ঢাকা, সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১১ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১

দুই দিনের সংঘাতে নামে বেনামে আসামি

Author Dainik Bayanno | প্রকাশের সময় : শুক্রবার ২১ জুলাই ২০২৩ ০১:২৮:০০ পূর্বাহ্ন | রাজনীতি

 

 

সারা দেশে বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে গণহারে মামলা দেওয়া হচ্ছে। দলটির দুই দিনের পদযাত্রা কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ঢাকাসহ সারা দেশে বিভিন্ন জেলায় ৮ হাজার জনের নামোল্লেখসহ ২০ হাজারেরও বেশি নেতা-কর্মীকে আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রতিদিনই নতুন নতুন মামলা দায়ের অব্যাহত রয়েছে। দলের নীতিনির্ধারকরা বলেছেন, কোথাও ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী কিংবা কোথাও থানা পুলিশের কোনো কর্মকর্তা বাদী হয়ে এসব মামলা দিচ্ছেন। এসব এজাহারে জ্ঞাত বা অজ্ঞাত নাম উল্লেখ করে শত শত, হাজার হাজার নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ঘটনার কারণ হিসেবে হামলা ও সংঘর্ষের কথা উল্লেখ করা হলেও মামলা দেওয়া হচ্ছে শুধু বিএনপির নেতা-কর্মীদের নামে। আর মামলা দায়ের করার পরপরই এসব নেতা-কর্মীর বাড়িতে গিয়ে হানা দিচ্ছে পুলিশ। গ্রেফতার করা হচ্ছে তাদের। দলীয় নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে এ অন্যায় মামলা দায়ের বন্ধ করতে এবং গ্রেফতার ঠেকাতে নয়া কৌশল খুঁজছেন বিএনপি নেতারা। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো এসব তথ্য জানিয়েছে।

 

দেশব্যাপী ‘গণহারে মামলা ও গ্রেফতারের’ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সরকার আবারও একই ফন্দি শুরু করেছে। কিন্তু এসব করে আর কোনো লাভ হবে না। মানুষ জেগে উঠেছে। বিরোধী দলের সভা-সমাবেশগুলো দেখে কিছুটা হলেও অনুমান করা যাচ্ছে। বিশ্ববাসী আজ এদের দুরভিসন্ধি সম্পর্কে অবহিত। কেউ চাইছে না আর এ সরকারকে ক্ষমতায় দেখতে। তাই অবৈধভাবে ক্ষমতায় থাকার জন্য তারা শেষ সময়ের চেষ্টা চালাচ্ছেন। কিন্তু এসব করে জালেম আওয়ামী লীগ সরকার আর ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে পারবে না। অর্থাৎ শিগগিরই গণ আন্দোলনের মুখে তারা বিদায় নেবে। মানুষ এখন এমন প্রত্যাশাই করছে।

 

দলের কেন্দ্রীয় দফতর সূত্রে জানা গেছে, ১৮ ও ১৯ জুলাই পদযাত্রা কর্মসূচিতে একজন নিহতসহ ৩ হাজারের বেশি নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন। এর মধ্যে গুলিবিদ্ধ  হয়েছেন ২ হাজারের বেশি। সাত জেলায় ২১টি মামলায় ৮ হাজার নেতা-কর্মীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। আর আসামি করা হয়েছে ২০ হাজার নেতা-কর্মীকে। এর মধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে শতাধিক। দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব ও দফতর সম্পাদক রুহুল কবির রিজভী আহমেদ জানিয়েছেন, বিএনপির কেন্দ্রঘোষিত জনসমাবেশসহ নানা কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সারা দেশে সাড়ে ৩ শতাধিক মামলা দায়ের করা হয়েছে নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে দেড় হাজার। এসব মামলায় ১৫ হাজারেরও বেশি নেতা-কর্মীর নাম উল্লেখ করে আসামি করা হয়েছে। আর বেনামে আসামি করা হয়েছে এর দ্বিগুণ নেতা-কর্মীকে। কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুস সালাম আজাদ অভিযোগ করে বলেন, বিএনপির অনেক নেতা-কর্মীকে মামলা দেওয়ার আগেই বাড়িঘর কিংবা রাস্তাঘাট থেকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। এমনকি রাজধানী ঢাকা থেকেও তুলে নেওয়া হচ্ছে তাদের। গত দুই দিনে বগুড়া জেলা বিএনপির সেক্রেটারি, স্বেচ্ছাসেবক দলের একজন কেন্দ্রীয় নেতাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে শতাধিক নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ঢাকার উত্তরা থেকে কবির আহমেদ ভূঁইয়া নামের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা বিএনপির একজন নেতাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর এখনো পর্যন্ত স্বীকার করছে না পুলিশ। লক্ষ্মীপুরে পদযাত্রা চলাকালে কৃষক দল নেতা সজীব হোসেনকে পেছন থেকে চোরাগোপ্তাভাবে টেনে নিয়ে লক্ষ্মীপুর সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি মহসিন কবির সাগর ও সেবাব নেওয়াজের নেতৃত্বে কুপিয়ে, গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। লক্ষ্মীপুরের সে পদযাত্রা কর্মসূচিতে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন অর্ধশতাধিক, আর মামলা দেওয়া হয়েছে বিএনপির ২ হাজার নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে।

দলের স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেন, জাতীয় নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে বিএনপি নেতা-কর্মীদের ওপর গ্রেফতার-নির্যাতনের খড়গ ততই বাড়ছে। আওয়ামী লীগ চায় এভাবে মামলা-হামলা, গ্রেফতার-নির্যাতন আর সাজানো রায় ঘোষণা করে বিএনপিকে ছাড়াই একতরফাভাবে জাতীয় নির্বাচন করে আবারও সরকার গঠন করতে। বাংলাদেশের জনগণ এসব অত্যাচার-নির্যাতন আর মেনে নেবে না। তারা এখন ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। আর আমরাও কৌশল খুঁজছি কীভাবে এসব অন্যায়-অবিচার বন্ধ করা যায়। জানা গেছে, বিএনপি তাদের নেতা-কর্মীদের ওপর অন্যায় আচরণকারী পুলিশ সদস্যদের নামের তালিকা তৈরি করছে। পাশাপাশি এবার যারা সরকারের পক্ষে অতি-উৎসাহী হয়ে বিএনপি নেতা-কর্মীদের ওপর জুলুম-নির্যাতন বা হয়রানি করবেন, তাদের নামের পাশাপাশি তাদের স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবারের সদস্যদেরও নামের তালিকা তৈরি করার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে হয়তো এসব জুলুমবাজ পুলিশ কর্মকর্তা কিছুটা হলেও ভুক্তভোগীদের কষ্টটা অনুধাবন করতে পারবেন। জানা গেছে, গত তিন দিনে দেশের সাত জেলায় হামলা, সংঘর্ষ ও ভাঙচুরের ঘটনায় ৮ হাজার নেতা-কর্মীকে আসামি করে ২১টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা, বগুড়া, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, খাগড়াছড়ি, কিশোরগঞ্জ ও জয়পুরহাট উল্লেখযোগ্য। ঢাকায় মিরপুরে সরকারি বাংলা কলেজে পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনায় বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের ১৮৮ জন নেতা-কর্মীর নাম উল্লেখ করে মঙ্গলবার দারুস সালাম থানায় দুটি মামলা করা হয়েছে। মামলা দুটিতে জ্ঞাত ও অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে ১ হাজার ২০০ জনকে। ওই রাতেই পুলিশ মিরপুরের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে এজাহারভুক্ত ১৮ জনকে গ্রেফতার করেছে। বুধবার তাদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। আসামিদের বিরুদ্ধে মারধর, ভাঙচুর ও পোড়ানোর অভিযোগ আনা হয়েছে। এজাহারে দেখা যায়, আসামিরা দারুস সালাম, শাহ আলী, মিরপুর, পল্লবী, রূপনগর, মিরপুর, কাফরুল থানা এবং ওয়ার্ড কমিটির বিএনপি, শ্রমিক দল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মী।

 

দারুস সালাম থানায় একটি মামলার বাদী করা হয়েছে সরকারি বাংলা কলেজের অফিস সহকারী মাহিদুর রহমানকে। অথচ তিনি বলেছেন, ঘটনার সময় তিনি অফিসে ছিলেন। কারা, কেন ভিতরে ঢুকেছে তা তিনি জানেন না। তিনি বলেন, ‘হামলাকারীদের সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। আমাকে কেউ মারধর কিংবা কোনো হুমকি-ধমকি দেয়নি। মামলা কে বা কারা লিখেছেন তাও আমি জানি না। কাদের আসামি করা হয়েছে তাও জানি না। প্রিন্সিপাল স্যার বলেছেন, আমাকে থানায় গিয়ে সই দিয়ে আসতে। সেভাবে মঙ্গলবার রাতে আমি থানায় গিয়ে সই দিয়ে এসেছি।’ অপর মামলার বাদী রুবেল হোসেন সরকারি বাংলা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের নেতা। তিনি থাকেন কলেজের পাশে প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম হলে।

 

বগুড়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় জেলা বিএনপির সভাপতি রেজাউল করিম বাদশা, সাধারণ সম্পাদক আলী আজগর তালুকদারসহ দলটির ২১১ নেতা-কর্মীর নামে পৃথক চারটি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় অনেককে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে। বগুড়া সদর থানায় তিনটি ও দুপচাঁচিয়া থানায় একটি মামলা হয়। দুটি মামলায় সাতজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। লক্ষ্মীপুরে বিএনপির সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনায় চারটি মামলা হয়েছে। দুটি মামলায় বিএনপির কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানিকে প্রধান আসামি করে ৫৫ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এসব মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামি ৩ হাজার ৫০০ জন।

 

একইভাবে ফনীতে দুটি মামলায় বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের ৮৮ জন নেতা-কর্মীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া আসামি করা হয়েছে ২ হাজার ব্যক্তিকে। খাগড়াছড়িতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় ১৫৭ জনকে আসামি করে একটি মামলা করেছেন সদর থানার এসআই মামুন হোসেন। মামলায় ১৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কিশোরগঞ্জে বিএনপির পদযাত্রা থেকে পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে মামলা হয়েছে। গতকাল সদর মডেল থানার এসআই ফজলুর রহমান বাদী হয়ে ১৯ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা ৬০ থেকে ৭০ জনকে আসামি করে মামলাটি করেন। জয়পুরহাটে দুটি মামলায় বিএনপির ৮২ নেতা-কর্মীর নাম উল্লেখ করে মামলা হয়েছে। এসব মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে ৫০০ জনকে। খুলনায় পুলিশের কাজে বাধা, হামলা, গাড়ি ভাঙচুরের অভিযোগে বিএনপি, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের ১৪ জনের নাম উল্লেখ করে ৮০ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করেছে পুলিশ। জয়পুরহাটে সদর থানার এসআই রুবেল হোসেন বাদী হয়ে ৮১ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে আসামি করে একটি মামলা করেছেন। অপর একটি মামলায় ১১৬ জনের নাম উল্লেখ এবং ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে অজ্ঞাত দেখিয়েছেন জয়পুরহাট থানার ওসি হুমায়ুন কবির। এসব মামলায় আবু হেনা মো. মোফাখ্খারুল ইসলাম ও নূর মোহাম্মদ সরদার নামে বিএনপির দুজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।খাগড়াছড়িতে ১৫৭ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরও ৭০০ থেকে ৮০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এ মামলায় এখন পর্যন্ত ১৫ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। পিরোজপুরে ৮০ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত আরও ৩০০ জনের বিরুদ্ধে সদর থানার এসআই মাকসুদুর রহমান মামলা করেছেন। পুলিশ এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত জড়িত ১৫ জনকে আটক করেছে।