ঢাকা, রবিবার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১
বিবিসির সুরঞ্জনা তিওয়ারির প্রতিবেদন

বাংলাদেশসহ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য এক সতর্কবার্তা শ্রীলঙ্কা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : | প্রকাশের সময় : সোমবার ১৮ জুলাই ২০২২ ০৯:৫৫:০০ অপরাহ্ন | আন্তর্জাতিক

 

ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ এবং নজিরবিহীন অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে রয়েছে শ্রীলঙ্কা; যা দেশটিতে ব্যাপক প্রতিবাদ আন্দোলন উসকে দিয়েছে। সাধারণ জনগণের আন্দোলনের মুখে দেশ থেকে পালিয়ে পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন লঙ্কান প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রধান সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতি তৈরির ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশসহ এশিয়ার আরও কয়েকটি দেশ।

সোমবার ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির সুরঞ্জনা তিওয়ারির এক প্রতিবেদনে শ্রীলঙ্কা সংকটের মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার ঝুঁকিতে থাকা কয়েকটি দেশের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।

গত শনিবার আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েবা বলেন, যেসব দেশের ঋণের পরিমাণ বেশি ও সীমিত পরিসরের নীতিমালা রয়েছে, তাদের ওপর অতিরিক্ত চাপ তৈরি হবে। শ্রীলঙ্কার সংকট এসব দেশের জন্য সতর্ক সংকেত।

তিনি বলেন, উন্নয়নশীল দেশগুলোও চার মাস ধরে টেকসই মূলধনের বহিঃপ্রবাহের মুখোমুখি হয়েছে; যা তাদের উন্নত অর্থনীতির স্বপ্নকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে।

বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের কারণে ২ কোটি ২০ লাখ মানুষের জন্য খাদ্য, জ্বালানি এবং ওষুধের মতো গুরুত্বপূর্ণ আমদানি করতে পারছে না শ্রীলঙ্কা। এর ফলে দেশটিতে মূল্যস্ফীতি প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়েছে। এক বছর আগের তুলনায় খাদ্যের দাম ৮০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। চলতি বছর মার্কিন ডলার এবং অন্যান্য প্রধান বৈশ্বিক মুদ্রার বিপরীতে শ্রীলঙ্কার রুপির মূল্য হ্রাস পেয়েছে।

অনেকেই দেশটির চলমান এই পরিস্থিতির জন্য সাবেক প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসেকে দায়ী মনে করেন। তাদের মতে, রাজাপাকসের ভুল নীতির কারণে শ্রীলঙ্কায় বর্তমান সংকট তৈরি হয়েছে। আর এই সংকটের প্রভাব করোনাভাইরাস মহামারির কারণে আরও প্রবল হয়েছে।

বছরের পর বছর ধরে শ্রীলঙ্কা বিপুল পরিমাণ ঋণ করেছে। দুই দশকের মধ্যে এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রথম দেশ হিসেবে গত মাসে শ্রীলঙ্কা দেউলিয়া হয়েছে। দেশটির কর্মকর্তারা ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেলআউটের জন্য আইএমএফের সাথে আলোচনা করছেন। কিন্তু রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার কারণে এই আলোচনা আপাতত থমকে গেছে।

তবে ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি এবং সুদের হার বৃদ্ধি, মুদ্রার অবমূল্যায়ন, উচ্চমাত্রার ঋণ এবং বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ার মতো একই ধরনের বৈশ্বিক প্রতিকূলতা এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশের অর্থনীতিকে প্রভাবিত করতে পারে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

এই অঞ্চলের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অন্যতম প্রভাবশালী ঋণদাতা চীন। আর এসব দেশের ভাগ্যকে গুরুত্বপূর্ণ উপায়ে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে দেশটি। তবে বেইজিংয়ের ঋণ দেওয়ার শর্তগুলো কী অথবা কীভাবে ঋণ পুনর্গঠন করতে পারে তা পরিষ্কার নয়।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের অ্যালান কিনানের মতে, এতে চীনের দায় রয়েছে। দেশটি ব্যয়বহুল অবকাঠামো প্রকল্পকে উৎসাহ দিয়েছে এবং সমর্থন করছে। আর এসব প্রকল্প থেকে বড় ধরনের অর্থনৈতিক অর্জন আসছে না।

তিনি বলেন, ‘শ্রীলঙ্কার ক্ষমতাসীন রাজাপাকসে পরিবার এবং তার নীতির জন্য সক্রিয় রাজনৈতিক সমর্থন সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল... শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক পতনের মূলে রয়েছে এই রাজনৈতিক ব্যর্থতা। দেশটি যতক্ষণ পর্যন্ত সাংবিধানিক পরিবর্তন এবং অধিক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির দিকে অগ্রসর না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত শ্রীলঙ্কার বর্তমান দুঃস্বপ্ন থেকে রক্ষা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই।’

তবে উদ্বেগের বিষয় হলো অন্যান্য দেশও একই পথে রয়েছে বলে মনে হচ্ছে।

বাংলাদেশ

বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির হার গত মে মাসে ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ ছুঁয়েছে; যা গত ৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ায় অ-প্রয়োজনীয় আমদানি রোধে দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। বিদেশে বসবাসরত লাখ লাখ অভিবাসীর দেশে রেমিট্যান্স পাঠানোর বিধি-বিধান শিথিল করা হয়েছে। কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণে লাগাম টানা হয়েছে।

এসএন্ডপি গ্লোবাল রেটিংয়ের বিশ্লেষক কিম ইং তান বিবিসিকে বলেছেন, আমদানি আয় ও রপ্তানি ব্যয়ে অর্থনৈতিক ঘাটতিতে থাকা বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা সরকারকে ভর্তুকি বাড়াতে গুরুতর প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হবে। পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কা আর্থিক সহায়তার জন্য আইএমএফ এবং অন্যান্য দেশের সরকারের দ্বারস্থ হয়েছে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশকে সরকারি ব্যয়ের ক্ষেত্রে পুনরায় অগ্রাধিকার নির্ধারণ এবং ভোক্তা কার্যক্রমের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করতে হয়েছে।

ক্রমবর্ধমান খাদ্য এবং জ্বালানির দাম মহামারিতে বিপর্যস্ত বিশ্ব অর্থনীতিকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। এখন উন্নয়নশীল দেশগুলো— যারা বছরের পর বছর ধরে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়েছে, তারা নিজেদের নড়বড়ে অর্থনৈতিক ভিত্তি যে বৈশ্বিক টালমাটাল পরিস্থিতিতে বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ সেটি উপলব্ধি করছে।

লাওস

৭৫ লাখের বেশি মানুষের স্থলবেষ্টিত পূর্ব এশিয়ার দেশটি গত কয়েক মাস ধরে বিদেশি ঋণ খেলাপি হওয়ার ঝুঁকির মুখোমুখি হয়েছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের কারণে দেশটিতে তেলের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশটির জ্বালানির সরবরাহের ওপর চাপ তৈরি হয়েছে। খাদ্যপণ্যের দামও বেড়েছে। লাওসের প্রায় এক তৃতীয়াংশ মানুষ দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করেন।

স্থানীয় গণমাধ্যম বলছে, জ্বালানির জন্য লোকজনকে দীর্ঘ সারিতে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। কিছু পরিবার তাদের বিল পরিশোধ করতে পারছে না। চলতি বছর লাওসের মুদ্রা কিপের মান মার্কিন ডলারের বিপরীতে এক তৃতীয়াংশেরও বেশি কমেছে। 

যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ সুদের হার ডলারকে শক্তিশালী করেছে। এর ফলে বিভিন্ন দেশের মুদ্রা দুর্বল হয়ে পড়েছে, তাদের ঋণের বোঝা এবং আমদানির ব্যয় বেড়েছে।

ইতোমধ্যে বিপুল পরিমাণ ঋণ করেছে লাওস। সেই ঋণ পরিশোধ অথবা জ্বালানির মতো আমদানির অর্থ পরিশোধে রীতিমতো লড়াই করতে হচ্ছে দেশটিকে। বিশ্বব্যাংক বলছে, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশটির রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার।  ২০২৫ সাল পর্যন্ত দেশটিকে একই পরিমাণে ঋণ পরিশোধ করতে হবে। আর এই ঋণের পরিমাণ দেশটির মোট দেশজ রাজস্বের প্রায় অর্ধেক।

গত মাসে মুডিস ইনভেস্টর সার্ভিসেসের ঋণের ঝুঁকিতে থাকা দেশের তালিকায় কমিউনিস্ট-শাসিত দেশটিকে ‘জাঙ্ক’ ক্যাটাগরিতে নামিয়ে দেয়। এই ক্যাটাগরিতে ঋণকে উচ্চ ঝুঁকি হিসাবে বিবেচনা করা হয়।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং রেলপথের মতো বড় প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য লাওসকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ঋণ দিয়েছে চীন। চীনের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা সিনহুয়াকে লাওসের কর্মকর্তারা বলেছেন, বেইজিং শুধুমাত্র গত বছরেই ১ হাজার ৬০০ কোটি ডলারেরও বেশি মূল্যের ৮১৩টি প্রকল্পে অর্থায়ন করছে।

বিশ্ব ব্যাংকের মতে, গত বছর লাওসের সরকারি ঋণের পরিমাণ ছিল মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৮৮ শতাংশ। এই ঋণের প্রায় অর্ধেক চীনের কাছ থেকে নেওয়া।

বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, দেশটিতে গত কয়েক বছর ধরে অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা চলছে। ১৯৭৫ সাল থেকে দেশটিতে একটি দলই— লাও পিপল’স রেভল্যুশনারি পার্টি ক্ষমতায় আছে।

পাকিস্তান

সরকার জ্বালানির ভর্তুকি তুলে নেওয়ায় গত মে মাসের শেষের দিকে পাকিস্তানে জ্বালানির দাম প্রায় ৯০ শতাংশ বেড়েছে। দেশটি এখন খরচের লাগাম টানতে চাইছে। পুনরায় একটি বেলআউট কর্মসূচি শুরু করতে আইএমএফের সাথে আলোচনা করছে তারা।

দ্রব্যমূল্যের ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধিতে দেশটির অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। গত জুনে দেশটির বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতির হার ২১ দশমিক ৩ শতাংশে পৌঁছায়; যা গত ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। শ্রীলঙ্কা ও লাওসের মতো পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও কমে গেছে। গত বছরের আগস্ট থেকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রায় অর্ধেকে নেমে গেছে।

১৯৩ কোটি ডলার পরিমাণ অর্থ সংগ্রহের লক্ষ্যে আগামী এক বছরের জন্য বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর ১০ শতাংশ কর আরোপ করেছে পাকিস্তান। এর মাধ্যমে দেশটি সরকারি রাজস্ব এবং ব্যয়ের ব্যবধান কমানোর চেষ্টা করছে। আর আইএমএফেরও অন্যতম প্রধান দাবি ছিল এটি।

গত মাসে পাকিস্তান সরকারের একজন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী দেশটির আমদানি বিল কমাতে নাগরিকদের চা পানের পরিমাণ কমাতে বলেছেন। এখানের চীনের ভূমিকা আছে। কারণ বেইজিংয়ের কাছ থেকে দেশের এক চতুর্থাংশেরও বেশি ঋণ নিয়েছে পাকিস্তান।

মালদ্বীপ

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকারি ঋণে ফুলে-ফেঁপে উঠেছে মালদ্বীপ। দেশটির ঋণের পরিমাণ জিডিপির তুলনায় ১০০ শতাংশেরও বেশি দাঁড়িয়েছে। শ্রীলঙ্কার মতো পর্যটনের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল দেশটির অর্থনীতিতে করোনা মহামারি ব্যাপকভাবে আঘাত করেছে।

যেসব দেশ পর্যটনের ওপর অত্যন্ত বেশি নির্ভরশীল তাদের সরকারি ঋণের অনুপাতও বেশি থাকে। তবে বিশ্বব্যাংক বলছে, জ্বালানি উচ্চ খরচের জন্য বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ এই দ্বীপ দেশটি। কারণ দেশটির অর্থনীতি বৈচিত্র্যপূর্ণ নয়।

মার্কিন বিনিয়োগ ব্যাংক জেপি মরগান বলেছে, ছুটি কাটানোর অন্যতম গন্তব্য এই দেশটি ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ দেউলিয়া হওয়ার ঝুঁকিতে আছে।