একদিকে গ্রেফতার ও মামলা-হামলা, অন্যদিকে দলীয় পদ হারানোর ভয়-এই দ্বিমুখী আতঙ্কে রয়েছেন বিএনপি নেতারা। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত এখন সেই দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন তারা। দলের নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।
দলীয় নেতারা জানিয়েছেন, নতুন করে মামলা দায়েরের পাশাপাশি পুরনো মামলাগুলোর কার্যক্রম দ্রুত এগিয়ে নিতে শুরু করেছে সরকার। আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগেই রাজনৈতিক মামলায় দন্ডাদেশ প্রদানের মাধ্যমে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীদের অযোগ্য ঘোষণার ব্যবস্থা করতেই এই উদ্যোগ বলে অভিযোগ তাদের। ঢাকাসহ জেলা-উপজেলা পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা কয়েক শ মামলা এখন রায় ঘোষণার অপেক্ষায়। ফলে নেতাদের মধ্যে যেমন নতুন করে মামলা আতঙ্ক শুরু হয়েছে, তেমনি দলের ভিতরে অব্যাহতি, বহিষ্কার, কমিটি থেকে বাদ পড়া, কেন্দ্র থেকে শোকজ নোটিস প্রদানের চলমান ঘটনায় বিএনপি নেতাদের এখন রীতিমতো ঘুম হারাম হয়ে গেছে। বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, কেন্দ্রীয় নেতাসহ সারা দেশে দল ও অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীদের নামে সম্প্রতি নতুন করে মামলা দেওয়া হচ্ছে। জেলা পর্যায়ের সাম্প্রতিক সমাবেশ চলাকালীনসহ গত দেড় মাসে ১৮ জেলায় মামলা হয়েছে শতাধিক। কেন্দ্রীয় দফতরের হিসাব অনুযায়ী দেশব্যাপী মামলার আসামি হিসেবে বর্তমানে বিএনপি নেতা-কর্মীর সংখ্যা ৩৬ লাখেরও বেশি। এর মধ্যে গত কয়েক মাসে ৩২টি জেলা/উপজেলায় দায়ের করা শতাধিক মামলায় জ্ঞাত ও অজ্ঞাত আসামির সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে ১ লাখেরও বেশি। বেশির ভাগ মামলাই হয়েছে ভাঙচুর, ককটেল বিস্ফোরণ, মন্দির ও মূর্তি ভাঙচুর, নাশকতা, সরকারি কাজে বাধা প্রদান, অগ্নিসংযোগ ও হত্যাকান্ডের অভিযোগে। এসব মামলার কার্যক্রম সম্প্রতি দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। মাত্র চার দিন আগে রাজধানীর একটি আদালতে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের এক মামলায় বিএনপির ১০ জন নেতা-কর্মীকে পাঁচ বছর করে সশ্রম কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, যে কোনো ইস্যুতেই বিএনপি নেতা-কর্মীদের নামে সরকার মামলা করছে, হামলা চালাচ্ছে। সভা-সমাবেশ বানচাল করে দিচ্ছে। বিএনপিকে নেতৃত্বশূন্য করতেই সরকারের এ উদ্যোগ। এসব মূলত সরকারের স্বেচ্ছাচারিতা এবং স্বৈরতন্ত্রের বহিঃপ্রকাশ।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন এ বিষয়ে বলেন, সরকার বিএনপিকে ধ্বংস করার জন্য যা কিছু করা দরকার, তার সবকিছুই করছে। কিন্তু এসব নিয়ে আমরা মোটেও চিন্তিত নই। কারণ জেল খাটার অভিজ্ঞতা আমাদের আছে, আমাদের আর জেলের ভয় দেখিয়ে কোনো লাভ নেই। এ সরকারের সময় ঘনিয়ে এসেছে। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, মাস দুয়েক আগেও দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নামে সর্বশেষ গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে আদালত। দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদের বিরুদ্ধে প্রতি মাসেই দেশের কোথাও না কোথাও থেকে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হচ্ছে। এ ছাড়া দলের মহাসচিব ও স্থায়ী কমিটির সদস্যদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলাগুলোতেও একের পর এক চার্জশিট প্রদানসহ গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হচ্ছে।
বিএনপির ৩৫ লাখ নেতা-কর্মী আসামি : গত ১২ বছরে বিএনপির ৩৬ লাখ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার। পুলিশ, আদালত ও বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ থেকে গত বছরের জুলাই মাস পর্যন্ত ৩৫ লাখ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ১ লাখ ৭ হাজার। বেশির ভাগ মামলা হয়েছে ২০১৩ এবং ২০১৫ সালে সংসদ নির্বাচনের আগে ও পরে। মামলা হয়েছে কেন্দ্র, জেলা, উপজেলা ও গ্রাম পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের নামেও। ভাঙচুর, ককটেল বিস্ফোরণ, অগ্নিসংযোগ ও হত্যাকান্ডের অভিযোগে এসব মামলা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, কারারুদ্ধ বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৩৭টি। এর মধ্যে দুটি মামলায় তাঁর সাজা হয়েছে। উচ্চ আদালতে ১৬টি মামলার কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। তার বিরুদ্ধে মূলত মামলা হয়েছে দুর্নীতি, মানহানি, রাষ্ট্রদ্রোহসহ হত্যা, অগ্নিসংযোগ ও নাশকতার অভিযোগে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগে মামলা হয়েছে ৬৭টি। তিনি বর্তমানে লন্ডনে নির্বাসিত জীবন-যাপন করছেন। এ ছাড়াও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৮৭টি। স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ১৬টি। এ ছাড়াও ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকারের নামে ৪টি, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়ার নামে ৬টি, মির্জা আব্বাসের নামে ৫৪টি, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের নামে ৫৯টি, নজরুল ইসলাম খানের নামে ৫টি, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর নামে ১৩টি, সেলিমা রহমানের নামে ৬টি, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর নামে ৯টি, ভারতের শিলংয়ে অবস্থানরত সালাউদ্দিন আহমেদের নামে ১৭টি, রুহুল কবির রিজভী আহমেদের নামে ১৩৪টি মামলা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে দলটির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন নবী খান সোহেলের বিরুদ্ধে ২৫৭টি। ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদের নামে ৭টি, ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমরের নামে ৪টি, আলতাফ হোসেন চৌধুরীর নামে ৬টি, শওকত মাহমুদের ৬০টি, আবদুল্লাহ আল নোমানের নামে ৪টি, বরকতউল্লাহ বুলুর নামে ৩৭টি, আবদুল আউয়াল মিন্টুর নামে ৬টি, মোহাম্মদ শাহজাহানের নামে ২৮টি, অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেনের নামে ২৪টি, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমানের নামে ১২৩টি, আবদুস সালামের ৩৭টি, মিজানুর রহমান মিনুর নামে ৩৭টি, জয়নুল আবদিন ফারুকের নামে ২৩টি, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনের নামে ১৩টি, মজিবর রহমান সরোয়ারের নামে ৫৭টি, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের নামে ১৩৪টি এবং খায়রুল কবির খোকনের নামে ৫৭টি মামলা আছে। এ ছাড়া আরও অনেক কেন্দ্রীয় নেতার নামে মামলা হয়েছে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নাটোর, বড়াইগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ বিভিন্ন জেলায় দলীয় নেতা-কর্মীর নামে অর্ধশতাধিক মামলা দায়ের করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান এ বিষয়ে বলেন, আমাদের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা নতুন কিছু নয়। আমরা ঘরে বসে থাকলেও মামলা দেয়। সরকারের পতন ঘটিয়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা হবে।
পদ হারানোর আতঙ্কে নেতারা : এখন দলীয় পদ হারানোর আতঙ্কে ভুগছেন বিএনপি নেতারা। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত এ আতঙ্ক রয়েছে। দল থেকে অব্যাহতি, বহিষ্কার ছাড়াও অনেকে বাদ পড়ছেন কমিটি থেকে। আবার কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে নানা কারণে দেওয়া হচ্ছে শোকজ নোটিস। এ নিয়ে নারায়ণগঞ্জ, নোয়াখালী, নাটোর, বরিশাল ও রাজশাহীসহ বিভিন্ন জেলায় চলছে ক্ষোভ-বিক্ষোভ। সবকিছুই হচ্ছে দলের হাইকমান্ডের নির্দেশে। কেন্দ্র থেকে মহানগর, জেলা, উপজেলা হয়ে পৌরসভা ও ইউনিয়ন পর্যন্ত নানাভাবে চলছে এই ছাঁটাই অভিযান। কেন্দ্রীয় কোনো কোনো নেতা এটাকে দল পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে দাবি করলেও কেন্দ্র করে তৃণমূল পর্যন্ত এ নিয়ে অভ্যন্তরীণ বিরোধ-কোন্দলও মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। দীর্ঘদিন মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয় থাকার পর হঠাৎ করেই তাদের সরিয়ে দেওয়ার ফলে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লাহ বুলু এ সম্পর্কে বলেন, বিএনপিতে একমাত্র জিয়াউর রহমানের পরিবারই অপরিহার্য। বেগম খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। এর বাইরে আমরা যে যত বড় নেতাই হই না কেন- কেউই অপরিহার্য নয়। দলের হাইকমান্ডের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কোনো কাজ করা সাংগঠনিক অপরাধ। শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে দলের স্বার্থে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি অপরিহার্য। দলের নীতি-নির্ধারণী মহলের সদস্যরা এ উদ্যোগকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে নিলেও নেতা-কর্মীদের বহিষ্কার, পদ থেকে অব্যাহতি ও স্বেচ্ছায় পদত্যাগের ঘটনা এসব নিয়ে দলের ভিতর এক ধরনের আতঙ্ক ও অস্থিরতা দেখা দিচ্ছে। বিশেষ করে কমিটি পুনর্গঠন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত নেতাদের ছাঁটাই করা হচ্ছে দল থেকে। পরীক্ষিত নেতা-কর্মীদের দল থেকে বাদ দেওয়ায় তৃণমূলে ক্ষোভ ও হতাশা বাড়ছে। এক্ষেত্রে তৃণমূল নেতারা দলের (কেন্দ্রীয়) সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতাকেই দায়ী করছেন। তারা বলছেন, শীর্ষস্থানীয় নেতারা সময়মতো দলের কাউন্সিল অধিবেশনের আয়োজন না করায় আজ এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সিনিয়র নেতারা এলাকায় নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতে এবং ব্যক্তিগত ও পারিবারিক স্বার্থে নিয়মিত কাউন্সিল অনুষ্ঠানে বাধার সৃষ্টি করছেন। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ এ প্রসঙ্গে বলেন, একটি দল তো ফ্রি স্টাইলে চলতে পারে না। এখানে শৃঙ্খলা রাখতেই হবে। কেউ শৃঙ্খলা না মানলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।