তৈরি পোশাক শিল্প দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত। এ খাতে গত বছর রপ্তানি ৪৭.৩৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। তবে সম্প্রতি তৈরি পোশাকসহ রপ্তানি পণ্যের ওপর সরকারি নগদ প্রণোদনা ধীরে ধীরে কমিয়ে আনার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। দেশের রপ্তানিমুখী শিল্পগুলোর ওপর এই সিদ্ধান্তের কতটা প্রভাব পড়বে তা নিয়ে তুমুল আলোচনা শুরু হয়েছে।
গত ৩০ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই সার্কুলারে জানানো হয়, ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে মোট ৪৩টি খাতে রপ্তানির বিপরীতে প্রণোদনা দিয়ে থাকে সরকার। তৈরি পোশাক খাত ছাড়াও পাটজাত দ্রব্য রপ্তানি খাত, চামড়াজাত দ্রব্য, হাতে তৈরি পণ্য, হিমায়িত চিংড়ি, নানা ধরনের কৃষিপণ্য, হাল্কা প্রকৌশল পণ্য, ফার্মাসিউটিক্যালস পণ্য, হিমায়িত পণ্য, রাসায়নিক পণ্য ইত্যাদি এর আওতায় রয়েছে। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে অল্প অল্প করে এই প্রণোদনা কমিয়ে আনা হবে।
এতে বলা হয়েছে, ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ ঘটতে যাচ্ছে। উত্তরণ পরবর্তী সময়ে রপ্তানি প্রণোদনা একবারে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাহার করা হলে রপ্তানি খাত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। সেই বিবেচনায় অল্প অল্প করে কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে যাবে। আর বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী, কোনো দেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে গেলে তারা রপ্তানি প্রণোদনা দিতে পারে না। এটাকেই প্রণোদনা তুলে নেওয়ার কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে।
বর্তমানে নিট, ওভেন ও সোয়েটার খাতের সব ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য অতিরিক্ত ৪ শতাংশ, শুল্ক বন্ড ও ডিউটি ড্র-ব্যাক-এর পরিবর্তে ৩ শতাংশ, নতুন পণ্য বা বাজার সম্প্রসারণ সহায়তা হিসেবে ৩ শতাংশ, ইউরো অঞ্চলে বস্ত্র খাতের রপ্তানিকারকদের জন্য অতিরিক্ত ১ শতাংশ ও তৈরি পোশাক খাতে ০.৫০ শতাংশ হারে বিশেষ নগদ সহায়তা দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে তৈরি পোশাক খাতে সব বাজারে সব পণ্যের ক্ষেত্রে সাধারণভাবে ১ শতাংশ হারে প্রণোদনা দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে তৈরি পোশাক শিল্পের মালিকরা বলছেন, বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্যের খাতে এমন সিদ্ধান্তের ব্যাপক প্রভাব পড়তে পারে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের ওপর। বিকল্প বাজার তৈরির সম্ভাবনাও হারানোর শঙ্কা রয়েছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যেহেতু ধীরে ধীরে সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হবে, তাই প্রণোদনা তুলে নেওয়ার বিষয়টি খুব বেশি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না। একই সঙ্গে ব্যবসায়ীদের প্রণোদনানির্ভর কাঠামো থেকে বেরিয়ে এসে উৎপাদনশীলতা ও দক্ষতানির্ভর বাজারের দিকে ঝুঁকতে হবে।
বড় ক্ষতির শঙ্কা উদ্যোক্তাদের
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ এর জুলাই-ডিসেম্বর মাসে ইউরোপীয় ইউনিয়নে বাংলাদেশের বৃহত্তম রপ্তানি বাজার জার্মানিতে ২০২২-২৩ জুলাই-ডিসেম্বরের তুলনায় ১৭.০৫ শতাংশ, ইউরোপীয় ইউনিয়নে ১.২৪ শতাংশ, আমেরিকায় ৫.৬৯ শতাংশ এবং কানাডায় ৪.১৬ শতাংশ রপ্তানি কমেছে।
গার্মেন্টস মালিকদের প্রতিষ্ঠান বিজিএমইয়ের পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, বিগত যেকোনো সময়ের তুলনায় বর্তমান সময়ে রপ্তানি খাতে সবচেয়ে বেশি টানাপড়েন চলছে। রপ্তানির পরিমাণ বাড়লেও মুনাফা সেই হিসেবে বাড়ছে না। মন্দার কারণে কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় সবকিছুর উৎপাদন মূল্য বেড়ে গেছে। সেই হিসেবে রপ্তানির মূল্য বেড়ে গেছে। এক্সপোর্টের ভ্যালু (মূল্য) বেড়ে যাওয়া মানেই কিন্তু মালিকরা সেই টাকাটা পায় না। মালিকরা সিএম বা চুক্তি অনুযায়ী দাম পায়। এসব বিভিন্ন কারণে আয় এখন আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে, সেই সঙ্গে বাজারে এখন পর্যাপ্ত অর্ডার নেই।
তিনি বলেন, ভ্যালুর কারণে রপ্তানির পরিমাণ বাড়ছে। অর্ডার কিন্তু শর্টেজ, ক্যাপাসিটি কিন্তু খালি যাচ্ছে, কথা কিন্তু সত্যি।
তিনি আরও বলেন, গত কয়েক বছরে সব ধরনের জ্বালানির দাম কয়েক গুণ করে বেড়েছে। এমন অবস্থায় প্রণোদনাটা বাড়বে বলে তারা আশা করছিলেন। কিন্তু বাস্তবে তার উল্টো হচ্ছে। কমিয়ে দেওয়ার যৌক্তিকতা নীতি-নির্ধারকরা ভালো বলতে পারবেন। কিন্তু আমরা আসলে দিনের শেষে যে কয়টা টাকা এক্সট্রা পেতাম, সেটা দিয়ে হয়তো লোকসানটা কিছুটা কমিয়ে আনা হতো। সেটার গ্যাপ এখন আরও বাড়বে। তাই নিশ্চিতভাবেই ব্যবসায়ীদের দৃষ্টিকোণ থেকে তারা আরও বেশি ক্ষতির মুখে পড়বেন।
মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, বর্তমানে পোশাক শিল্পে বড় কোম্পানিগুলো তাদের কারখানা বা ইউনিট বাড়াচ্ছে। বড় মাপের বিনিয়োগ হচ্ছে। কিন্তু ছোট বা মাঝারি আকারে কোনো বিনিয়োগ হচ্ছে না। নতুন এই সিদ্ধান্তের পর এ ধরনের উদ্যোক্তা তৈরি হওয়ার হার আগের তুলনায় আরও কমবে। নতুন বিনিয়োগের ওপর প্রভাব পড়বে, লোকসানের পরিমাণ বাড়বে, দীর্ঘমেয়াদি গার্মেন্টস বন্ধের সংখ্যাও বাড়তে পারে।
বিজিএমইয়ের পরিচালক বলেন, বর্তমান প্রবৃদ্ধিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছিল নতুন বাজার বা অপ্রচলিত বাজার। কারণ, আমেরিকা ও ইউরোপের বাজার মন্থর হয়ে গিয়েছিল। প্রধান অপ্রচলিত বাজারগুলোর মধ্যে জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়াতে রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে, ভারতে পোশাক রপ্তানি কমেছে।
তিনি বলেন, ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়াতে নতুন বাজার গড়ে উঠেছিল। ভারতের বাজারে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা ভালো করছিল এবং এ কারণেই এই বাজারের প্রতি ব্যবসায়ীদের আগ্রহও বাড়ছিল। এই সার্কুলারে অপ্রচলিত বাজার থেকে প্রণোদনা বাদ দিয়ে দিয়েছে। তাতে যেটা হবে, যারা ওইখানে কনসেনট্রেট করছিল বিকল্প মার্কেটে। আমরা সবসময় বলি না, বিকল্প মার্কেট, বিকল্প প্রডাক্টে যাও, সেই ইনস্পিরেশন বা অনুপ্রেরণাটা মালিকরা এখন লুজ করে ফেলবে।
তিনি মনে করেন, অপ্রচলিত বাজারে আর কোনো প্রণোদনা না থাকলে তার প্রভাব এই বাজারগুলো নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর পড়বে। পোশাক উৎপাদনকারীরা এখানে আর রপ্তানি করার উৎসাহটা পাবে না। কারণ, নতুন বাজারে রপ্তানি করলে তো একটা (নগদ প্রণোদনা) পেত।
পোশাক খাত নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করছেন অর্থনীতিবিদ খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, এই পদক্ষেপ অবধারিত ছিল। প্রণোদনা যেহেতু ভর্তুকির একটি অংশ, তাই বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার এ বিষয়ে একটি নিয়ম রয়েছে। আর তা হচ্ছে কোনো পণ্যের ক্ষেত্রে ২ শতাংশের বেশি ভর্তুকি দেওয়া যাবে না। সেই বিবেচনায় অধিকাংশ পণ্যের ক্ষেত্রে যে হারে প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে তা আসলে কমিয়ে আনতে হবে।
তিনি বলেন, স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এটা আসলে একটা নীতিগত বাধ্যবাধকতা। এটা মানতেই হবে।
‘সরকারি এই সিদ্ধান্ত এই শিল্পের ওপর আসলে তেমন কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না’ জানিয়ে তিনি বলেন, প্রথমত গার্মেন্টস খাত দীর্ঘদিন ধরে এই সুবিধা পেয়ে আসছে। তাই এই প্রণোদনা যে তাদের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়াতে ভূমিকা রাখে তা বলার সুযোগ নাই। কারণ, এই খাত আর প্রাথমিক অবস্থায় নেই। এই প্রণোদনা হয়তো উদ্যোক্তার মুনাফায় কিছুটা বাড়তি সুবিধা দেয়।
তিনি বলেন, এই ধরনের ইনসেনটিভগুলো যদি প্রাপ্যতার যুক্তিতে ধরেন তাহলে অন্য অনেক ইমার্জিং সেক্টর রয়েছে তাদের বরঞ্চ এই ধরনের ইনসেনটিভগুলো পাবার কারণ রয়েছে, যেটা হয়তো গার্মেন্টসের নেই। সাধারণত কোনো খাত প্রাথমিক অবস্থায় থাকার সময়, প্রতিযোগিতার সক্ষমতায় চ্যালেঞ্জ থাকলে বা নতুন ক্রমবর্ধমান অবস্থায় থাকলে সেসব খাতকে উৎসাহিত করার জন্য একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত এই ধরনের প্রণোদনা দেওয়া হয়।
সেই বিবেচনায় গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, যে উদ্দেশ্যে এই খাতকে এই প্রণোদনা দেওয়া হয়, এটি না দিলেও এই খাত সেই উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারবে। তাই এই খাত থেকে এই প্রণোদনা প্রত্যাহারের যৌক্তিকতা আছে। তৈরি পোশাক খাতে এই প্রণোদনাগুলো নিয়ে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ রয়েছে। ব্যাংক থেকে এই প্রণোদনা আদায়ের ক্ষেত্রে এক ধরনের মধ্যস্বত্ত্বভোগী তৈরি হয়। তারা এই প্রণোদনার একটি অংশ রেখে দেয়। বাকিটা উদ্যোক্তারা পান। তবে সেটাও সময় মতো পান না, অনেক বছর পরে পান।
তিনি বলেন, এখান থেকে অনুমান করা যায় যে, এই ধরনের প্রণোদনা দেওয়ার ক্ষেত্রে যে ধরণের ‘ইমপ্যাক্ট’ বা ফল পাওয়ার যুক্তি দেখানো হয়, সেটা আসলে এই খাতে খুব একটা কাজ করছে না। আর প্রণোদনা পাওয়ার ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতা ও প্রক্রিয়াগত নানা চ্যালেঞ্জ থাকার কারণে এটা যে খুব ইম্প্যাক্টফুল, তা বলা যাবে না।
অর্থনীতিবিদ খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম আরও বলেন, এই প্রণোদনা যেহেতু ধাপে ধাপে প্রত্যাহার বা কমিয়ে আনা হবে, তাই এটির নেতিবাচক প্রভাবের শঙ্কা থাকলেও সেটি এড়ানো সম্ভব। প্রণোদনা কমিয়ে আনা ২০২৪ সাল থেকে শুরু হচ্ছে এবং ২০২৬ সাল পর্যন্ত সময় রয়েছে। তাই এই দুই বছরে যদি একটা সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা করে এগোনো যায় এবং এটি প্রত্যাহার করা হলে কী ধরনের চাপ পড়বে তা পর্যবেক্ষণ করা হয়, তাহলে চূড়ান্ত প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে সরকার কিছুটা পরিবর্তন আনার কথা ভাবতে পারবে বলে মনে করেন তিনি।
তিনি মনে করেন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য যে এক শতাংশ প্রণোদনার ব্যবস্থা রয়েছে, সেটি যত পরে গিয়ে প্রত্যাহার করা যায় তার ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে করে এই উদ্যোক্তারা কিছুটা সময় পান। এক্ষেত্রে সরকারের ঋণ সহায়তা, গ্রিন ফান্ডের সহায়তা এবং বিদেশি বিনিয়োগ কাজে লাগানো যেতে পারে।
সূত্র : বিবিসি