে গ্রীষ্মের প্রকৃতি। দূর থেকে দেখলে মনে হয়, বৈশাখের রোদ্দুরের সবটুকু উত্তাপ গায়ে মেখে নিয়েছে রক্তিম পুষ্পরাজি; সবুজ চিরল পাতার মাঝে যেন আগুন জ্বলছে। গ্রীষ্মের ঘামঝরা দুপুরে কৃষ্ণচূড়ার ছায়া যেন প্রশান্তি এনে দেয় অবসন্ন পথিকের মনে। তাপদাহে ওষ্ঠাগত পথচারীরা পুলকিত নয়নে, অবাক বিস্ময়ে উপভোগ করেন এই সৌন্দর্য।
কৃষ্ণচূড়া গাছের আরেক নাম যে "গুলমোহর" তবে তা কম লোকই জানেন নামটি, কিন্তু কৃষ্ণচূড়াকে চেনেন না এমন লোক খুজে পাওয়া যাবে না। এখন কৃষ্ণচূড়ার সময়, গাছে গাছে লালে লাল হয়ে ফুটে থাকবে। এই লালের সমারোহ কৃষ্ণচূড়ারই মহিমা। কৃষ্ণচূড়াকে সাধারণত আমরা লাল রঙেই দেখতেই অভ্যস্ত।
তবে কৃষ্ণচূড়া তিনটি রঙের হয়ে থাকে লাল, হলুদ ও সাদা। কম হলেও চোখে পড়ে হলদে রঙের কৃষ্ণচূড়া আর সাদা রঙের কৃষ্ণচূড়ার দেখা মেলে কালেভদ্রে।
কৃষ্ণচূড়ার গাছ অনেকটা উঁচু, জায়গাজুড়ে শাখা-প্রশাখার বিস্তার ঘটায়। তিন রঙেরই ফুল ফোটে প্রায় একই সময়ে।
এর বড় খ্যাতি হলো গ্রীষ্মের প্রচণ্ড তাপদাহে যখন এই ফুল ফুটে তখন এর রূপে মুগ্ধ হয়ে পথচারীরাও থমকে তাকাতে বাধ্য হন।
এই বৃক্ষ শুষ্ক ও লবণাক্ত অবস্থা সহ্য করতে পারে। ক্যারাবিয়ান অঞ্চল, আফ্রিকা, হংকং, তাইওয়ান, দক্ষিণ চীন, বাংলাদেশ, ভারতসহ বিশ্বের অনেক দেশে এটি জন্মে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণচূড়া শুধু দক্ষিণ ফ্লোরিডা, দক্ষিণ পশ্চিম ফ্লোরিডা, টেক্সাসের রিও গ্র্যান্ড উপত্যকায় পাওয়া যায়।
কৃষ্ণচূড়া সৌন্দর্যবর্ধক গুণ ছাড়াও, এই গাছ উষ্ণ আবহাওয়ায় ছায়া দিতে বিশেষভাবে উপযুক্ত। কৃষ্ণচূড়া উদ্ভিদ উচ্চতায় সাধারণত ১২ থেকে ১৫ মিটার হলেও শাখা-পল্লবে এটির ব্যাপ্তি বেশ প্রশস্ত। ফুলগুলো বড় চারটি পাপড়িযুক্ত। মুকুল ধরার কিছু দিনের মধ্যে পুরো গাছ ফুলে ফুলে ভরে যায়।
কৃষ্ণচূড়ার ফুলগুলো বড় ৭-৮টি পাপড়িযুক্ত গাঢ় লাল। ফুলের ভেতরের অংশ হালকা হলুদ ও রক্তিম হয়ে থাকে। পাপড়িগুলো প্রায় ৮ সেন্টিমিটারের মতো লম্বা হতে পারে। কৃষ্ণচূড়া জটিল পত্রবিশিষ্ট এবং উজ্জ্বল সবুজ। প্রতিটি পাতা ৩০-৫০ সেন্টিমিটার লম্বা এবং ২০-৪০টি উপপত্র বিশিষ্ট। শুষ্ক অঞ্চলে গ্রীষ্মকালে কৃষ্ণচূড়ার পাতা ঝরে গেলেও নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে এটি চিরসবুজ।
বাংলাদেশে কৃষ্ণচূড়া ফুল ফোটে এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত। তবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কৃষ্ণচূড়ার ফুল ফোটার সময় ভিন্ন ভিন্ন। যেমন, দক্ষিণ ফ্লোরিডায় জুনে, আরব আমিরাতে সেপ্টেম্বরে, ক্যারাবিয়ানে মে থেকে সেপ্টেম্বর, ভারতে- এপ্রিল থেকে জুন, অস্ট্রেলিয়ায়-ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি।
শোভাবর্ধনকারী এই বৃক্ষটি শুধু পাহাড় নয় গ্রামীণ জনপদের পাশাপাশি শহরের মানুষের কাছেও সমান গুরুত্ব বহন করে। শখের বশে এ গাছের কদর থাকলেও এর কাঠ তুলনামূলক দামি না হওয়ায় ভালো কোনো ব্যবহারে না আসায় বাণিজ্যিকভাবে এ গাছ বপনে আগ্রহ অনেক কম।
এ গাছটি আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি মানুষ ও প্রকৃতির স্বার্থেই বেশি করে কৃষ্ণচূড়া গাছ লাগান উচিত।