ঢাকা, রবিবার ৫ মে ২০২৪, ২২শে বৈশাখ ১৪৩১
বিএনপির নতুন ভীতি

নেতাকর্মীদের বাসা-বাড়িতে মুখ ঢেকে হঠাৎ 'রহস্যজনক' হামলা

নিজস্ব প্রতিবেদক : | প্রকাশের সময় : বৃহস্পতিবার ২৩ নভেম্বর ২০২৩ ০১:৪৩:০০ অপরাহ্ন | রাজনীতি

বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর চলমান আন্দোলনের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে। প্রায় প্রতিদিন নাশকতার অভিযোগে বিরোধী নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এই অভিযানের মুখে বাড়িছাড়া নেতাকর্মীরা। এমন পরিস্থিতিতে নতুন করে যুক্ত হয়েছে হেলমেটধারী অজ্ঞাত দুর্বৃত্তদের অতর্কিত হামলা, ভাঙচুর। এসব ঘটনায় লুটপাটের অভিযোগও রয়েছে।

 

গতকাল পর্যন্ত কয়েক দিনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আরিফুল হক ও যশোরে বিএনপির খুলনা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিতের বাসায় ককটেল হামলা হয়। নওগাঁয় হামলায় নিহত হয়েছেন বিএনপির এক নেতা। এ ছাড়া নাটোর ও রাজশাহী অঞ্চলের বিএনপি ও জামায়াতের কয়েকজন নেতাকর্মীকে তুলে নিয়ে হাতুড়িপেটা, কুপিয়ে আহত করার ঘটনা ঘটেছে। নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, নোয়াখালীসহ আরও কয়েকটি স্থানে বিএনপি নেতাকর্মীদের বাসায় হামলার ঘটনা ঘটেছে। ওই সব এলাকায় অনেকে বাড়িছাড়া বলে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে।

 

বিএনপির দায়িত্বশীল নেতাদের দাবি, সরকার আন্দোলনে ভীত হয়ে তাদের দলের নেতাকর্মীদের নামিয়ে দিয়েছে সারা দেশে বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর হামলা করতে। হেলমেট পরে যে দুর্বৃত্তরা হামলা করছে তাদের দেশের জনগণ চেনে। তারা মনে করেন, এভাবে হামলা করে আন্দোলন-সংগ্রামে অংশগ্রহণরত নেতাকর্মীদের মনোবল দুর্বল করা যাবে না।

 

বিএনপির নেতাকর্মীদের বাসাবাড়িতে হেলমেটধারী ও মুখে গামছা বাঁধা দুর্বৃত্তদের হামলা, ভাঙচুরের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা দল বেঁধে বিএনপির নেতাকর্মীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভাঙচুর, লুটপাট করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নেতাদের না পেয়ে স্বজনদের গ্রেপ্তার করছে। এখন যুক্ত হয়েছে জ্যেষ্ঠ নেতাদের বাসা-বাড়িতে ককটেলের বিস্ফোরণ। আসলে সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে ভীত হয়ে এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে।’

 

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। এরই মধ্যে গত মঙ্গলবার সকালে শাহজাহানপুরে তার বাসভবন লক্ষ্য করে দুটি ককটেল ছোড়ে দুর্বৃত্তরা। এ বিষয়ে তার স্ত্রী আফরোজা আব্বাস অভিযোগ করে সাংবাদিকদের বলেন, ‘দুই মোটরসাইকেল আরোহী আমাদের বাসভবন লক্ষ্য করে দুটি ককটেল ছুড়ে মেরেছে। সকাল ৮টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। বিস্ফোরণে আমাদের পুরো বাড়ি ধোঁয়ায় ঢেকে যায়।’ তিনি বলেন, কিছুক্ষণ পর বাড়ির নিরাপত্তাকর্মীরা হামলাকারীদের ধরতে গেলে তারা মোটরসাইকেলে করে পালিয়ে যায়। নিরাপত্তাকর্মীরা বাসার সামনে পুলিশের পোশাক পরা ছয় থেকে আট জনসহ তিন-চারটি মোটরসাইকেল দেখতে পান। আফরোজা আব্বাস দাবি করেন, পুলিশ হামলাকারীদের চলে যেতে সাহায্য করেছে।

 

একই দিন রাতে সিলেট নগরের কুমারপাড়া এলাকায় সাবেক মেয়র আরিফুল হকের বাসভবনের প্রধান ফটকের দিকে দুটি ও ফটকের সামনে একটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটায় দুর্বৃত্তরা। দুজনের সঙ্গে থাকা অপর ব্যক্তি ককটেল বিস্ফোরণের দৃশ্য মোবাইল ফোনে ভিডিও করে। পরে তারা দ্রুত পালিয়ে যায়। হামলার বিষয়ে সমর্থকেরা দাবি করেছেন, হরতাল সফলের আহ্বান জানিয়ে গত শনিবার আরিফুলের নেতৃত্বে সিলেট নগরে বিশাল মিছিল হয়। সরকারবিরোধী আন্দোলনে তার সক্রিয়তা দেখে উদ্দেশ্যমূলকভাবে আওয়ামী লীগের ইন্ধনে এই ককটেল বিস্ফোরণ করা হয়েছে। পরে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা নিয়ে আরিফুল হক চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ‘কারা এ ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন, তা প্রাথমিকভাবে বলতে পারছি না। তবে সিসিটিভির ফুটেজে তাদের কর্মকা- ধরা পড়েছে। নিশ্চয়ই এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিরা শনাক্ত হবেন। তবে কোনো ধরনের ভয়ভীতি দেখিয়ে আমাকে দমানো যাবে না।’

 

এর আগে ১৮ নভেম্বর শনিবার রাত সোয়া ৯টার দিকে নওগাঁ-সান্তাহার সড়কের ইয়াদ আলীর মোড় এলাকায় নওগাঁ পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য কামাল আহমেদকে বহনকারী অটোরিকশার গতি রোধে হামলা করে হেলমেট ও মাস্ক পরা দুর্বৃত্তরা। হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক কামাল আহমেদকে মৃত ঘোষণা করেন। পরের দিন রবিবার সকালে কামালের ছেলে নবাব আলী বাদী হয়ে নওগাঁ সদর থানায় মামলাটি করেন। মামলায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

 

হামলার ঘটনার বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, অতীতে হেলমেট পরে কারা আন্দোলনে হামলা করেছে তা দেশবাসী দেখেছে। এখন যে হামলা হচ্ছে সেটা কারা করছে, তাও মানুষ জানে।

 

বিএনপির সিনিয়ন যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘সরকার পুলিশ-র‌্যাবের পাশাপাশি হেলমেট বাহিনী নামিয়েছে। সরকারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় নেতা-কর্মীদের বেছে বেছে তাদের বাড়িতে হেলমেট বাহিনী হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালাচ্ছে। গুপ্ত হামলা, বোমা হামলা চালাচ্ছে। অন্যদিকে গণতন্ত্রপন্থিদের ধরে নির্যাতন করে পুলিশে দিচ্ছে।’

 

তিনি দাবি করেন, এসব হেলমেট বাহিনীর কেউ কেউ আবার আটক বাণিজ্য করছে। লুটপাট চালাচ্ছে নেতাকর্মীদের বাড়িতে।

 

সারা দেশে বিভিন্ন স্থানে নেতাকর্মীদের বাসা-বাড়িতে হামলার বিষয়ে প্রতিদিনই রুহুল কবির রিজভী ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করে আসছেন। গত মঙ্গলবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ফরিদপুরের ধানশালিক ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি শাহাবুদ্দিনকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মারধর করে রক্তাক্ত অবস্থায় পুলিশে দিয়েছে। যশোরের কেশবপুর উপজেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক আজিজুর রহমান আজিজকে না পেয়ে বড় ভাই শিমুল হাসানকে তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মারধর করে এবং তার গচ্ছিত অর্থ ছিনিয়ে নেয়। ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালী ইউনিয়ন যুবদলের নেতা নয়ন হোসেনের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা যৌথভাবে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে তছনছ করে। খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক মহিন, ইউনিয়ন স্বেচছাসেবক দলের যুগ্ম সম্পাদক রবিউল ইসলাম ও মেরুং ইউনিয়ন যুবদলের সদস্য সচিব আব্দুস সালামের বাসায় গত সোমবার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বর্বরোচিত হামলা চালিয়ে তাদের বাড়ি-ঘরের আসবাব ভাঙচুর, টাকা ও স্বর্ণালংকার লুট এবং তাদের কুপিয়ে মারাত্মকভাবে আহত করে চলে যায়।

 

জ্যেষ্ঠ নেতাদের বাসা-বাড়িতে হামলার বিষয়ে বিএনপির স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচনে নিতে না পেরে একদিকে অতীতে দায়ের করা বিভিন্ন মামলায় নেতাকর্মীদের সাজা দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি আন্দোলন সংগ্রাম থেকে বিরত রাখতে এ ধরনের হামলার ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। এর পেছনে সরকারের ইন্ধন রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে তৃণমূল নেতাকর্মীরা এসব হামলা করছে। এসব করে সরকার পার পাবে না; বরং আন্দোলন আরও বাড়বে।’