বৈশাখের প্রায় শেষ। গ্রীষ্মকাল চলছে। নদ-নদীর পানি হাওরে প্রবেশ করেছে। জলভরে উঠছে জেলার সবক’টি হাওর। নতুন পানির সাথে এসেছে নতুন মাছ। মাছের পোনায় ভরে গেছে হাওরগুলো। এসব পোনা মাছেই একসময় চাহিদা মিটবে সুনামগঞ্জ জেলাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের। কিন্তু গত এক সপ্তাহ ধরে যে হারে এসব পোনা মাছ শিকার করা হচ্ছে তাতে রীতিমতো উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সচেতন মহল। তাঁরা বলছেন, এ হারে পোনা মাছ ধরলে নিকট ভবিষ্যতে দেশি মাছের প্রকট সংকটে পড়তে হবে হাওরিয়া জেলা সুনামগঞ্জসহ দেশবাসীকে। হাওরে এসব পোনা মাছ ধরা বা শিকার করা যদি অন্তত একমাস বন্ধ রাখা যায় তাহলে ভরা মৌসুমে সব রকমের মাছে কিলবিল করবে পুরো হাওর। তাতে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবেন জেলেরাই। আর সাধারণ মানুষ তৃপ্তির সাথে দেশি মাছের স্বাদ ভোগ করতে পারবেন। এজন্য চলতি মাস থেকে অন্তত এক-দেড় মাস পর্যন্ত সময় দেশি মাছের পোনা শিকার করা বা ধরা বন্ধ রাখার অনুরোধ করেছেন তাঁরা। সেই সাথে মৎস্য পেশার সাথে জড়িত লোকদের প্রয়োজনে বিভিন্ন প্রনোদনা দেওয়ার কথাও বলেছেন তাঁরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত এক সপ্তাহ থেকে জেলার শান্তিগঞ্জ উপজেলার পাগলা বাজার, বীরগাঁও নতুন ও পুরাতন বাজার, দরগাপাশার আক্তাপাড়া মিনাবাজার, ছয়হাড়া-মৌগাঁও পয়েন্ট, জয়কলসের নোয়াখালী বাজার, পাথারিয়া বাজার, পূর্ব পাগলার পঞ্চগ্রাম-চিকারকান্দি বাজারসহ উপজেলার প্রায় সবক’টি ছোট-বড় বাজার ও পয়েন্টে নিয়মিত উঠছে দেশি জাতের মাছে। সেই সাথে আশঙ্কাজনক হারে বাজারগুলোতে আসছে পোনা মাছ। এসব পোনা মাছের মধ্যে বোয়াল মাছের পোনা, টাকি মাছের পোনা, শোল মাছের পোনা লক্ষণীয়। বিশেষ করে বোয়াল ও টাকি মাছের পোনা বেশিই লক্ষ করা যায়। বাজারে আসা বোয়াল মাছের পোনাগুলো দেড় থেকে দুই ইঞ্চি লম্বা এবং আকারে একেবারেই ছোট। খেতে স্বাদ হওয়ায় ক্রেতাদের মধ্যে এসব মাছের চাহিদা থাকে বেশি। তাই চড়ামূল্যে বিক্রি করা যায় বলেই জালে উঠা মাত্রই এসব মাছ সংগ্রহে নিয়ে আসেন জেলেরা। সামান্য সময় আর অল্প মুনাফা লাভের আশায় স্থায়ীভাবে নিজেদেরই ক্ষতি করছেন জেলেরা।
হাওরে পোনা মাছ ধরা ও বাজারে বিক্রি সংক্রান্ত বিষয়ে উপজেলার পশ্চিম পাগলা, পূর্ব বীরগাঁও, পশ্চিম বীরগাঁও ও জয়কলসসহ বিভিন্ন ইউনিয়নের বেশ কয়েকজন সচেতন মানুষের সাথে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তাঁরা বলেন, পক্ষান্তরে আমাদের জেলেরা নিজেদের পায়ে নিজেরাই কুড়াল মারছেন। তাঁরা সাময়িক একটা লাভ দেখছেন। এজন্য মাছের পোনাকেও ছাড় দিচ্ছেন না। আর আমরাও চড়া দাম দিয়ে কিনে খুব মজা করে খাচ্ছি। এটা যেমন একটি অমানবিক কাজ তেমনি বেআইনিও। এ মাছগুলো যদি সঠিকভাবে বেড়ে উঠার সুযোগ পায় তাহলে হাওরে মাছে মাছ খাবে। মানুষ তো খাবেও। বোয়াল মাছের যে পোনাগুলো এখন বাজারে বিক্রির জন্য আনা হচ্ছে সেগুলো যদি বড় হয় তাহলে হাওরে শুধু বোয়াল মাছই ধরা পড়বে। তখন বেশি উপকৃত হবেন জেলেরাই। প্রশাসনের নজরদারি বাড়াতে হবে। জেলেদের সচেতন করতে হবে। প্রয়োজনে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাতে হবে। এ কাজে সহযোগিতা করতে গিয়ে যদি জেলেদের কোনো ধরণের সহযোগিতার দরকার পরে কর্তৃপক্ষ সে ক্ষেত্রে সব ধরণের সহযোগিতা করা দরকার। প্রশাসনের কথা না মানলে আইনের সঠিক প্রয়োগ করতে হবে।
দেখার হাওরে দীর্ঘদিন ধরে মাছ ধরেন মুজাহিদ আলম নামের এক জেলে। কথা হয় তাঁর সাথে। তিনি বলেন, ছোট মাছ ধরতে আমাদেরও মন চায় না। কিন্তু কি করবো বলুন, এখন তো ছোট মাছেরই সময়। জালে উঠলে তো ফেলতে পারি না। বাজারে কাস্টমার এ মাছগুলো একটু দাম দিয়া হলেও কিনে খায়। আমরা যদি এগুলো না ধরি আরেকজনে ধরবে। আর না ধরলে কি খেয়ে বাঁচবো। সরকার কী আমাদের খেতে দেবে?
পাগলা সরকারি মডেল হাইস্কুল এন্ড কলেজের সহকারি শিক্ষক সাইফুল ইসলাম বলেন, এই মূহুর্তে ছোট মাছ ধরা উচিৎ না। তাহলে আগামী কয়েকমাস পরে হাওরে মাছের সংখ্যা কমে যাবে। তাই জেলেদেরকে বুঝাতে হবে। প্রশাসনের নজরদারি বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে একমাসের জন্য জেলেদেরকে প্রণোদনা দিতে হবে। এখন হাওরে পোনা মাছ থাকলে জেলেরাই বেশি উপকৃত হবেন।
বীরগাঁও বাজারের পল্লী চিকিৎসক শাইখুল ইসলাম বলেন, দেশি মাছ আমাদের সম্পদ। এগুলো রক্ষা করার দায়ীত্ব আমাদের। প্রতিদিন যে হারে বাজারগুলোতে পোনা মাছ আসে এর ধারাবাহিকতা চলতে থাকলে নিকট ভবিষ্যতে মৎস্য সংকটে পড়তে হবে আমাদের। তাই দ্রুত পোনা মাছ নিধন করা বন্ধ করতে হবে।
শান্তিগঞ্জ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলাম বলেন, জেলেদের সচেতন করতে আমরা বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছি। যেসব জাল দিয়ে পোনামাছ নিধন করা হচ্ছে সেসব জেলেদের জাল ধরতে প্রয়োজনে মোবাইল কোর্টের ব্যবস্থা করা হবে। আমরা বিষয়টি খুবই গুরুত্ব দিয়ে দেখবো।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আনোয়ার উজ্ জামান বলেন, আমি বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখছি। মৎস্য অফিসারকে বলছি। প্রচারণা বাড়ানো হবে। পোনা মাছ ধরা বন্ধে সব ধরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।