ঢাকা, শুক্রবার ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১

একজন বিচারপতি দিয়ে চলছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল

Author Dainik Bayanno | প্রকাশের সময় : বৃহস্পতিবার ২০ জানুয়ারী ২০২২ ১০:২৪:০০ পূর্বাহ্ন | আইন-আদালত

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম চলছে ২০১০ সালের ২৫ মার্চ থেকে। মামলায় রায় ঘোষণা, সাক্ষ্যগ্রহণ, যুক্তি-তর্ক উপস্থাপনসহ (আর্গুমেন্ট) বর্তমানে ট্রাইব্যুনালে ৩৭টি মামলার বিভিন্ন পর্যায়ে বিচার কার্যক্রম চলমান।

 

ট্রাইব্যুনালের দুজন বিচারপতি অসুস্থ থাকায় বাকি একজন বিচারপতিকে দিয়েই আসামিদের সাক্ষ্যগ্রহণ ও বিভিন্ন মামলার দিন-তারিখ ধার্যের কাজ চলছে। এছাড়া, ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রারের পদটি শূন্য গত তিন মাস ধরে।

 

স্বাধীনতার ৩৯ বছর পর ২০১০ সালের মার্চ মাসে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। এরপর আসামির সংখ্যা ও মামলার চাপ বেড়ে যাওয়ায় আরও একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ২০১২ সালের ২২ মার্চ ট্রাইব্যুনাল-১ ও ট্রাইব্যুনাল-২ নামে দুটি ট্রাইব্যুনালে বিচার কার্যক্রম চলে। এরপর ২০১৫ সালে ট্রাইব্যুনাল-২ নিষ্ক্রিয় করে ট্রাইব্যুনাল-১ বিচারকাজ চালিয়ে যায়। একই বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর দুটি ট্রাইব্যুনালকে একীভূত করা হয়।

 

এর মধ্যে প্রসিকিউশন টিম থেকে চাকরি ছেড়ে অনেকেই চলে গেছেন, কেউ গেছেন বিদেশে, করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারাও গেছেন একজন প্রসিকিউটর। এছাড়া একজন বিচারপতি মারা যাওয়ার পরে নতুন করে বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। গত ১৭ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারপতি হিসেবে প্রথম কর্মদিবস অফিস করেন বিচারপতি কে এম হাফিজুল আলম। তিনিসহ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এখন মোট বিচারপতি তিনজন। তবে এর মধ্যে দু’জনের অনুপস্থিতিতে একাই বিচার কাজ চালাচ্ছেন তিনি।

 

লধমড়হবংি২৪

 

ট্রাইব্যুনাল সূত্রে জানা যায়, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন হওয়ার পর থেকে গত ১১ বছরে মোট ৪৩টি মামলায় রায় ঘোষণা করা হয়েছে। যেখানে দণ্ডিত আসামির সংখ্যা শতাধিক। এর মধ্যে রায়ে ৭২ জন আসামির মৃত্যুদণ্ড, ২২ জনের আমৃত্যু কারাদণ্ড এবং খালাস পেয়েছেন একজন।

 

এখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রোডাকশন ওয়ারেন্ট ও মামলার তারিখ নির্ধারণ এবং বিভিন্ন মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ করা ছাড়া আর তেমন কোনো কাজ চলছে না। কারণ, নিয়ম অনুযায়ী তিনজন বিচারক নিয়ে এই ট্রাইব্যুনালের বিচারিক কাজ চলার কথা। সেই নিয়মে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। অপর সদস্য হলেন- বিচারপতি আবু আহমেদ জমাদার।

 

গত ২৮ আগস্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সদস্য বিচারপতি আমির হোসেন মারা যান। তার মৃত্যুতে ট্রাইব্যুনালের তিন সদস্যের বেঞ্চের বিচারপতির পদ শূন্য হয়। এর পরেই ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠনে গত ১৪ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি কে এম হাফিজুল আলমকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেয় সরকার।

 

নেই রেজিস্ট্রার, করোনা আক্রান্ত বিচারপতি

ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার (সিনিয়র জেলা জজ) মো. সাঈদ আহমেদ অবসরে চলে গেছেন গত সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকে। এখন পর্যন্ত নতুন করে কাউকে রেজিস্ট্রার নিয়োগ দেওয়া হয়নি। আবার অবকাশ যাপন করতে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন  আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলাম।

 

টিনশেডে বিচারকাজ, ভবন সংস্কারের অপেক্ষা

অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ভবনের সংস্কার কাজ চালানোর জন্য সেই ভবনের পাশেই টিনশেড ঘর তৈরি করে সেখানে ট্রাইব্যুনালের আদলে এজলাস কক্ষ, হাজতখানা, বিচারপতির বসার স্থান, রেজিস্ট্রার, ডেপুটি রেজিস্ট্রার, প্রসিকিউশন টিমের বসার ব্যবস্থা, তদন্ত সংস্থার বসার স্থান, আইটি কক্ষ, গবেষণা কক্ষ, লাইব্রেরি ও প্রয়োজনীয় অফিস কক্ষ তৈরি করে বিচারকাজ চলছে গত ১২ ডিসেম্বর থেকে।

 

সবশেষ গত বুধবার (১২ জানুয়ারি) দুটি মামলার শুনানি হয়েছে। এক মামলায় তারিখ পিছিয়ে দিন ঠিক করা হয়েছে, অপর মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছে। এর পরের দিন বৃহস্পতিবার (১৩ জানুয়ারি) এক মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য থাকলেও আসামির করোনা পজিটিভ হওয়ায় তাকে আদালতে হাজির করতে না পারায় সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়নি।

 

তদন্ত ও বর্তমান মামলা

রাষ্ট্রপক্ষের একাধিক আইনজীবীর তথ্যমতে, বিচার ও প্রাক-বিচার পর্যায়ে থাকা ৩৭টি মামলায় আসামির সংখ্যা ২৩০ জনেরও বেশি। এর মধ্যে কারাগারে ১২৩ জন, পলাতক ৮০ জন। তাদের মধ্যে ১৯ জন মারা গেছেন। আর চারজন জামিনে আছেন।

 

এছাড়া এখন পর্যন্ত ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় অভিযোগ এসেছে ৭৭৮টি, যার মধ্যে ৭৯টি অভিযোগের তদন্ত শেষ হয়েছে। ২৬টি অভিযোগ তদন্তাধীন, যাতে আসামির সংখ্যা ৩৪ জন। এর বাইরে ৩ হাজার ৮৩৯ জনের বিরুদ্ধে থাকা ৬৯৪টি অভিযোগ গ্রহণ করেছে তদন্ত সংস্থা, যা তদন্ত শুরুর অপেক্ষায়।

 

যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের জন্য রয়েছে যেসব মামলা

ময়মনসিংহের আনিসুর রহমানসহ অন্যান্য আসামি ও সাতক্ষীরার মো. আব্দুল খালেক মণ্ডলসহ অন্যান্য আসামির বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে মামলা যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের জন্য রয়েছে। এছাড়া মৌলভীবাজারের আব্দুল আজিজ ওরফে হাবলুসহ অন্যান্য আসামি, খুলনার আমজাদ হাওলাদারসহ অন্যান্য আসামি ও খলিলুর রহমানসহ অন্যদের বিষয়ে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের জন্য রয়েছে।

 

 

 

আইনজীবী ও তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তারা যা বলছেন

রেজিস্ট্রারবিহীন ও এক বিচারক নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের অন্যতম প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট সৈয়দ হায়দার আলী  বলেন, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনালের তিনজন মেম্বারের (বিচারপতির) মধ্যে চেয়ারম্যানসহ দুজনের অনুপস্থিতিতে একজনই (বিচারপতি কে এম হাফিজুল ইসলাম) বিচার কাজ পরিচালনা করে আসছেন। চেয়ারম্যান মো. শাহিনুর ইসলাম বিদেশে আছেন। আর ট্রাইব্যুনালের বিচার কাজ ঠিকঠাক মতোই চলছে। একজন বিচারপতি তার এখতিয়ার অনুযায়ী বিচারিক কাজ করছেন। মামলায় অভিযোগ গঠন, যুক্তিতর্ক (আর্গুমেন্ট) এবং রায় বাদে অন্যান্য কাজ তিনি চালিয়ে যাচ্ছেন। আদালতের কার্যক্রম চলছে, আমরাও আমাদের কার্যক্রম করে যাচ্ছি।

 

নতুন বছরের প্রত্যাশা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের ওপর যে দায়িত্ব ন্যস্ত আছে সেটি চালিয়ে যাবো। এ ব্যাপারে আমরা খুবই সচেতন ও গুরুত্ব সহকারে চিন্তা করছি।

 

তিনি বলেন, আপনারাও জানেন, অভিযোগ আমলে নেওয়া, অভিযোগ গঠন, আগুর্মেন্ট ও জাজমেন্ট ছাড়া আর সবই করা যায় তাই সাক্ষ্যগ্রহণ করছেন তিনি। আর্গুমেন্ট করা যেত কিন্তু দুই বিচারপতির অনুপস্থিতিতে যুক্তিতর্ক হলে আবারও করতে হবে বিধায় আমরা সেটি করছি না।

 

অপর প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত  বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একজন বিচারপতি বিদেশে আছেন, ওনার করোনাও হয়েছে। আরেকজন দেশে অসুস্থ। এখন বিচারপতি আছেন মাত্র একজন।

 

তিনি বলেন, ওনার দ্বারা এখন মামলা আমলে নেওয়া, রায় দেওয়া কোনোটাই সম্ভব হবে না, শুধু কোনো মামলায় সাক্ষী এলে জবানবন্দি নেওয়া ছাড়া।

 

লধমড়হবংি২৪

 

এদিকে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ভবন পুরোনো হওয়ায় সেটির সংস্কার কাজও করা দরকার। তাই এখন টিনশেডে বিচারিক কাজ চলছে। ভবনের সংস্কার কাজ কবে শেষ হবে সেটি বলতে পারবেন একমাত্র সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলেও জানান প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত।

 

এ বিষয়ে আরেক প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ সীমন জাগো নিউজকে বলেন, ট্রাইব্যুনাল আইন অনুযায়ী একজন বিচারপতির যেসব কাজের বিচারিক এখতিয়ার আছে সেগুলো তিনি করছেন।

 

তিনি জানান, যেসব মামলার আসামি গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন তাদের হাজিরার নতুন দিন নির্ধারণ, যেসব মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ অব্যাহত ছিল ওইসব মামলায় সাক্ষীর জবানবন্দি নেওয়ার তারিখ ধার্য এবং পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি সংক্রান্ত আদেশ দেওয়া হচ্ছে।

 

‘রেজিস্ট্রার নিয়োগ দেওয়া না দেওয়া সরকারের ইচ্ছে। আশা করি, সুস্থ হয়ে বিচারপতিরা আদালতে আসবেন এবং রেজিস্ট্রার নিয়োগ দেওয়ার পরে যথারীতি আগের মতো ট্রাইব্যুনালের বিচার কার্যক্রম চলবে।’

 

বিষয়টি নিয়ে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক এম. সানাউল হক জাগো নিউজকে বলেন, তিন বিচারপতির মধ্যে দুজন বিচারপতি অনুপস্থিত থাকায় ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রমে মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ, তারিখ নির্ধারণ ও গ্রেফতারি পরোয়ানা সংক্রান্ত আবেদন ও আদেশ এসব চলছে। আশা করি, শিগগির ট্রাইব্যুনালের শুনানি পুরোদমে চালানো সম্ভব হবে। এছাড়া আমাদের কাজ পুরোদমে চলছে, কোনো বন্ধ নেই। আশা করি ট্রাইব্যুনাল অচিরেই আবার পুরোদমে চলবে।

 

প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বল জাগো নিউজকে বলেন, ট্রাইব্যুনালে মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ, তারিখ নির্ধারণ ও অন্যান্য কাজ হচ্ছে। আমাদের আইনজীবী, তদন্ত সংস্থার সদস্যরা, সাক্ষী ও অন্য সবাই সুস্থ আছেন। তাদের খোঁজ-খবর রাখা হচ্ছে।

 

লধমড়হবংি২৪

 

কর্মকর্তা-কর্মচারীর অসুস্থতাসহ সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে ট্রাইব্যুনালের আইটি এক্সপার্ট খন্দকার মেহেদী মাসুদ জাগো নিউজকে বলেন, বর্তমানে আমাদের কেউ অসুস্থ বোধ করলে তাদের কোর্টে আসতে নিষেধ করা হয়। স্বাস্থ্যবিধি পালন করে ট্রাইব্যুনালের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অফিস করেন। আমরা নিয়মিত অফিস করছি। আর বাকি সবকিছু গণমাধ্যম অবগত।

 

২০০৯ সালের ২৯ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রস্তাব পেশ করলে তা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৩৯ বছর পর মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের বিচারের জন্য ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পাশাপাশি বিচারক নিয়োগ, আইনজীবী প্যানেল ও তদন্ত সংস্থা গঠন করা হয়।

 

বিচারকাজ শুরুর পর টাইব্যুনালে এখন পর্যন্ত ৪৩টি মামলার রায় হয়েছে। এসব মামলার রায়ে ৭২ জন আসামির মৃত্যুদণ্ড, ২২ জনের আমৃত্যু কারাদণ্ড এবং খালাস পেয়েছেন একজন।

 

রায়ের বিরুদ্ধে আনা আপিল শুনানির পর ছয়জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল এবং পরবর্তীসময়ে রায় কার্যকর করা হয়েছে। ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়া ছয় আসামি হলেন- জামায়াতের সাবেক আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লা, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, বিএনপি নেতা সালাহ্ উদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী ও জামায়াত নেতা মীর কাশেম আলী।