ঢাকা, মঙ্গলবার ২১ মে ২০২৪, ৬ই জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

টিলার উপরে বিশাল গাছের নিচে শাহপরাণ (রহ) মাজার: উরসকে সামনে রেখে উৎসবের আমেজ

সিলেট ব্যুরো : | প্রকাশের সময় : মঙ্গলবার ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০২:৫৬:০০ অপরাহ্ন | সিলেট প্রতিদিন

শাহপরাণের মাজার সিলেট শহরের একটি পুণ্য তীর্থ বা আধ্যাত্মিক স্থাপনা। যা হচ্ছে ১৩০৩ খ্রিষ্টাব্দে মধ্যপ্রাচ্য হতে বাংলাদেশে আসা ইসলাম ধর্ম প্রচারক শাহজালালের অন্যতম সঙ্গী অনুসারী শাহপরাণের সমাধি। এটি সিলেট শহরের পূর্ব দিকে খাদিমপাড়া এলাকায় অবস্থিত। শাহজালালের দরগাহ থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরত্বে শাহপরাণের মাজার অবস্থিত। শাহজালালের দরগাহর মতো এ মাজারেও প্রচুর দর্শনার্থীর আগমন ঘটে। ঐতিহাসিক মুমিনুল হক সহ অনেকেই লিখেছেন; সিলেট বিভাগ ও ভারতের বিভিন্ন এলাকায় শাহপরাণের দ্বারা মুসলিম ধর্ম বিশ্বাস ও সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসার হয়েছে।
 
সিলেট শহরের পূর্ব দিকে খাদিমনগর এলাকায় টিলার উপর একটি প্রকান্ড বৃক্ষের নিচে রয়েছে শাহপরাণের কবর। মাজার টিলায় উঠা নামার জন্য উক্ত মাজার প্রাঙ্গনে উত্তর ও দক্ষিণ হয়ে সিঁড়ি আছে। যা প্রায় ৮ থেকে ১০ ফুট উঁচু দেখায়। এই সিঁড়িটি মোগল আমলে নির্মিত বলে লোকমুখে শোনা যায়। মাজারের পশ্চিম দিকে মোগল বাদশাদের স্থাপত্যকীর্তিতে নির্মিত তিনটি গম্বুজ বিশিষ্ট একটি মসজিদ রয়েছে। এই মসজিদে প্রায় ৫ শত মুসল্লী এক সাথে নামাজ আদায় করে থাকেন। মাজার টিলা থেকে প্রায় ১৫-২০ ফুট দহ্মিণ পশ্চিমে মহিলা পর্যটকদের জন্য দালান ঘর রয়েছে। উক্ত দালানের অল্প পরিসর দক্ষিণ পুর্বে আরেকটি ঘর দেখতে পাওয়া যায়। এ ঘরখানা মুলত বিদেশাগত পর্যটকদের বিশ্রামাগার হিসেবে ব্যবহার হয়। এই ঘরের পাশেই একটি পুকুর রয়েছে, যা অজু গোসলের জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

শাহপরাণের পুর্ব পুরুষগণ মূলত বোখারা শহরের অধিবাসী ছিলেন। তার উর্ধ্বতন ৪র্থ পুরুষ শাহ জামাল উদ্দীন, বোখারা হতে ধর্ম প্রচারের জন্য প্রথমে সমরখন্দ ও পরে তুর্কিস্থান এ এসে বসবাস করেন। বংশ সূত্রে শাহপরাণের পিতা মোহাম্মদও একজন খ্যাতনামা ধার্মিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাঁর মাতা শাহজালালের আত্মিয় সম্পর্কে বোন ছিলেন। সে হিসেবে তিনি (শাহপরাণ) হচ্ছেন শাহজালালের ভাগ্নে। শাহপরাণের বয়স যখন ১১ বছর তখন তিনি তার পিতাকে হারান। পরবর্তিকালে তার আত্মীয় প্রখ্যাত দরবেশ সৈয়দ আহমদ কবিরের কাছে তিনি ধর্ম শিক্ষায় দীক্ষিত হন। সেখান থেকে তিনি আধ্যাত্মিক দীক্ষা লাভে নেশাপুরের বিখ্যাত দরবেশ পাগলা আমীনের স্মরণাপন্ন হয়ে আধ্যাত্মিক শিক্ষায় দীক্ষিত হন। শাহজালাল যখন বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে যাত্রার উদ্যোগ নেন। এ সময় তিনি (শাহপরাণ) খবর পেয়ে মামার সহচার্য লাভের আশায় হিন্দু স্থানে এসে মামার সঙ্গী হন। সিলেট বিজয়ের পর শাহজালালের আদেশে তিনি ইসলাম প্রচারের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। শাহপরাণ সিলেটের নবীগঞ্জ, হবিগঞ্জ সহ বিভিন্ন স্থানে ইসলাম প্রচার করেন। পরবর্তিকালে অলৌকিক ঘটনা প্রকাশ হলে শাহজালালের নির্দেশে তিনি (শাহপরাণ) সিলেট শহর হতে ছয় মাইল দূরবর্তী খাদিম পাড়া এলাকায় এসে ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে বসতি স্থাপন করেন এবং এখানেই জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত ইসলাম প্রচার করে বর্তমান মাজার টিলায় চির নিদ্রায় শায়িত হন।

শাহজালাল সিলেট আগমন কালে দিল্লী থেকে আসার সময় নিজামুদ্দিন আউলিয়া প্রদত্ত এক জোড়া কবুতর (সিলেটি উচ্চারণ - কৈতর) সঙ্গে আনেন। কবুতর জোড়া সিলেট নিয়ে আসার পর বংশ বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং শাহজালালের কবুতর বলে জালালী কৈতর নামে খ্যাত হয়। ধর্মীয় অনূভূতির কারণে এ কবুতর কেহ শিকার করত না। শাহপরাণ এ বিষয়টি আমলে না নিয়ে, প্রতি দিন একটি করে কবুতর খেতেন। কবুতরের সংখ্যা কম দেখে শাহজালাল অনুসন্ধানে মুল ঘটনা জেনে রুষ্ট হন। একথা শাহপরাণ জানতে পেরে গোপন করে রাখা মৃত কবুতরের পাখ বা পালক হাতে উঠিয়ে বাতাসে উড়িয়ে দিয়ে বললেন; আল্লাহর হুকুমে কবুতর হয়ে শাহজালালের কাছে পৌঁছে যাও। সাথে সাথে পাখ বা পালক গুলো এক ঝাঁক কবুতর হয়ে শাহজালালের কাছে পৌঁছে গেল। শাহজালাল ভাগনেকে ডেকে বললেন; তোমার অলৌকিক শক্তি দেখে আমি সন্তুষ্ট হয়েছি । কিন্তু এভাবে প্রকাশ্যে কেরামত প্রকাশ করা সঠিক নয়। সব মানুষের বোধশক্তি একরকম হয় না। এভাবে কেরামত প্রকাশের কারণে মানুষ ভুল ব্যাখ্যায় পতিত হতে পারে। এরপর শাহপরাণকে খাদিম পাড়া এলাকায় ইসলাম প্রচারের নির্দেশ দিয়ে সেখানে পাঠিয়ে দেন। শাহপরাণ খাদিম পাড়ায় ইসলাম প্রচারে তার জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত নিজেকে ব্যস্ত রাখেন এবং এখানেই তিনি চির নিদ্রায় শায়িত হন।

তিনদিনব্যাপী উরস ২০ সেপ্টেম্বর থেকে
কুতুবুল আফতাব শেখউল মাশায়েখ শাহেন শাহ ওলি হযরত শাহপরাণ (রহ.) এর তিনদিনব্যাপী উরস মোবারক ২০ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হবে। ২২ সেপ্টেম্বর ভোর রাতে আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে উরস। যথাযথ পবিত্রতা বজায় রেখে উরস পালনের সকল ধরণের প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। উরসে শরিয়ত বিরোধী সকল ধরণের কার্যকলাপের জন্যে দরগাহ কর্তৃপক্ষ দায়ি নয় বলে জানিয়ে দেয়া হয়েছে।

হযরত শাহপরাণ (রহ.) এর মাজার শরীফের মোতায়াল্লি সৈয়দ মামুনুর রশিদ খাদিম এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছেন, ২০ সেপ্টেম্বর সকাল ৯ টা থেকে খতমে কোরআন, বাদ আসর দোয়া, জিকির, আজকার ও মিলাদ অনুষ্ঠিত হবে।

২১ সেপ্টেম্বর সকাল ১০ টা থেকে মাজারে খিলাপ চড়ানো হবে। বাদ জোহর গরু জবেহ করা হবে। সারারাত জিকির আজকার, খতমে কোরআন, মিলাদ মাহফিল, রাত তিনটায় ফাতেহা পাঠ অনুষ্ঠিত হবে। পরে অনুষ্ঠিত হবে আখেরি মোনাজাত। বাদ ফজর বিতরণ করা হবে নিয়াজ। ২২ সেপ্টেম্বর বাদ আসর সরবত বিতরণ ও শেষ ফাতেহা পাঠ অনুষ্ঠিত হবে।

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, মহিলাদের জন্যে পৃথক এবাদতখানা রয়েছে। ওই এবাদতখানায় মহিলাদের এবাদত করার জন্যে অনুরোধ করা হয়েছে। এবাদতখানার বাইরে মহিলাদের ঘোরাফেরা না করার জন্যে অনুরোধ করা হয়েছে।

এছাড়া মাজার এলাকায় মাইক ব্যবহার না করার জন্যে অনুরোধ করা হয়েছে। মাজার এলাকায় মাইক বাজানো সম্পূর্ণ নিষেধ। অনুরোধ করা হয়েছে নেশা জাতীয় দ্রব্য ব্যবহার না করার জন্যে। উরসের শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সকলের প্রতি অনুরোধ করা হয়েছে।