ঢাকা, বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ই বৈশাখ ১৪৩১

বিপর্যয় নেমে এসেছে সিলেটের আবাসন খাতে-দিলওয়ার

এমএ রহিম, সিলেট: | প্রকাশের সময় : বুধবার ৩০ মার্চ ২০২২ ১১:৪০:০০ পূর্বাহ্ন | দেশের খবর

বিপর্যয় নেমে এসেছে সিলেটের আবাসন খাতে। বিনিয়োগকারীরা এই খাতকে টিকিয়ে রাখার জন্যে চেষ্টা চালাচ্ছেন। কিন্তু আশার আলো দেখছেন না। ফলে এই খাতের সাথে যারা জড়িত আছেন, বিশেষ করে শ্রমিক শ্রেণীর মানুষ বেকার হয়ে পড়ছেন। ইতোমধ্যে এই খাতের প্রায় ২৫ হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন। বেকার হয়ে পড়া ওইসব শ্রমিক এখন মানবেতর জীবন যাপন করছেন। 

 

বিপর্যস্ত সিলেটের আবাসন খাত নিয়ে দৈনিক বায়ান্ন‘র কাছে ওইভাবে খাতটির নাজুক অবস্থা তুলে ধরেন সিলেটের হলি আরবান প্রপাটিজ প্রাঃ লিঃ এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর মোহাম্মদ দিলওয়ার হোসাইন।

 

সিলেটের আবাসন খাত বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হওয়ার নানান কারণ তুলে ধরেন মোহাম্মদ দিলওয়ার হোসাইন। তিনি জানাচ্ছিলেন সিলেটে আবাসন শিল্প যাত্রার পর থেকে এখানে দেশী বিদেশী বিনিয়োগ শুরু হয়। স্বচ্ছতার সাথে এই শিল্পকে পরিচালনা করতে সংশ্লিষ্টরা সার্বক্ষণিক আন্তরিক ছিলেন। ফলে এই শিল্পটি সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠে। আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়। কিন্তু ২০০৭ সালে এই শিল্পে বিপর্যয় নেমে আসে। 

 

তিনি জানাচ্ছিলেন ওয়ান ইলিভেনে সরকার পরিবর্তন হওয়ার পর গণহারে সিলেটের আবাসন প্রকল্পগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। শুধু বন্ধ নয়, ব্যাপকভাবে অপপ্রচারও করা হয়। ফলে এর মারাত্মক বিরূপ প্রভাব পড়ে ওই শিল্পের উপর। ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেন। প্রবাসী বিনিয়োগকারীরা আস্থা হারিয়ে ফেলেন। দেশী ও বিদেশী অনেক বিনিয়োগকারী ধীরে ধীরে নিজেদেরকে সরিয়ে নেন এই শিল্প থেকে। ২-১ টি বিতর্কিত আবাসন খাতের জন্যে সিলেটের পুরো আবাসন খাতকে ঠেলে দেয়া হয় বিপর্যয়ের দিকে। এই শিল্পর সাথে জড়িত হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হতে থাকেন।

 

দিলওয়ার হোসাইন বলছিলেন, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১২ সালের দিকে সিলেটে আবাসন শিল্প আবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। সফলতাও দেখতে পায়। দেশী ও প্রবাসী বিনিয়োগ আসতে থাকে এই খাতে। কিন্তু ২০১৬ সালে আবাসন খাতে বন্ধ করে দেয়া হয় গ্যাস সংযোগ। গ্যাস সংযোগ বন্ধ করে দেয়ার পর আবার ধস নামে এই শিল্পে। বিশেষ করে প্লট বিক্রয়ের হার অনেক কমে যায়। প্রবাসীরা একেবারে বিমুখ হয়ে পড়েন। ওই অবস্থায় আবাসন শিল্পের সাথে জড়িত অনেকেই তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিতে শুরু করেন। সিলেট রিয়েল এস্টেট এসোসিয়েশনের সদস্য ছিল শতাধিক। এখন ওই সদস্যের সংখ্যা ৩০ জনের মতো। ৭০ ভাগ সদস্যই তাদের সদস্য পদ নবায়ন করেননি। এতে ধারণা করা হচ্ছে ওই ৭০ ভাগ সদস্য তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন। 

 

তিনি জানান, সিলেটে আবাসন খাত বিপর্যয়ের মধ্যে কোনো রকম টিকে থাকার জন্যে যখন সংগ্রাম করছিল, ঠিক ওই সময় ২০২০ সালে করোনাভাইরাস দুর্যোগ ছড়িয়ে পড়ে। লকডাউন শুরু হয়। সিলেটের আবাসন খাতের স্টাফরা ঘরবন্দি অবস্থায় দিন কাটাতে থাকেন। ওই অবস্থায় তাদের বেতন ভাতা দিয়েছেন মালিকরা। দেড় বছরের অধিক সময় এভাবে বেতন ভাতা দিতে হয়েছে। লকডাউন প্রত্যাহার করে নেয়ার পর আবাসন খাত আরো বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে। নির্মাণ সামগ্রীর দাম বাড়তে থাকে হুহু করে। এ পর্যন্ত কমপক্ষে ২০ ভাগ দাম বেড়েছে নির্মাণ সামগ্রীর। ফলে লাভের পরিবর্তে ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছেন আবাসনের ব্যবসায়ীরা। 

 

তিনি বলেন, দুই বছর আগে যে প্রকল্পটি শুরু করা হয়, তার সকল ফ্লাট ওই সময়ের মূল্যে বিক্রি করে দেয়া হয়। এর মধ্যে দেড় বছর সকল প্রকল্পের কাজ বন্ধ ছিল। এখন ওই প্রকল্পের কাজ শেষ করতে হচ্ছে ২০ ভাগ অতিরিক্ত টাকা খরচ করে। এতে ফ্লাটের দাম দুই বছরের আগের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে। ফলে প্রকল্প মালিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ক্রেতার কাছে হস্তান্তর করতে হচ্ছে ফ্লাট।

 

দিলওয়ার হোসাইন জানাচ্ছিলেন, করোনার দুর্যোগের সময় বলা হয়েছি ঋণের সুদ মওকুফ করা হবে। বাস্তবে তা হয়নি। ফলে যারা ঋণ অনুমোদন করিয়েছিলেন তাদেরকে সুদ গুণতে হয়েছে টাকা কাজে না লাগিয়েও। যা অবশ্যই নাজুক অবস্থা সৃষ্টি করেছে। এই অবস্থায় সুদ মওকুফ করা খুবই জরুরি। অন্যথায় আবাসন খাত যতটুকু আছে তাও ধ্বংস হয়ে যাবে। 

 

ওই অবস্থার অবসান ঘটিয়ে সিলেটের আবাসন খাতকে আবারও চাঙ্গা করতে কতিপয় প্রস্তাবনা তুলে ধরেছেন দিলওয়ার হোসাইন। তিনি বলেন, আবাসন খাতে গ্যাস উন্মুক্ত করে দিতে হবে। এটা সরকারের জন্যে তেমন কঠিন নয়। কারণ আবাসন খাতে গ্যাস ব্যবহার হয় খুবই স্বল্প। এছাড়া সিলেটের গ্যাস সারাদেশে সরবরাহ হয়। স্বাভাবিক নিয়মে সিলেটের মানুষ গ্যাস প্রাপ্তির বেলায় অগ্রাধিকার দাবি রাখে। এই বিবেচনায় সিলেটের আবাসন খাতের জন্যে গ্যাস উন্মুক্ত করে দিতে দাবি উঠেছে। 

 

তিনি জানান, বর্তমানে সিলেটে ৯ তলার উপরে কোনো টাওয়ার করা যায় না। ১০ তলার উপর টাওয়ার করতে হলে সিভিল এভিয়েশনসহ বিভিন্ন দফতরের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। এসব অনুমোদ সংগ্রহ করতে কঠিন সংগ্রাম পোহাতে হয়। ঘাটে ঘাটে নানান বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। ওই বিষয়টিকে সহজ করতে হবে। ব্যাংক ঋণের ব্যাপারে সুদ ও শর্ত শীতিল করতে হবে। 

দিলওয়ার হোসাইন বলেন, সিলেটের বিশাল এক জনগোষ্ঠী বসবাস করেন প্রবাসে। তারা প্রবাসে সঞ্চিত টাকা দিয়ে দেশের মাটিতে নিরাপদ আবাস গড়ে তুলতে চান। অনেক সময় দেখা গেছে প্রবাসের অর্জিত অর্থ দিয়ে দেশে জায়গা জমি কিনে হাতে গোনা ২-১ জন প্রবাসী বিপাকে পড়েছেন। এই বিষয়টি যখন ব্যাপকভাবে প্রচার হয়, তখন প্রবাসীরা দেশের মাটিতে আর আবাসন খাতে বিনিয়োগ করতে চান না। 

 

প্রবাসীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে সরকার পদক্ষেপ নিতে পারেন। ওই ধরণের কোনো সমস্যা হলে প্রবাসী হেল্প ডেস্কের মাধ্যমে তার দ্রুত সমাধান করা। যাতে প্রবাসীরা বুঝতে পারেন তারা কোনোভাবেই দেশের মাটিতে অনিরাপদ নন। অন্যথায় প্রবাসী বিনিয়োগ দেশের মাটিতে একেবারে কমে যাবে। ইতোমধ্যে অনেক প্রবাসী গ্রুপ করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ শুরু করেছেন। প্রবাসীদের স্বার্থে সরকার আন্তরিক হবেন-এমনটা সিলেটের রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীরা দাবি করছেন।