১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ। পাকিস্তানিহায়েনারা নিরস্ত্র বাঙালির উপর হত্যাযজ্ঞ চালায়। এই খবর বিভিন্ন মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এডভোকেট মোস্তাক আহমদশিশু বয়সে মায়ের আচল ধরা অবস্থায় জানতে পেরেছিলেন ওই খবর। ২৬ মার্চ এডভোকেট মোস্তাকআহমদের জকিগঞ্জের লোহারমহল গ্রামের মানুষজনের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে পাকিস্তানিহানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের কথা। চারদিকে হৈ চৈ পড়ে যায়। আতঙ্ক আর অস্থিরতা নেমে আসে। ২-৩ জন লোক এসে এডভোকেট মোস্তাক আহমদের বাড়িতে জানিয়ে দেন পাকিস্তানি হায়েনাদের কথা। এই খবরে বাড়ির সিনিয়র নাগরিকরা ওই বাড়ির সকলকে ৩০ মিনিটের মধ্যে প্রস্তত হতে বলেন। ওই সময় এডভোকেট মোস্তাক তাঁর মায়ের আচল ধরে দুষ্টমি করছিলেন। নির্দেশনা পেয়ে এডভোকেট মোস্তাকের ৩-৪ বছর বয়সের ছোট ভাইকে খোঁজাখুঁজি শুরু হয়। বিশাল বড়বাড়ির অন্যপাশে গিয়ে ছোট ভাই কবিরকে খুঁজে পান। মোস্তাক ও কবিরকে দুই কাকে নিয়ে মা ছুটে চললেন বাড়ির পাশের কুশিয়ারা নদীর তীরে। নৌকায় চড়ে নদী পাড়ি দিয়ে তারা চলে যান ভারতে।
দৈনিক বায়ান্নের কাছে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি চারণ করতে গিয়ে কেন্দ্রীয় আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের সদস্য এডভোকেট মোস্তাকআহমদ ওই কথ বলেন। ১৯৭১ সালে তিনি স্থানীয় ঘাগলাজুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণিরে ছাত্র ছিলেন।
এডভোকেট মোস্তাক জানান, ১৯৭১সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁর দাদা মৃত্যুবরণ করেন। পাবিারিকভাবে সিদ্ধান্ত হয় শিরনি করার। ওয়াজ মাহফিল করারও সিদ্ধান্ত হয়। শিরনি এবং ওয়াজ মাহফিল আয়োজনের প্রস্তুতি নেয়ারআগেই পাক হানাদার বাহিনী এদেশের নিরস্ত্র মানুষের উপর হামলা চালায়।
এডভোকেট মোস্তাক জানান, ২৬ মার্চতাঁর পুরো পরিবার নৌকায় কুশিয়ারা নদী পারি দিয়ে ভারত সীমান্তে প্রবেশ করেন। নৌকায় পাড়ি দেয়ার সময় তিনি দেখলেন প্রায় ২০০ নৌকা মানুষজনকে ভারত সীমান্তে পাড় করছেন। এসময় তাঁদের বাড়িরসহ গ্রামের কুকুরগুলো সাঁতরে নদী পাড় হচ্ছিল। নদীর ওই পাড়ে ছিল ভারতের করিমগঞ্জ। করিমগঞ্জে ছিল এডভোকেট মোস্তাকের পিতা আলহাজ আবদুল খালেকের নানার বাড়ি।এডভোকেট মোস্তাকের পুরো পরিবারের সদস্যরা ওই বাড়িতে গিয়ে উঠেন। সাথে ছিলেনএডভোকেট মোস্তাকের চাচা আবদুল লতিফ। আবদুল লতিফ ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্তজগিঞ্জ আসনের এমপি ছিলেন। ওই বাড়িতে উঠার পর একপাশে এডভোকেট মোস্তাকের পুরো পরিবারকে বসবাসের জায়গা করে দেয়া হয়। অন্য যারা নদী পাড়ি দিয়ে ভারতে গিয়েছিল তাদেরকে নিরাপদ স্থানে জায়গা করে দেন ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী।
এডভোকেট মোস্তাক জানান, পরদিন ২৭মার্চ তাঁরা জানতে পারেন রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাঁদের বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে। নদীর পাড়ে এসে দেখেন তাদের পুরো বাড়িতে দাউ দাউ করে আগু নজ্বলছে। হাসঁ, মুরগী, গরু, ছাগল, গোলাভরা ধান পুড়িয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়। পুরো বাড়িটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। পরে জানতে পেরেছিলেন সিলেট শহরের বাসাবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও লুটপাট চালানো হয়েছে।
এডভোকেট মোস্তাক জানাচ্ছিলেন,ভারতে অবস্থান নেয়ার পর মুক্তিযুদ্ধের করিমগঞ্জ অঞ্চলের প্রধান করা হয় তাঁর চাচা এমপি আবদুল লতিফকে। বাবা আবদুল খালেক মুক্তিযুদ্ধের সংগঠ্ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে থাকেন।এর মধ্যে তাঁর চাচা আবদুল জলিল ও চাচাতো ভাই আবুল কাশেম কাউকে না জানিয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন। অংশগ্রহণ করেন মুক্তিযুদ্ধে। সেখানে কয়েকটি বাংকার তৈরি করা হয়। কারণ পাকিস্তানি জান্তারা প্রায় সময় মর্টারসেল নিক্ষেপ করতো করিমগঞ্জে। ওই সময় তারা বাংকারে লুকিয়ে পড়তেন।
এডভোকেট মোস্তাক জানান, দেশস্বাধীন হওয়ার একদিন পর বাবার হাত ধরে তিনি নদী পাড়ি দিয়ে বাড়িতে এসে দেখেছেন ধ্বংসের লীলাখেলা। বাড়িতে টিনশেডর ঘরবাড়ি তৈরি শুরু হয়। অস্থায়ীভাবে টিনশেডের ঘর বাড়িতৈরি হওয়ার ২১ দিন পর পুরো পরিবার ফিরে আসেন।
সে সময়ের শিশু হৃদয়ের কথা বলতে গিয়ে এডভোকেট মোস্তাক বলেন, সত্যিকার অর্থে পাকিস্তানি গোষ্ঠী ছিল হায়েনার জাত। তাদেরকে তীলে তীলে চিনতে পেরেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাদের জুলুম থেকে এদেশের মানুষকে মুক্ত করতে দীর্ঘদিন লড়াই করেছেন। লড়াইয়ে সফলতা আনতে ও এদেশের মানুষকে স্বাধীন রাষ্ট্র উপহার দিতে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সারা দিয়ে এদেশের মানুষ জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে এদেশকে স্বাধীন করেছেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আমরা স্বাধীনদেশ পেয়েছি। স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারছি। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এখন এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ।