এক কালের খরস্রোতা লৌহজং নদী এখন মৃতপ্রায়। পলি জমার পাশাপাশি পানির অভাবে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ও নাব্যতা হারিয়ে গেছে। এমন বৈরী পরিবেশের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অবৈধ দখল ও শহরের ফেলা বর্জ্য। মারাত্মক দূষণ বর্তমানে এই নদীটিকে মরা নোংরা খালে পরিণত করেছে। এসবই ঘটেছে মাত্র কয়েক দশকের ব্যবধানে। টাঙ্গাইল সদর উপজেলার কাশিনগর এলাকায় ধলেশ্বরী থেকে উৎপত্তি হয়ে ৭৬ কিলোমিটার দীর্ঘ লৌহজং নদী জেলা শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে জেলার মির্জাপুর উপজেলার বংশাই নদীতে গিয়ে পড়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, লৌহজং নদীর উৎসমুখ বালিতে ভরাট হয়ে গেছে। যুগনি সুইস গেট এলাকাসহ নদীর অধিকাংশ স্থানই প্রায় পানিশূন্য। শহর এলাকায় নর্দমার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে নদীটি। দিনের পর দিন ফেলা নোংরা, আবর্জনার গন্ধে টেকা দুষ্কর হয়ে পড়েছে নদীপারের বাসিন্দাদের।
শহরের প্রবীণরা জানান, টাঙ্গাইল শহরের বুক চিরে বয়ে গেছে এই নদী। ১৯৮০ এর দশক পর্যন্ত এই নদীতে লঞ্চ ও পণ্যবোঝাই বড় বড় নৌকা চলাচল করেছে। নদীপথে রাজশাহী থেকে আম বোঝাই নৌকা এসে শহরে ভিড়তো। এজন্য শহরের কলেজ পাড়ার একটি সড়কের নামকরণ হয়েছে “আমঘাট রোড”। এ অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারের ক্ষেত্রে লৌহজং নদীর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকা এবং আশেপাশের জেলাগুলো থেকে খুব সহজে এ নদীর মাধ্যমে টাঙ্গাইল জেলা শহরে প্রবেশ করা যেত। যার ফলে যাত্রী পরিবহন এবং মালামাল স্থানান্তরে আরামদায়ক পথ ছিল এ নদী। অর্থনৈতিক ও সামজিক উন্নয়নে নদীর ভূমিকা অনস্বীকার্য ছিল। উজানে যমুনা ও এর শাখা ধলেশ্বরীতে পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় এর প্রভাব পড়ে লৌহজংয়ের প্রবাহেও। নাব্যতা হারাতে থাকে নদীটি। বন্ধ হয়ে যেতে থাকে বড় বড় নৌকার চলাচল। পরে পানি উন্নয়ন বোর্ড বন্যা কর্ম পরিকল্পনার (ফ্লাড অ্যাকশন প্ল্যান/ ফ্যাপ-২০) অধীনে ১৯৯১ সালে সদর উপজেলার যুগনিতে লৌহজং ও ধলেশ্বরীর সঙ্গমস্থলের কাছে সুইস গেট নির্মাণ করায় মরে যেতে শুরু করে নদীটি। পরে নদীর তীর দ্রুত দখল হয়ে যেতে শুরু করে। শুরু হয় বাড়ী-ঘর নির্মাণ, ধান ও সবজি চাষ।
পাশাপাশি পৌর এলাকার বসতবাড়ী থেকে নির্গত ময়লা পানি ও আবর্জনা, বিসিক শিল্প এলাকার কয়েকটি কারখানা ও সদর উপজেলার ক্ষুদিরামপুরে টেক্সটাইল মিল থেকে নির্গত বর্জ্য সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নদীটিকে মারাত্মকভাবে দূষিত করতে থাকে। লৌহজংয়ের পানি মানুষ ও গবাদি পশুর ব্যবহারে অনুপযোগী হয়ে পরে। এই নদীতে থাকা জলজ প্রানী বিলুপ্তির মুখে পরে। তাছাড়া দূষিত পানির দুর্গন্ধে নদীর ধারে মানুষের বসবাস কঠিন হয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে বছরের পর বছর ধরে সংশ্লিষ্ট নাগরিক ও স্থানীয় পরিবেশকর্মীরা নদীটির নাব্যতা ফিরিয়ে আনাসহ দখল ও দূষণমুক্ত করার দাবিতে নানান কর্মসূচি পালন করে আসছেন। বিগত ২০১৬ সালের (২৯ নভেম্বর) তৎকালীন জেলা প্রশাসন মোট ৭৬ কিলোমিটার নদীর মধ্যে পৌর এলাকার হাজরা ঘাট থেকে বেড়াডোমা পর্যন্ত মাত্র দেড় কিলোমিটার এলাকার নদীর জায়গা দখলমুক্ত করার উদ্যোগ নেয়। প্রাথমিকভাবে কিছু অবৈধ স্থাপনা অপসারণ করা হলেও পরে অজ্ঞাত কারণে উচ্ছেদ কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। বিগত ২০২০ সালের (২৫ ফেব্রুয়ারী) তৎকালীন জেলা প্রশাসন একইস্থানে পুণরায় উচ্ছেদ অভিযান শুরু করে।
সে সময় শুধু সদর উপজেলাতেই সাড়ে চার শতাধিক অবৈধ স্থাপনা শনাক্ত করা হয়। এর মধ্যে পৌর এলাকায় নদীর তীরে ৩ কিলোমিটারের মধ্যে ২৬০টির বেশি অবৈধ স্থাপনা রয়েছে। কয়েকটি স্থাপনা ভেঙে ফেলার পর, নদীর সীমানা নির্ধারণ ও দখলদারদের চিহ্নিত করা নিয়ে বির্তকের মুখে পরে এই অভিযানটিও স্থগিত করা হয়। পৌর এলাকার স্টেডিয়াম সংলগ্ন নদীপাড়ের বাসিন্দা রবিন মিয়া বলেন, সরকার নদীটি খনন করতে চাচ্ছে, পরিবেশ সুন্দর করতে চাচ্ছে এর সঙ্গে আমরা একমত। বিগত ১৯৬২ সালে জমিগুলো আমাদের নামে রেকর্ড করে দেওয়ায় ডিসি অফিস খারিজ করে দিয়েছে। ভূমি অফিস খাজনা নিয়েছে ও পৌরসভা ভবন নির্মাণের পরিকল্পনার অনুমোদন করেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমরা ঘর করেছি। এখন যদি এই জমি থেকে আমাদের সরিয়ে দেওয়া হয় তবে আমাদের জমির ন্যায্যমূল্য দিতে হবে।
টাঙ্গাইলের নদী, খাল ও জলাশয় রক্ষা আন্দোলন কমিটির সাধারণ সম্পাদক রতন আহমেদ সিদ্দিক জানান, নদীর জমি দখলের পাশাপাশি সেখানে এখনও আবর্জনা ফেলা হচ্ছে। শহরের প্রধান কাঁচাবাজার পার্ক বাজারের সব বর্জ্য ড্রেনের মাধ্যমে নদীতে ফেলা হচ্ছে।
পরিবেশকর্মী মাসুম আহমেদ বলেন, কয়েক বছর আগে স্থানীয় প্রশাসন অনেক ঢাক-ঢোল পিটিয়ে নদীর ৭৬ কিলোমিটারের মধ্যে পৌর এলাকার মাত্র দেড় কিলোমিটার দখল ও দূষণমুক্ত করার চেষ্টা করেছিল। নদীতে যদি পানিই না থাকে তাহলে কোটি কোটি টাকা খরচ করে এর পাড় বাঁধাই বা অন্য কার্যক্রম করে লাভ নেই। নদীর প্রাণ হচ্ছে পানি। দখল-দূষণ মুক্ত করার পাশাপাশি উৎসমুখ থেকে পুরো নদীতে কিভাবে প্রবাহ ফিরিয়ে আনা যায় সেই উদ্যোগ নেওয়া হোক।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) টাঙ্গাইলের বিভাগীয় সমন্বয়কারী গৌতম চন্দ্র জানান, দখল-দূষণে লৌহজং মৃত প্রায় আজ। শুধু দেড় বা ৩ কিলোমিটার উদ্ধার করে নদীর পাড়ে রাস্তা বা অন্য কিছু নির্মাণ করে কাজের কাজ কিছু হবে না। মানুষ নদী সৃষ্টি করতে পারে না। এটি প্রাকৃতিক সম্পদ। নদী বাঁচলে মানুষ বাঁচবে, দেশ বাঁচবে। কাজেই নদীটিকে সচল করতে হবে। নদীর উৎস মুখ থেকে প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে হবে। তিনি আরও জানান, নদীকে নদীর গতিতে চলতে দিতে হবে। এর প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীব-বৈচিত্র্য রক্ষা করতে হবে।
টাঙ্গাইল সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) খায়রুল ইসলাম জানান, নদীটির বেহাল দশা দেখেছি। যে অংশটুকুতে অভিযান চালানো হয়েছিল তা আবার দখলের প্রক্রিয়া চলছে।
টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক ড. আতাউল গণি জানান, এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।