মুনাফা আকর্ষণীয়। লভ্যাংশ ঘোষণা চমক জাগানো। তবু মিউচুয়াল ফান্ডের প্রতি অনাগ্রহী শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীরা। এতে মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর দাম থেকে গেছে সেই তলানিতেই। ঠিক আছে মোটে দুটি মিউচুয়াল ফান্ডের দাম। বাকি সবগুলোর দাম নেট অ্যাসেট ভ্যালুর (এনএভি) অনেক নিচে। মিউচুয়াল ফান্ডের এ চিত্র অস্বাভাবিক বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, সম্পদ ব্যবস্থাপকদের অদক্ষতা ও বিনিয়োগকারীদের সচেতনতার অভাবে মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর এমন করুণ দশা। এ চিত্র সার্বিক শেয়ারবাজারের জন্য ভালো না। কারণ মিউচুয়াল ফান্ড শক্তিশালী করা না গেলে শেয়ারবাজারের ভিত শক্তিশালী হবে না। কাজেই সার্বিক শেয়ারবাজারের স্বার্থেই মিউচুয়াল ফান্ড খাতকে শক্তিশালী করতে হবে।
তারা আরও বলছেন, একটি মিউচুয়াল ফান্ডের দাম এনএভি থেকে ১০ শতাংশ কম বা বেশি হতে পারে। কিন্তু মিউচুয়াল ফান্ডের দাম এনএভি তুলনায় ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ কম বা বেশি হওয়া কিছুতেই স্বাভাবিক না।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, শেয়ারবাজারে লেনদেন হওয়া মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর মধ্যে মাত্র দুটির দাম এনএভির ওপরে রয়েছে। এর মধ্যে প্রাইম ফাইন্যান্স ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ডের দাম ২০ টাকা ৩০ পয়সা। এই ফান্ডটির এনএভি ১৬ টাকা ৬৯ পয়সা। অর্থাৎ এনএভি থেকে ফান্ডটির দাম ২২ শতাংশ বেশি। সবশেষ সমাপ্ত হিসাব বছরে ফান্ডটি ৮ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে।
বর্তমান বাজারদরে এনএভির ওপরে থাকা সিএপিএম আইবিবিএল ইসলামী মিউচুয়াল ফান্ডের দাম ১৫ টাকা ৯০ পয়সা। ফান্ডটির এনএভি ১২ টাকা ৭৪ পয়সা। অর্থাৎ এনএভি থেকে ফান্ডটির দাম ২৫ শতাংশ বেশি। সবশেষ সমাপ্ত হিসাব বছরে ফান্ডটি বিনিয়োগকারীদের ১৩ দশমিক ৫০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে।
এই দুই মিউচুয়াল ফান্ড বাদে বাকিগুলোর বর্তমান বাজারদর এনএভির অনেক নিচে অবস্থান করছে। এমনকি এনএভির অর্ধেকের কম দামেও বিক্রি হচ্ছে মিউচুয়াল ফান্ড। অথচ সবশেষ হিসাব বছরে এ মিউচুয়াল ফান্ডগুলো বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণীয় লভ্যাংশ দিয়েছে।
বর্তমানে সবচেয়ে অবমূল্যায়িত অবস্থায় রয়েছে ফার্স্ট বাংলাদেশ ফিক্সড ইনকাম ফান্ড। এই ফান্ডের বাজার দাম ৫ টাকা ৫০ পয়সা। সবশেষ সমাপ্ত হিসাব বছরে ৪ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেওয়া এ ফান্ডটির এনএভি ১১ টাকা ৮৭ পয়সা। অর্থাৎ এনএভি থেকে ৫৪ শতাংশ কম দামে ফান্ডটি বিক্রি হচ্ছে।
এনএভির অর্ধেক দামে লেনদেন হওয়ার এ তালিকায় আরও রয়েছে এবি ব্যাংক ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড, আইএফআইসি প্রথম মিউচুয়াল ফান্ড, পিএইচপি ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড, পপুলার লাইফ ফার্স্ট ও ট্রাস্ট ব্যাংক ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড।
এর মধ্যে এবি ব্যাংক ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড সবশেষ সমাপ্ত হিসাব বছরে বিনিয়োগকারীদের ৮ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে। এই মিউচুয়াল ফান্ডটির এনএভি ১১ টাকা ৬৩ পয়সা। অথচ ফান্ডটি লেনদেন হচ্ছে ৫ টাকা ৭০ পয়সায়। অর্থাৎ, এনএভি থেকে ফান্ডটির দাম ৫১ শতাংশ কম।
আইএফআইসি প্রথম মিউচুয়াল ফান্ড বিক্রি হচ্ছে এনএভি থেকে ৫১ শতাংশ কম দামে। সবশেষ সমাপ্ত হিসাব বছরে সাড়ে ৭ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেওয়া এই ফান্ডটির এনএভি ১১ টাকা ৩৫ পয়সা। অথচ বাজারদর ৫ টাকা ৬০ পয়সা।
পিএইচপি ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ডের বাজারদর ৫ টাকা ৬০ পয়সা। সবশেষ সমাপ্ত হিসাব বছরে সাড়ে ৮ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেওয়া এই ফান্ডটির এনএভি ১১ টাকা ৫২ পয়সা। অর্থাৎ এনএভি থেকে ফান্ডটি ৫১ শতাংশ কম দামে বিক্রি হচ্ছে।
পপুলার লাইফ ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড সবশেষ সমাপ্ত হিসাব বছরে বিনিয়োগকারীদের সাড়ে ৮ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে। ১১ টাকা ৩৮ পয়সা এনএভির এই ফান্ডটি বর্তমান বাজারদর ৫ টাকা ৫০ পয়সা। এ ফান্ডটিও এনএভি থেকে ৫১ শতাংশ কম দামে বিক্রি হচ্ছে।
ট্রাস্ট ব্যাংক ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড বিক্রি হচ্ছে এনএভি থেকে ৫০ শতাংশ কম দামে। সবশেষ সমাপ্ত হিসাব বছরে বিনিয়োগকারীদের ৯ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেওয়া এই ফান্ডটির এনএভি ১১ টাকা ৭৬ পয়সা। অথচ ফান্ডটির বাজার দাম ৫ টাকা ৯০ পয়সা।
মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর এ চিত্র সম্পর্কে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের এক সদস্য বলেন, অতীতে মিউচুয়াল ফান্ডগুলোতে নানা ধরনের অনিয়ম হয়েছে। ফান্ডগুলো বিনিয়োগকারীদের ভালো লভ্যাংশ দিতে পারেনি। যে কারণে মিউচুয়াল ফান্ড থেকে বিনিয়োগকারীরা আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। এখন ভালো লভ্যাংশ দেওয়ার পরও বিনিয়োগকারীরা তাই মিউচুয়াল ফান্ডে আগ্রহী হচ্ছেন না। শেয়ারবাজারও চলছে আইটেম নির্ভর। বিনিয়োগকারীরা এক সপ্তাহের মধ্যে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ মুনাফা করার চেষ্টা করছেন। আর যারা আইটেম নিয়ে খেলছেন তারা মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করছেন না। মিউচুয়াল ফান্ড তলানিতে থাকার এটিও একটি কারণ।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ১০ থেকে ১৫ শতাংশ লভ্যাংশ দেওয়া মিউচুয়াল ফান্ডের দাম ৬ থেকে ৮ টাকার মধ্যে লেনদেন হওয়া ঠিক না। এটা অস্বাভাবিক। আসলে মিউচুয়াল ফান্ড থেকে বিনিয়োগকারীরা আস্থা হারিয়ে ফেলেছে।
তিনি বলেন, মিউচুয়াল ফান্ড খুব একটা খারাপ করছে বলে আমার মনে হয় না। তবে এ বিষয়ে বিনিয়োগকারীদের সচেতনতার অভাব আছে। তাই বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করলে কী ধরনের সুবিধা পাওয়া যায় সে বিষয়ে তাদের সজাগ করা উচিত।
বিএসইসির সাবেক আরেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, মিউচুয়াল ফান্ডের সমস্যা নতুন না, এটা গত ১০ বছরের সমস্যা। এটার বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। প্রথমত, এটা থেকে দ্রুত মুনাফা করা যায় না। আর আমাদের যারা বিনিয়োগকারী তারা দ্রুত মুনাফা চান। তিনদিনে মুনাফা চান। আমাদের বিনিয়োগকারী চান আজ দাম ১০ টাকা, তিনদিন পর ১৩ টাকা হয়ে যাবে, ৩০ শতাংশ মুনাফা পেয়ে যাবেন। এটা তো মিউচুয়াল ফান্ডে হয় না। আমার মনে হয়, বিনিয়োগকারীরা মিউচুয়াল ফান্ডে না যাওয়ার এটা একটা প্রধান কারণ।
দুই নম্বর হচ্ছে, মিউচুয়াল ফান্ডের একটা টাইম ফ্রেম থাকে। ওই টাইম ফ্রেমে মিউচুয়াল ফান্ড শেষ করে দেওয়া উচিত। এটা আবার বিভিন্ন ফর্মে এক্সটেনশন (মেয়াদ বাড়ানো) করলে এনএভি থেকে বাজারদর কমই থাকবে। আমি মনে করি, মিউচুয়াল ফান্ডের সাইজ ও টাইম অপরিবর্তিত থাকা উচিত। এই জায়গাগুলোতে আমরা কম্প্রোমাইজ করে ফেলছি। যোগ করেন এই শেয়ারবাজার বিশ্লেষক।
মিউচুয়াল ফান্ড তলানিতে পড়ে থাকার তৃতীয় সমস্যা হিসেবে তিনি বলেন, মিউচুয়াল ফান্ডগুলো হাই মার্কেটে এসেছিল, যে কারণে প্রাথমিকভাবে বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমে গেছে। আবার তাদের (মিউচুয়াল ফান্ডের সম্পদ ব্যবস্থাপক) দক্ষ জনবল নেই এবং নানা সমস্যা আছে।
তিনি আরও বলেন, অন্য দেশে বিনিয়োগকারীরা মিউচুয়াল ফান্ডের মাধ্যমে বিনিয়োগ করেন। কিন্তু আমাদের দেশে এটা নেই। মিউচুয়াল ফান্ডকে অবশ্যই শক্তিশালী করতে হবে। মিউচুয়াল ফান্ড শক্তিশালী না হলে যারা প্রকৃত বিনিয়োগকারী তারা আগ্রহী হবেন না। শেয়ারবাজার শক্তিশালী ও স্থিতিশীল করতে হলে মিউচুয়াল ফান্ডের ভূমিকা থাকতেই হবে। মিউচুয়াল ফান্ড সেই ভূমিকা পালন করতে পারছে না। এটা কীভাবে শক্তিশালী করা যায় এই চিন্তা অবশ্যই করা উচিত।