১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহ। ভারতের ইন্দ্রনগরে প্রায় দেড় হাজার যুবক অবস্থান করছিলেন। এঁরা সবাই বাংলাদেশি। বিশেষ করে সিলেট অঞ্চলের। অধিকাংশ যুবক ছিলেন বিয়ানীবাজার ও বড়লেখার। ট্রেনিং সেন্টার তৈরির জন্যে জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করেন ওইসব যুবক।
রণাঙ্গণের বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসকু-এ-এলাহী খাঁন মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ধাপের প্রশিক্ষণের চিত্র তুলে ধরেন দৈনিক বায়ান্নের কাছে।
তিনি বলেন, ইন্দ্রনগরের যে জায়গায় ট্রেনিং সেন্টার তৈরির জন্যে ঝোপ জঙ্গল পরিষ্কার করা হচ্ছিল-তা নিয়েও রয়েছে ইতিহাস। বৃটিশরা ওই স্থানে তাদের প্রয়োজনে একটি বিমান বন্দর তৈরি শুরু করেছিল। কিন্তু বিমানবন্দরটি তৈরি শেষ হয়নি। পরিত্যক্ত হয়ে যায়। সেখানেই ঝোপ জঙ্গল পরিষ্কার করে তৈরি করা হয় ট্রেনিং গ্রাউন্ড। তিনদিনের মাথায় ওই ট্রেনিং সেন্টারে প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন বাংলাদেশের দামাল ছেলেরা।
মাসুক এলাহী বলেন, প্রথমেই শুরু হয় ড্রিল প্যারেডের প্রশিক্ষণ। ড্রিল হচ্ছে সুসংগতি এবং সমষ্টিবাদের অনুভূতি অর্জন করে এবং পরিচ্ছন্নতা, শৃঙ্খলা এবং স্মার্টনেস নিয়ে আসে। ক্রলিং প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু হয়। এই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে হামাগুড়িতে সক্ষম করে তোলা হয়। একই সঙ্গে পজিশনিং প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু হয়। পজিশনিং আবার কয়েক ধরণের। এর মধ্যে রয়েছে স্ট্যান্ডিং, লেয়িং ও হাটুগেড়ে বসা। এন্টি এম্বুশ ড্রিলের প্রশিক্ষণের পাশপাশি ফাইটিং পজিশন শেখানো শুরু হয়। ক্যামো ফ্লাইজিং প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এই প্রশিক্ষণটি হচ্ছে ট্রেনিংপ্রাপ্ত ব্যক্তি দাঁড়িয়ে থাকবে। পাশ দিয়ে কেউ হেঁটে গেলে তাঁকে দেখবে না। এর পর শুরু হয় অস্ত্রের প্রশিক্ষণ।
মাসুক এলাহী বলেন, এক্সপ্লোসিভ, ডেটনেটর, করডেক্স, ফিউজওয়ার সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এক্সপ্লোসিভ প্রশিক্ষণে ধারণা দেয়া হয় কিভাবে বিভিন্ন স্থাপনা উড়িয়ে দেয়া যায়। এর উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, প্রথমে একটি ব্রিজ বা অন্য স্থাপনা নির্ধারণ করতে হবে। যা এক্সপ্লোসিভ দিয়ে উড়িয়ে দেয়া হবে। ওই স্থাপনার আকৃতি অনুযায়ী তার গায়ে স্থাপন করতে হবে পরিমাণমত এক্সপ্লোসিভ। পরে ডেটনেটরের মাধ্যমে ফিউজওয়ার লাগিয়ে নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে হবে। নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে ফিউজওয়ারের মাথায় আগুন লাগিয়ে দিলে কয়েক মিনিটের মাথায় উড়ে যাবে স্থাপনা।
তিনি বলেন, প্রথমে মার্ক-৩ ও মার্ক-৪ অস্ত্রের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। শেখানো হয় এসএমজি, এলএমজি ও এসএলআর চালানোর পদ্ধতি। মটার ও গ্রেনেড এর উপর প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এন্টি ট্যাংক, এন্টি পারসনাল মাইন ও ববিট্যাপ মাইন সম্পর্কে দেয়া হয় প্রশিক্ষণ। রকেট লাঞ্চার সম্পর্কে ট্রেনিং দেয়া হয়। এর পরপরই ম্যাপ সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। কাউন্টার এটাক করার জন্যে দেয়া হয় প্রশিক্ষণ। ২৮ দিনের সর্ট কোর্স সম্পন্ন হয় ওইসব ট্রেনিং নিয়ে।
তিনি বলেন, প্রতিদিন সকালে ট্রেনিং শুরু হওয়ার আগে রুটি আর চা দেয়া হতো। দুপুরে ভাত সবজিসহ অন্যান্য তরকারি। আর রাতে দেয়া হতো ভাত ও সবজি।
মাসুক এলাহী বলেন, ২৮ দিনের প্রশিক্ষণ দেয়ার সময় মনস্ত¡াতিক বিষয়ের উপর ব্যাপক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এই প্রশিক্ষণ প্রতিদিনই দেয়া হতো। এই প্রশিক্ষণের মাধ্যমের প্রশিক্ষানার্থীদের অন্তরকে শক্তিশালী করে তোলা হয়। ফলে ২৮ দিনের প্রশিক্ষণেই প্রায় দেড় হাজার যুবকের আন্তরে আগুন জ¦লে উঠে। বাংলাদেশকে শত্রæমুক্ত করতে এসব যুবক জীবন দিতে প্রস্তুতি নেন। প্রতিদিন সকালে প্রশিক্ষণ শুরু হতো। শেষ হতো সন্ধ্যায়। প্রশিক্ষণ দিতেন বাংলাদেশ ও ভারতের সামরিক অফিসাররা যৌথভাবে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুক এলাহী জানান, ইন্দ্রনগর ট্রেনিং ক্যাম্পের বেজ কমান্ডার ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সুহাত্তা গ্রামের এডভোকেট লুৎফুল্লাহ হাই সাচ্চু মিয়া ও প্রশিক্ষক ছিলেন কুমিল্লার আবদুস সহিদ। প্রশিক্ষক আবদুস সহিদ আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে মাতিয়ে রাখতেন মুক্তিযোদ্ধাদের।
তিনি বলেন, প্রশিক্ষণ গ্রহণের সময় বড়লেখা ও বিয়ানীবাজারের বেশ কয়েকজনের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠে। এদের মধ্যে অন্যতম হলেন কসবার জালাল, নাজিম ও মান্নান ভাই, মাটি কাটা গ্রামের আবদুল কাদির, আবদুল জব্বার চেয়ারম্যান, লাউতার চেয়ারম্যান আবদুল জলিল, আতিক মেম্বার প্রমুখ।