ঢাকা, শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ই বৈশাখ ১৪৩১

কবি নজরুলের প্রথম স্ত্রী নার্গিসের জীবন কথা

মমিনুল ইসলাম মোল্লা | প্রকাশের সময় : মঙ্গলবার ২৪ মে ২০২২ ১২:১৪:০০ অপরাহ্ন | মতামত

নার্গিস ছিলেন কুমিল্লার মুরাদনগরের দৌলতপুরের আলী আকবর খানের বোনের মেয়ে।  নার্গিসের বাবার নাম আব্দুল খালেক মুন্সি আর মায়ের নাম আসমতের নেছা।  তার পৈতৃক নাম ছিল সৈয়দা খাতুন । ছোটবেলায় বাবা-মা মারা যাওয়ায় সে মামার বাড়িতে থাকতো। 

খা বাড়ি থেকে একটু দূরেই মুন্সিবাড়ি । সেখানকার জব্বার মুন্সির সাথে নজর আলী খানের মেয়ে আম্বিয়া খানমের বিয়ে ঠিক হয় । কাজী নজরুল ইসলামকে সে বিয়েতে দাওয়াত করা হয়। ১৯২১ সালের ৫ মে সেখানে পরিচয় হয় এক তরুনীর সাথে । তার নাম সৈয়দা খাতুন।  কাজী নজরুল এ নাম  পাল্টে ইরানের বিখ্যাত ফুলের নামে রাখলেন নার্গিস।  নার্গিস সম্পর্কে কবি লিখেছেন " এক অচেনা পল্লী বালিকার কাছে এত বিব্রত ও অসাবধান হয়ে পড়েছি যা কোনো নারীর কাছে হইনি। "

সামাজিকভাবে অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিয়ে সম্পন্ন হলেও নার্গিসকে ছেড়ে নজরুল বিয়ের রাতেই কুমিল্লা চলে আসেন। কাবিননামায় আপত্তিকর শর্ত থাকায় কবি হয়ত রেগে গিয়েছিলেন।   বৃষ্টি ভরা রাতে কর্দমাক্ত রাস্তায় ৪০ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে বীরেন্দ্র কুমারকে সাথে নিয়ে নজরুল কুমিল্লা এসে কিছুকাল অবস্থান করেন । তারপর বন্ধু মোজাফফর আহমেদ এসে তাকে কলকাতায় নিয়ে যান।  দৌলতপুর ছাড়ার পর নজরুল আরো কয়েকবার কুমিল্লায় এসেছিলেন বলে জানা যায়। 

দৌলতপুরে এসে সেখানকার মনোরম পরিবেশে অবস্থান করে কবি বহু কবিতা ও গান কবিতা লিখেছেন । নজরুল গবেষকদের মতে তিনি এখানে কবিতা লিখেছেন ১২০ টি এবং গান গেয়েছেন ১৬০ টি। উল্লেখযোগ্য কবিতাসমূহ হচ্ছে-বেদনা অভিমান,অবহেলা, অনাদৃতা , পথিকপ্রিয়া, বিদায় বেলা প্রভৃতি । এছাড়াও রয়েছে হার মানা হার, হারামণি ও বিধুরা।

কবি তার প্রিয়তমের নাম দিয়েছিলেন নার্গিস । ফারসি ভাষায় নার্গিস শব্দের অর্থ গুল্ম।  ছায়ানট, পুবের হাওয়া, চক্রবাক কাব্য গ্রন্থের অনেক কবিতা লিখেছেন এখানে এসে।  এছাড়া ছায়ানটের ৫০ টি কবিতার মধ্যে নয়টি কবিতা ছিল নার্গিস কে নিয়ে লেখা। কবি নজরুল কলিকাতা,  ময়মনসিংহের ত্রিশাল সহ যত জায়গায় গিয়েছেন তার মধ্যে কুমিল্লায় অবস্থানের ঘটনা ছিল সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য।  ১৯২৪ সাল পর্যন্ত কবি তার  প্রিয় কুমিল্লায় ৫ বার এসেছেন।  এসময়  তিনি ১১ মাসের বেশি সময় কুমিল্লা শহর ও মুরাদনগরের দৌলতপুরে কাটান।  প্রথমবার ১৯২১সালের ৮ জুলাই পর্যন্ত , দ্বিতী বার আসেন ১৯২১ সালের নভেম্বরে থাকেন ডিসেম্বর পর্যন্ত।  তৃতীয়বার ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ছিলেন জুন পর্যন্ত।  চতুর্থবার ১৯২২ সালের ২৩ শে অক্টোবর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত।  পঞ্চম বার ১৯২৩  সালের ডিসেম্বরে আসেন এ সময় কতদিন ছিলেন তা জানা সম্ভব হয়নি। কুমিল্লায় তিনি দুইবার গ্রেপ্তার হন হন । ১৯২১ সালের নভেম্বর মাসে একবার ব্রিটিশবিরোধী গান গাওয়ার কারণে , এছাড়া ১৯২২ সালের ২৩ নভেম্বর ঝাউতলা থেকে তিনি গ্রেফতার হন ।  নজরুল দৌলতপুর ছেড়ে গেলে ও নার্গিসকে ভুলতে পারেননি।  চিঠির ভাষায় তা অনুধাবন করা যায়। চিঠিতে লিখেছেন তার মনের কথা । তিনি  লিখেছেন , আমার অন্তর্যামী জানেন , তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কি গভীর ক্ষত,  কি অসীম বেদনা,  কিন্তু সে বেদনার আগুনে আমিই পুড়েছি । তা দিয়ে তোমায় কোনদিন দগ্ধ করতে চাইনি।  তুমি এই আগুনের পরশ মানিক না দিলে আমি অগ্নিবীণা বাজাতে পারতাম না । ধূমকেতুর বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না। নার্গিস দীর্ঘ ১৬ বছর কাজী নজরুলের জন্য অপেক্ষা করেন। তিনি খুব বেশি লেখাপড়া জানতেন না।  তৎকালীন সময়ে মেয়েরা বাড়ির বাইরে গিয়ে লেখাপড়া করতো না। মেয়েদের জন্য আলাদা বিদ্যালয় করার কথা চিন্তাও করা যেত না । তারপরও নার্গিসকে নজরুলের জন্য উপযোগী করে তুলতে আলী আকবর খানের চেষ্টার কমতি ছিল না । বাড়িতে তিনি নার্গিসের লেখাপড়ার  ব্যবস্থা করেছিলেন বলে জানা যায়। সর্বশেষ  ১৯৩৭ সালে নার্গিস কবি কাজী নজরুল ইসলাম কে চিঠি লিখেন । তার চিঠি পাওয়ার পর কবি কাজী নজরুল ইসলাম গানের ভাষায় তার জবাব দেন।  " যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পারো নাই, কেন মনে রাখো তারে ? ভুলে যাও,  ভুলে যাও একেবারে। "  কবি আজিজুল হাকিম ছিলেন আলী আকবর খানের প্রকাশনীর ম্যানেজার।   নজরুলের সাথে বিবাহ বিচ্ছেদের ৭/৮ মাসের মাথায় তার সাথে নার্গিসের দ্বিতীয় বিয়ে সম্পন্ন হয় । ১৯৮৪ সালে নার্গিসের মৃত্যু হয়।  তার দুই ছেলে বর্তমানে বিদেশে অবস্থান করছে বলে পারিবারিক সূত্রে জানা যায়। ( চতুর্থ পর্বের সমাপ্তি )

 লেখক:  মমিনুল ইসলাম মোল্লা ,কলেজ শিক্ষক, মানবাধিকার কর্মী ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, কুমিল্লা।