ঢাকা, সোমবার ১৩ মে ২০২৪, ৩০শে বৈশাখ ১৪৩১

সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চলছে উম্মুক্ত চাঁদাবাজি: ১৫ হাজার ব্যাটারি রিক্সা নিয়ন্ত্রণে কারা!

মো. এনামুল হক লিটন, চট্টগ্রাম : | প্রকাশের সময় : বৃহস্পতিবার ২৫ নভেম্বর ২০২১ ০৩:১৮:০০ অপরাহ্ন | চট্টগ্রাম প্রতিদিন
ছবিটি গতকাল নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী থানার বাংলাবাজার এলাকা থেকে তোলা।-ছবি : ইমদাদুল হক ইমন।

চট্টগ্রাম মহানগরী ও অলিগলিতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ১৫ হাজার হাজার ব্যাটারি রিক্সা। এসব ব্যাটারি রিক্সা চলাচলকে কেন্দ্র করে এলাকা ভিত্তিক গড়ে উঠেছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। অভিযোগ রয়েছে, সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) ১৬টি থানা এলাকায় ভাগ করে চালানো হচ্ছে ১৫ হাজার ব্যাটারি রিক্সা।

হিসেব অনুযায়ি প্রতিটি থানা এলাকায় ৯শ ৩৭টি ব্যাটারি রিক্সা চলাচল করছে। জানা যায়, প্যাডেলচালিত রিকশা মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের আন্দোলনের মুখে সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাটারিচালিত রিকশার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয় সিটি করপোরেশন ও পুলিশ প্রশাসন। ওই সময়ে ব্যাপক অভিযানের মুখে এ ধরনের রিকশা চলাচল অনেকটা বন্ধ হয়ে গেলেও তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। বর্তমানে অলিগলি ছাড়িয়ে প্রধান সড়কেও ব্যাটারি রিক্সা চলাচল করতে দেখা যাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতিটি ব্যাটারিচালিত রিকশায় চারটি শক্তিশালী ব্যাটারি সংযুক্ত থাকে। কোনো কারণে যাত্রী নিয়ে রিক্সা উল্টে গেলে ব্যাটারির এসিডে দগ্ধ হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, স্থানীয় বিভিন্ন মোটর গ্যারেজে এসব রিকশা তৈরি করছে অনভিজ্ঞ মিস্ত্রিরা। হালকা ও ছোট আকারের তিন চাকার যানটিতে উচ্চ ক্ষমতার মোটর সংযোজন এবং ৪টি শক্তিশালী ব্যটারি লাগানোর কারণে চালকদের পক্ষে রিকশাগুলো নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে যায়। ফলে প্রতিনিয়ত ঘটছে দূর্ঘটনা।

জানা গেছে, বৈদ্যুতিক মোটরচালিত এসব রিকশার প্রতিটির ব্যাটারি চার্জ দিতে দৈনিক খরচ হয় ৮ দশমিক ৭৫ ইউনিট বিদ্যুৎ। সে হিসেবে প্রতিদিন খরচ হয় ৮৭ হাজার ৫০০ ইউনিট বিদ্যুৎ। প্রতিদিন ৭০ টাকার বৈদ্যুতিক চার্জ দিতে হয় ব্যাটারিচালিত প্রতিটি রিকশায়। নগরীর বিভিন্ন এলাকার অলিগলিতে গ্যারেজের আড়ালে এসব রিক্সায় ব্যাটারি চার্জ করা হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, বিদ্যুৎ বিভাগের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগশাযশে অবৈধ সংযোগ নিয়ে রিক্সার গ্যারেজ মালিকরা অবাধে ব্যাটারি চার্জ দিচ্ছে। ফলে নগরীতে বাড়ছে লোডশেডিং।

ট্রাফিক পুলিশের তৎপরতা না থাকায় বেশীরভাগ ব্যাটারি রিক্সা চলছে অলিগলিতে। ব্যাটারি চালিত রিক্সা চালকদের দেয়া তথ্য মতে, বায়েজিদ বোস্তামী থানা এলাকার শেরশাহ বাংলাবাজার, নয়ার হাট, ওয়জেদিয়া, রুবি গেইট, টেক্সটাইল গেইট, ডেবারপাড় জামতলা এলাকা, আরেফিন নগর ও আশপাশের প্রায় ১০-১৫টি গ্যারেজ, সিরাজদ্দৌলা রোড থেকে বাকলিয়া পর্যন্ত এলাকায় ২০/২৫টি ব্যাটারি চার্জের গ্যারেজসহ নগরীর আরো বিভিন্ন এলাকায় আরো শতাধিক গ্যারেজ রয়েছে। বস্তি এলাকা গুলোকে টার্গেট করে অসাধুচক্ররা বছরের পর বছর এসব গ্যারেজ খুলে অবৈধভাবে ব্যাটারি রিক্সা চার্জ কার্যক্রম প্রকাশ্যে পরিচালনা করে আসলেও থানা পুলিশ রহস্যজনক কারণে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এছাড়া হালিশহর, ছোটপোল, পাহাড়তলী আমবাগান, কর্নেলহাট এলাকায় একইভাবে চার্জ এবং ব্যাটারি রিকশা চলাচল করছে। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক পশ্চিম বিভাগের পরিদর্শক (টিআই এডমিন) বিপ্লব কুমার পাল এ প্রতিবেদককে বলেন, ব্যাটারি রিক্সা চলাচল অনেক আগেই নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

আমাদের অভিযানের জন্য তারা মূল সড়কে সচরাচর চলাচল করতে পারে না। তবে অভ্যন্তরীণ সড়কগুলোতে এবং অলিগলিতে ট্রাফিক পুলিশ না থাকায় এসব রিকশা চলছে। তিনি গত এক মাসে ট্রাফিক পশ্চিম বিভাগের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় ৭শ’র অধিক ব্যাটারি রিক্সা আটক করা হয়েছে উল্লেখ করে ব্যাটারি রিক্সার বিরুদ্ধে সাড়াশি অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলে জানান। কোতোয়ালী এলাকার ট্রাফিক পরিদর্শক (টিআই) মশিউর রহমান জানান, আমাদের চোখে পড়লেই আটক হচ্ছে ব্যাটারি রিক্সা। ফাঁকি দিয়ে কিছু ব্যাটারি রিক্সা চললেও তা অচিরেই বন্ধ করা হবে। জানা যায়, এর আগে ব্যাটারি রিক্সার বিরুদ্ধে প্রশাসন কঠোর হলে, কিছুদিন তাদের তৎপরতা কমে যায়। কিন্তু  হঠাৎ করে নগরীতে আবারো ব্যাটারি রিক্সার চলাচল বেড়ে গেছে। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি)’র বরাবরই কড়া নির্দেশনার পরও নগরীর অলিগলিতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে চলাচল নিষিদ্ধ এসব ত্রিচক্রযান ব্যাটারি চালিত রিক্সা। জানা যায়, গত বছরের জুনে প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায় থেকে ব্যাটারি চালিত রিক্সা বন্ধে নির্দেশনা দেয়া হয়। এমন নির্দেশনার পর পুলিশ নগরজুড়ে ব্যাটারিচালিত রিকশাবিরোধী অভিযান শুরু করে। ওই সময়ে নগরীতে ব্যটারি চালিত রিক্সা উধাও হয়ে গেলেও বর্তমানে কতিপয় রিকশা মালিক-চালক সমিতির মাধ্যমে এবং স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের ‘ম্যানেজ’ করে নগরীর বিভিন্ন অলিগলি এমনকি মূল সড়কেও এসব রিক্সা চলাচল করতে দেখা যাচ্ছে এমন অভিযোগ বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দা ও প্যাডেল চালিত রিক্সা চালক-মালিকদের।

সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, নগরীর কর্ণফুলী, বায়েজিদ, পাঁচলাইশ, চান্দগাঁও এবং বাকলিয়া থানা এলাকার বিভিন্ন অলিগলি, সড়ক ও উপ-সড়কে দিব্যি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে নিষিদ্ধ এসব ব্যাটারি রিক্সা। বিশেষ করে শুধুমাত্র নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী থানার বাংলাবাজার এলাকায় প্রায় দূ-শতাধিক ব্যাটারি রিক্সা চলাচল করছে বিনা বাধায়। বাংলাবাজারের আশপাশের রিক্সার গ্যারেজগুলোতে প্রকাশ্যে রাখা হচ্ছে এসব রিক্সা। এছাড়া রিক্সার ব্যাটারি চার্জের ব্যবস্থাও রয়েছে ওইসব গ্যারেজে। বাংলাবাজার এশিয়া ফ্যান কারখানার সামনে জনৈক ফুল মিয়া, আজাদ ও ডেবারপাড়  জামতলা এলাকায় আরো কয়েক ব্যক্তি সেখানে গ্যারেজ করে এসব অবৈধ রিক্সা ভাড়া দিচ্ছে। অনভিজ্ঞ এসব রিকশা চালকের বেশিরভাগেরই দ্রুতগতি সম্পন্ন ব্যাটারিচালিত রিকশা চালানোর কোনো পূর্ব-অভিজ্ঞতা বা প্রশিক্ষণ নেই। এছাড়া ট্রাফিক আইন সম্পর্কে ন্যুনতম ধারণা না থাকায় এসব চালকরা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে প্রতিনিয়ত, বাড়ছে যানজটও। হতদরিদ্র মানুষগুলোর বেশীরভাগই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে কাজের সন্ধানে চট্টগ্রাম নগরীতে এসেই সহজ পেশা হিসেবে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচলে নেমে যাচ্ছে। প্যাডেল রিকশা চালানো কষ্টসাধ্য বলেই তারা দ্রæতগতির ব্যাটারিচালিত রিকশার দিকেই বেশী ঝুঁকছেন বলে জানিয়েছেন, বায়েজিদ এলাকার মোতালেব নামের এক রিক্সা চালক। তবে এসব হদদরিদ্র মানুষের অসহায়ত্বকে পূজিঁ করে এলাকা ভিত্তিক সিন্ডিকেট গঠন করে চলছে উম্মুক্ত চাঁদাবাজি।

সূত্র মতে, চট্টগ্রাম মহানগরীতে বৈধ রিকশার সংখ্যার তুলনায় অবৈধ রিকশার সংখ্যা তিন গুণেরও বেশি। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) তালিকাভুক্ত বৈধ রিকশার সংখ্যা মাত্র নয় হাজার ১২৪টি। আবার চসিকে নিবন্ধিত চট্টগ্রাম মহানগরীতে চলাচলরত এমন ৩০ হাজার রিকশা চলাচলের তথ্য দিয়েছে, চসিক ও ট্রাফিক পুলিশ। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৮ সালে চট্টগ্রাম মহানগরীতে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধ করার জন্য দুটি সংগঠনের পক্ষ থেকে রিট পিটিশন করা হয়েছিল। অটোরিকশার পক্ষে চট্টগ্রাম অটোরিকশা-অটোটেম্পো শ্রমিক ইউনিয়নের পক্ষে সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশিদ ও প্যাডেলচালিত রিকশার পক্ষে মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের সভাপতি সিদ্দিক মিয়া এই রিট করেছিলেন। রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধের নির্দেশনা দেন। পরবর্তী সময়ে এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করে ব্যাটারিচালিত রিকশা মালিক সমিতি। আপিল বিভাগের সাত সদস্যের বেঞ্চ বিজ্ঞ হাইকোর্টের আদেশ বহাল রাখেন। এরপর চট্টগ্রামে ব্যাটারিচালিত রিকশার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয় সিটি করপোরেশন ও পুলিশ প্রশাসন। ব্যাপক অভিযানের মুখে এ ধরনের রিকশা চলাচল এক পর্যায়ে বন্ধ হয়ে যায়। তবে তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। এ কারণে বৈধর চেয়ে অবৈধ রিক্সার আদিক্য দিন-দিন বেড়েই চলেছে।

অভিযোগ রয়েছে, উচ্চ আদালতে রিটের দোহাই দিয়ে কতিপয় রিক্সা মালিক সমিতি স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাসহ এলাকা ভিত্তিক বিভিন্ন মহলকে ম্যানেজ করে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নগরীর অলিগলিতে এসব রিক্সা চলাচল অব্যাহত রেখেছে। সরেজমিনে ঘুরে নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী থানার বাংলাবাজার এলাকা ছাড়াও রৌফাবাদ কলোনীর মোড় থেকে স্টারশীপ পর্যন্ত সড়কে প্রায় পঞ্চাশ টিরও অধিক অবৈধ ব্যাটারি চালিত রিক্সা চলাচল করতে দেখা গেছে। অজ্ঞ এসব চালকরা স্বজোরে হর্ণ বাজিয়ে এলাকায় শব্দ দূষনের পাশাপাশি বেপরোয়া গতিতে রিকশা চালাতে গিয়ে প্রতিনিয়ত দূর্ঘটনাও ঘটাচ্ছে। স্টারশীপ থেকে রৌফাবাদ পর্যন্ত সড়কটি দিয়ে সরাসরি বায়েজিদ কিংবা অক্সিজেন-মুরাদপুর যোগাযোগের একটি অন্যতম মাধ্যম হওয়ায় সড়কটি দিয়ে ভারি যানবাহন চলাচলও বেড়ে গেছে। এর উপর আবার ব্যাটারি রিক্সা যোগ হওয়ায় প্রতিনিয়ত এ সড়কে যানজট লেগে থাকে। তথ্য মতে, নগরীতে প্রতিদিন কমপক্ষে ১৫ হাজারের বেশী ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল করে। বৈদ্যুতিক মোটরচালিত এসব রিকশার প্রতিটির ব্যাটারি চার্জ দিতে প্রতিদিন খরচ হয় পাঁচ ইউনিট করে বিদ্যুৎ। সে হিসেবে প্রতিদিন খরচ হয় ৫০ হাজার ইউনিট বা কিলোওয়াট (৫০ মেগাওয়াট) বিদ্যুৎ।

আর বিপুল পরিমাণ এই বিদ্যুতের অনেকটাই অবৈধভাবে ব্যবহার করা হয় বলে দাবি পিডিবির কর্মকর্তাদের। এছাড়াও ব্যাটারি রিক্সাকে কেন্দ্র করে টোকেন বানিজ্য, চাঁদাবাজির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। জানতে চাওয়া হলে, চট্টগ্রাম অটোরিকশা-অটোটেম্পো শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশীদ বলেন, ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও হাইকোর্ট ব্যাটারিচালিত অবৈধ রিকশা বন্ধের নির্দেশ দিলেও তা প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তার কারণে মানা হচ্ছে না, যা সরাসরি আদালত অবমাননার শামিল। তিনি বলেন, প্রতিদিন একেকটি রিকশা থেকে ১৩০ টাকা করে চাঁদা আদায় করছে নিয়ন্ত্রণ কারিরা। প্যাডেল চালিত রিক্সা চালক-মালিকরা ইতিমধ্যে ব্যাটারি রিকশা চলাচল বন্ধে সংবাদ সম্মেলনসহ জেলা প্রশাসককে স্মারকলিপি পেশ করেছে।

এ প্রসঙ্গে সিএমপির উপ-পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক উত্তর) মোহাম্মদ আলী হোসেন বলেন, আমাদের প্রধান সড়কগুলোর যানবাহন নিয়ন্ত্রণে ব্যস্ত থাকতে হয়। জনবল সংকটের কারণে অলিগলিতে সব সময় নজরদারি করা যায় না। এরপরও কোনো এলাকা থেকে অভিযোগ পেলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিই।