শমসেরনগরে গ্রেনেড হামলার অপারেশন শেষে কমলপুর ক্যাম্পে অবস্থান করছিলেন সরদার আজিজুর রহমান। ক্যাপ্টেন সাজ্জাদ জানিয়ে দিলেন এখন আর কোনো অপারেশন নেই। ওই অবস্থায় সময় কেটে যাচ্ছিল।
দৈনিক বায়ান্নকে বীর মুক্তিযোদ্ধা সরদার আজিজুর রহমান জানান, সম্ভবত ২৫ অক্টোবর। ইমারজেন্সি সাইরেন বাজল। ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধারা যে যেই অবস্থায় ছিলেন, তিনি সেই অবস্থায় গ্রাউন্ডে সমবেত হলেন। ক্যাপ্টেন সাজ্জাদ এসে জানালেন ক্যাপ্টেন এনাম এসেছেন। ক্যাপ্টেন এনাম ছিলেন অফিসিয়াল কমান্ডার।
মুক্তিযোদ্ধারা সবাই সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ালেন। তাবু থেকে বের হয়ে এলেন ক্যাপ্টেন। সমবেত হওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের চারদিকে ঘুরতে থাকলেন। একসময় তিনি দাঁড়িয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দিলেন। তিনি সুখবর দিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের। জানালেন ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সাথে চুক্তি হয়েছে। এখন থেকে যৌথভাবে অপারেশন হবে। এজন্যে ১৫ নভেম্বরের পর কমলপুর ক্যাম্প আর থাকবে না। এই ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশের ভেতরে চলে যাবেন। অস্ত্র থাকবে ভারতীয় সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। তাঁদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় অস্ত্র নেয়া যাবে। ক্যাপ্টেন এনাম এও জানালেন ২-১ দিনের মধ্যে এই অঞ্চলে বড় ধরনের একটি অপারেশন হবে। এই অপারেশন চালাবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। যেদিন অপারেশন হবে সেদিন সৈনিকরা এই ক্যাম্পে আসবেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সতর্ক করে দিলেন। সৈনিকদের কোনো ধরণের প্রশ্ন করা যাবে না। তবে তারা কিছু জানতে চাইলে, জানাতে হবে।
এসময় সরদার আজিজ জানালেন তাঁর জন্ম শহর খুলনা। তিনি খুলনায় যেতে চান। ক্যাপ্টেন সাজ্জাদ জানিয়ে দিলেন বিষয়টি তিনি আগরতলা ক্যাম্পে জানাবেন। সেখান থেকে যে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে, তা ১৫ নভেম্বরের আগেই জানিয়ে দেয়া হবে সরদার আজিজকে।
সরদার আজিজ জানান,দিকনির্শেদনা দিয়ে ক্যাপ্টেন এনাম যে জীপে চড়ে এসেছিলেন, ওই জীপে করে চলে যান। দুইদিন পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৩০ সদস্যের একটি দল জঙ্গল পথ ধরে কমলপুর ক্যাম্পে এলেন। মুক্তিযোদ্ধারা সবাই তাবুর ভেতরে অবস্থান করছেন। তাবুর ফাঁক দিয়ে দেখা গেল সেনাবাহিনীরা সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। দুইজন নিচু সুরে কিছু বললেন। এর পরপরই সৈনিকরা আবার সারিবদ্ধ হয়ে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে চলে গেলেন। কমলপুর ক্যাম্পে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারা সহজ হয়ে উঠলেন। রাতের খাবার শেষে সবাই বিশ্রাম নিচ্ছেন। ভোররাতে গুলির শব্দ কানে ভেসে আসতে থাকে। বুঝতে পারলেন দূরে কোথায় অপারেশন চলছে।
সরদার আজিজ জানান, ৪-৫ দিন পর ওই অপারেশন সম্পর্কে জানতে পেরেছেন। ওই সৈনিকরা কমলগঞ্জ উপজেলার ধলই সীমান্তের হায়েনাদের ফাঁড়ি দখল করার অভিযানে অংশ নেন। ভোর চারটায় মুক্তিবাহিনী লক্ষ্যস্থলের কাছে পৌঁছে অবস্থান নেয়। সামনে দু প্লাটুন ও পেছনে এক প্লাটুন সৈন্য অবস্থান নিয়ে অগ্রসর হতে থাকে শত্রæ অভিমুখে। শত্রæ অবস্থানের কাছাকাছি এলে একটি মাইন বিস্ফোরিত হয়। মুক্তিবাহিনী সীমান্ত ফাঁড়ির খুব কাছে পৌঁছে গেলেও ফাঁড়ির দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্ত হতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মেশিনগানের গুলিবর্ষণের জন্য আর অগ্রসর হতে পারছিলো না। অক্টোবরের ২৮ তারিখে ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও পাকিস্তানি বাহিনীর ৩০ এ ফ্রন্টিয়ার রেজিমেন্টের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ বাধে। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১২৫ জন মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধে অংশ নেন। মুক্তিবাহিনী পাকিস্তান বাহিনীর মেশিনগান পোস্টে গ্রেনেড হামলার সিদ্ধান্ত নেয়। গ্রেনেড ছোড়ার দায়িত্ব দেয়া হয় হামিদুর রহমানকে। তিনি পাহাড়ি খালের মধ্য দিয়ে বুকে হেঁটে গ্রেনেড নিয়ে আক্রমণ শুরু করেন। দুটি গ্রেনেড সফলভাবে মেশিনগান পোস্টে আঘাত হানে। কিন্তু তার পরপরই হামিদুর রহমান গুলিবিদ্ধ হন। সে অবস্থাতেই তিনি মেশিনগান পোস্টে গিয়ে সেখানকার দুই জন পাকিস্তানি সৈন্যের সাথে হাতাহাতি যুদ্ধ শুরু করেন। এভাবে আক্রণের মাধ্যমে হামিদুর রহমান এক সময় মেশিনগান পোস্টকে অকার্যকর করে দিতে সক্ষম হন। এই সুযোগে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধারা বিপুল উদ্যমে এগিয়ে যান এবং শত্রæ পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করে সীমানা ফাঁড়িটি দখল করতে সমর্থ হন। কিন্তু হামিদুর রহমান বিজয়ের স্বাদ আস্বাদন করতে পারেননি। ফাঁড়ি দখলের পরে মুক্তিযোদ্ধারা শহীদ হামিদুর রহমানের লাশ উদ্ধার করে। বীর শ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান ঢাকার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সমাহিত আছেন।