ঢাকা, বৃহস্পতিবার ২ মে ২০২৪, ১৮ই বৈশাখ ১৪৩১

সব সম্ভবের দেশকাহন

সরওয়ার আহমদ: | প্রকাশের সময় : রবিবার ১১ জুন ২০২৩ ০৪:০৮:০০ অপরাহ্ন | মতামত


বর্তমান আর্থ সামাজিক বাস্তবতায় দেশের সিংহভাগ যে মূল সমস্যায় ভারাক্রান্ত, সেটি হচ্ছে স্বাভাবিক জীবনযাপন। এই জীবনযাপন প্রক্রিয়াকে হুমকীগ্রস্থ করে ফেলেছে মূল্যস্ফীতি তথা বাজার দৌরাত্ন। নানান অজুহাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য দ্রব্যের মূল্য দফায় দফায় এমনভাবে বৃদ্ধি করা হয়েছে যে, ৬৫% ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা তলানীতে পৌছেছে। স্বল্প বেতনভোগী কর্মচারী থেকে আরম্ভ করে নিম্নবিত্ত তথা কৃষক শ্রমিকসহ স্বল্প আয়ের পরিবারসমূহে একপ্রকার অব্যক্ত এবং অদৃশ্য হাহাকারের ঘেরাটোপে বন্দী। শাসক দল এবং বিরোধী দল এই হাহাকারের খবর কতটুকু জানে, তা বলা মুশকিল।

একসময় জনশ্রুতি ছিলো, মঙ্গা আক্রান্ত রংপুর অঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠির খাদ্য ছিলো উচ্ছা লাউয়ের সাথে সামান্য কেচকি মাছ এবং গরম কিংবা পান্তাভাত। তৎকালীন রংপুরের জীবনের রং এখন ছড়িয়ে পড়েছে দেশময়। গ্রামজনপদের অভাবী সংসারে উচ্ছা লাউ জুটলেও সবসময় মাছ জুটছেনা। সুটকীর সাথে আলু-বেগুনের লাবড়া কিংবা শাকের ঝোলই হচ্ছে সপ্তাহের ৪/৫ দিনের মেন্যু। বাজারে আহারযোগ্য সবকিছুর অঢেল সরবরাহ থাকলেও ক্রয়ক্ষমতার অভাবে অধিকাংশ ক্রেতা পণ্য ক্রয় করতে পারছেনা। যে আয় আছে, তা দিয়ে পরিবারের ব্যয় সংকুলান ক্রমেই দুরুহ হয়ে উঠছে। উন্নয়নের সা-রে-গা-মা’র কোরাসে অভাবের এই অস্ফুট ক্রন্দন হয়তো স্পষ্ট  হতে পারছেনা। হাইপাওয়ার এন্টিবায়োটিকে সিফিলিস জীবানুকে দমিয়ে রাখা গেলেও সংক্রমণ কিন্তু নিবারণ হয়না। একসময় তা ক্যান্সারের আদল নিয়ে দেহসত্তাকে হুমকীগ্রস্থ করে ফেলে। এভাবে অসনাক্ত এবং অনীরিক্ষিত দারিদ্র অভাব এবং অনাহার একসময় পল্লবিত রুপ ধারণ করে উন্নয়নের দৃশ্যপটকে তছনছ করে দিতে পারে। একদিকে উন্নয়ন এবং অন্যদিকে হাহাকারের বলিহারি দাপটের মধ্যে সংঘর্ষ তো অনিবার্য্য।

যেহেতু দেশের শাসণভার সরকারের উপর বর্তায়, সেহেতু সমাজের উল্লেখযোগ্য অংশে জগদ্দল পাথরের মতো জেকে বসা অক্ষমতা, অভাব এবং দারিদ্রের দায়ভার মানুষ সরকারের উপরই চাপাচ্ছে। কিন্তু, এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মূল কারিগর তো হচ্ছে অতি মুনাফালোভী বণিক সিন্ডিকেট। তাদের প্রসারিত লম্বা হাত সার্বিক উন্নয়নের সুফল নিজেদের কব্জায় নিতে কৃতসংকল্প। নানান অজুহাতে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি করে ভোক্তাদের অর্জিত অর্থ তাদের করায়ত্তে নিতে তারা সক্ষম হচ্ছে। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিসহ মাথাপিছু গড় আয়ের অংক কষে বণিক সিন্ডিকেট মনে করছে দেশে টাকা আছে। পণ্যমূল্য বৃদ্ধি করে এ টাকা লোটা সহজ। ফলশ্রুতিতে যা ঘটার তাই ঘটছে। বাজারী দৌরাত্মে নিম্নবিত্তের পকেটের টাকা শেষ হবার পর তাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকেছে। মধ্যবিত্ত সমাজে উঠেছে ত্রাহি ত্রাহি রব। বৈশ্বিক মূদ্রাস্ফীতি, কোভিড অচলায়তন এবং রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধকে বাণিজ্যিক লুটেরাপনার ঢাল হিসাবে খাড়া করা হয়েছে। কিন্তু, বাংলাদেশী বাস্তবতা হচ্ছে তিনগুণে নয়গুণ। বিশ্বব্যাপী একটাকা বাড়লে এদেশে বাড়ে নয়টাকা। মুনাফার কি মৃগয়া ক্ষেত্র ? এই বাজারী দৌরাত্মতের বিপরীতে প্রতিরোধের কি আছে ? মুক্তবাজার অর্থনীতির আলোকে তিনদশক আগেই এদেশে বিজনেস মনোপলির ভিত্তি রচনা করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে বাজারের ভারসাম্য রক্ষাকারী কসকর ও রেশনিং সিস্টেমকে উঠিয়ে দেয়া হয়েছে। টিসিবিকে করা হয়েছে পঙ্গু। রাষ্ট্রায়ত্ত যেসমস্ত ফ্যাক্টরী সূলভ মূল্যে পণ্য সরবরাহ করতো সেসমস্ত প্রতিষ্ঠানকে পানির দরে তুলে দেয়া হয়েছে বেসরকারী খাতে।

বর্তমানে বাজার নিয়ন্ত্রণের যে সিস্টেম আছে, সেটিকে ‘ইদুরের রাজ্যে দন্তহীন বিড়াল’ এর সাথে তুলনা করা চলে। জেলা পর্যায়ে বাজার দেখভালের জন্য রয়েছেন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের একজন কর্মকর্তা এবং একজন সহকারী। এই দুজন জেলার ২৫/২৬ লাখ ভোক্তার অধিকার কিভাবে সংরক্ষণ করবে ? জেলা পর্যায়ে মার্কেটিং অফিসারের দেখা মিলেনা অনেক জেলাতে।

উপজেলা পর্যায়ে বাজার দেখভালের দায়িত্ব বর্তেছে ইউএনও এবং এসিল্যান্ডের উপর। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে ভোক্তা নয়, তারা বণিক স্বার্থ সংরক্ষণেই মানসিকভাবে দায়বদ্ধ। এমতাবস্থায় মনে হচ্ছে বাজার সিন্ডিকেটের দৌরাত্বে সরকারী নিয়ন্ত্রণ দৃশ্যতঃ শিথিল বা অক্ষম। উৎপাদিত বা আমদানিকৃত পণ্যমূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের উপর সরকারী কোন নিয়ন্ত্রণ নাই বলেই প্রতীয়মান। তারা ইচ্ছামাফিক দাম বাড়াচ্ছে। বল্গাহীন মূল্যবৃদ্ধির জন্য সরকারী একশন কি কি আছে ? প্রতিযোগীতা কমিশন একবার কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের উপর মামলা করার খবর দেশবাসী অবহিত হয়েছিলো। এ পর্যন্তই। পরবর্তী আর কোন খবর নেই। এমতাবস্থায় প্রশ্ন উঠতে পারে, ব্যবসায়ীরা সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন, না সরকার আছে ব্যবসায়ীদের পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণে ? কানাঘুষা আছে, বাজারী দৌরাত্নের সাথে মন্ত্রী পরিষদের ২/৩ জনের হাত আছে। সত্য মিথ্যা কে বলবে ? সত্য যদি হয় তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে_ খন্দকার মোস্তাক, শাহ মোয়জ্জেম, ওবায়েদুর রহমান এবং তাহের উদ্দিন ঠাকুরের প্রেতাত্না কি নতুন মোড়কে নড়াচড়া শুরু করেছে ?


এখানে প্রাসঙ্গিক যে, রোগ নিরুপিত হলে যেমনি তার প্রতিষেধক মিলে, তেমনি অবস্থা বিবেচনায় অনাচার দৌরাত্মের প্রতিবিধিান আছে। বাজারী লুটপাটের হোতা প্রতিষ্ঠানকে বাগে আনতে পারলে বাজার নিয়ন্ত্রণে আসা কোন অসম্ভব বিষয় নয়। আমদানীকারক, উৎপাদক প্রতিষ্ঠান, ঢাকা চট্টগ্রামের হোল সেলার এবং জেলা পর্যায়ের মার্চেন্ট ও আড়ৎদারদের উপর নজরদারীসহ তদারকির কঠোর নিয়মাবলী প্রয়োগ করলেই বাজার স্বাভাবিক হবার কথা। এক্ষেত্রে সরকারের সিদ্ধান্ত এবং সদিচ্ছাই নিয়ামক বলে গণ্য। বলা বাহুল্য, আমদানীকারক, উৎপাদক প্রতিষ্ঠান, ঢাকা চট্টগ্রামের হোল সেলার এবং জেলা পর্যায়ের বড় বড় মার্চেন্টরাই হচ্ছে পণ্যের বাজার চড়া রাখার নেপথ্য কারিগর। বাকী খুচরা ব্যবসায়ীরা হচ্ছে বিপণনের হাতিয়ার মাত্র।

নিত্যপণ্যের অগ্নিমূল্যের প্রভাবে প্রান্তিক জনপদে কি ধরণের অস্বস্থি বিরাজ করছে, সেটি হৃদয়ঙ্গম বা অনুধাবনের ইচ্ছা সংশ্লিষ্ট মহলের আছে কিনা বলা মুশকিল। তবে, মাঠ সাংবাদিক হিসাবে যারা মাটি ও মানুষের নৈকট্যে রয়েছেন তাদের গায়ে এ বাতাস কমবেশী অনুভূত হয়। সেদিন গ্রামীন এক মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি আক্ষেপের সাথে বললেন, বাজার আগুন হবার পেছনে নাহয় সরকারী ব্যর্থতা বা ইন্ধন আছে। কিন্তু, বিরোধী দলও তো এ ব্যাপারে নির্বিকার। ভোট কেমনে হবে নাহবে, গণতন্ত্র এবং নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে সবাই মুখর। পাবলিকের দূর্গতি নিয়ে তো কেউ ভাবেনা কিংবা কথা বলেনা। একথা শুনে মুচকি হেসে বলেছি অপেক্ষা করুন আরও ৬/৭ মাস। তারপর কত রবি জ্বলে সেটি দেখবেন।

বাজারে মূল্যসন্ত্রাস এবং নিম্নবিত্তের নাজেহাল দশা সম্পর্কে বিরোধী দল পূর্ণমাত্রায় অবহিত থাকার পরও রাঁ শব্দ করছেনা। বরং পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটুক, এ মূহুর্তে বোধহয় এটাই তাদের কাম্য। কিন্তু, নির্বাচনের ঘন্টা বেজে উঠলেই এ বিষয়টি মুখ্য হয়ে উঠবে। বর্ণনার বর্ণচ্ছটায় তা বাঙ্ময় হয়ে উঠবে। ভোটের বাজারে তার কাটতিও থাকবে। মূল্যসন্ত্রাসে নাজেহাল ভোক্তার অধিকাংশই তখন অবদমিত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটালে আশ্চর্য্য হবার কিছুই থাকবেনা।

প্রতিটি নির্বাচনে জয়-পরাজয়ে একটি বিশেষ ইস্যু ক্রিয়াশীল থাকে। পিতামহদের নিকট থেকে শুনেছি- ’৫৪ সনের নির্বাচনে নুরুল আমিন সরকারের পতনের মূল কারণ ছিলো ভাষা আন্দোলনে ছাত্রহত্যা এবং লবন সংকট। সেসময় নাকি চার আনা সেরের লবনের দাম উঠেছিলো ৭ টাকায়। গ্রাম-জনপদের ভোটাররা লবনের দামবৃদ্ধির দায়ে নুরুল আমিনের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিলো একাট্টা হয়ে। ২০০৮ সনের নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবির মূল কারণ ছিলো, সারের দাবীতে উন্মত্ত কৃষকদের উপর গুলি চালনা এবং বৈদ্যুতিক তারবিহীন খাম্বার প্রহসন। আসন্ন সংসদ নির্বাচনে বাজারী আগুন প্রধান ইস্যু হয়ে উঠবে। বাজার সিন্ডিকেট কর্তৃক সৃষ্ট এ দৌড়াত্ম জঙ্গিবাদ, হরতাল, অবরোধ এবং অগ্নিসন্ত্রাসের চাইতেও ভয়ংকর। যার ফলশ্রুতিতে ভোক্তার পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। সুতরাং ভোটের ক্ষেত্রে তারা প্রতিবাদী হবেই। শেখ হাসিনার সরকারের সর্বক্ষেত্রে সাফল্যের স্বাক্ষর বিদ্যমান। কিন্তু, অক্ষমতা আছে বাজার নিয়ন্ত্রণে। এই বাজারী আগুন কি তবে সব অর্জন এবং সফলতাকে পুড়িয়ে দেবে ? এটি তো সব সম্ভবের দেশ।