ঢাকা, বুধবার ৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০শে অগ্রহায়ণ ১৪৩১

২ নম্বর জালালাবাদ ওয়ার্ড চাঁদাবাজি, মাদক ও দখলের মহোৎসব

মো. এনামুল হক লিটন/সাহেনা আক্তার, চট্টগ্রাম : | প্রকাশের সময় : রবিবার ২৮ নভেম্বর ২০২১ ০৫:৩২:০০ অপরাহ্ন | চট্টগ্রাম প্রতিদিন

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) ২ নম্বর জালালাবাদ ওয়ার্ডে নিরব চাঁদাবাজি, মাদকের আগ্রাসন, পাহাড় কেটে জমি দখলের মহোৎসব এখানকার প্রধান সমস্যা। এছাড়া ফুটপাত দখল, কিশোর অপরাধিদের অপতৎপরতা, অবৈধ যানচলাচল এবং বাংলাবাজার, বায়েজিদ বোস্তামী মাজার, অক্সিজেন ও আশপাশের এলাকায় ফুটপাতে ভাসমান দোকান, গ্রাম সিএনজি, ব্যাটারি রিক্সা থেকে চাঁদাবাজি অবৈধ আয়ের অন্যতম উৎস। চলে আধিপত্যের লড়াইও।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ও ক্রাইম জোন হিসেবে পরিচিত বায়েজিদ বোস্তামী থানা এলাকায় ওয়ার্ডটির অবস্থান। অভিযোগ রয়েছে, বাংলাবাজার-আরেফিন নগর, আরেফিন নগর-ছিন্নমূল, বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিংক রোড, টেক্সটাইল-চন্দ্রনগর এবং বাংলাবাজার-ডেবার পাড় জামতলা সড়কে মহানগরীতে চলাচল নিষিদ্ধ প্রায় পাঁচ শতাধিক গ্রাম সিএনজি ট্যাক্সি ও বিদ্যুৎ খেকো ব্যাটারি চালিত রিক্সা চলাচল করছে অবৈধভাবে। একটি সিন্ডিকেট এসব ট্যাক্সি ও ব্যাটারি রিক্সা নিয়ন্ত্রণ করে দৈনিক ভিত্তিক চাঁদা আদায়ের মাধ্যমে। এছাড়া বাংলাবাজারে ও আশপাশের ফুটপাতে প্রায় ২শ-এর অধিক ভাসমান বাজার-দোকান বসিয়ে বেপরোয়া চাঁদাবাজি করছে কতিপয় কয়েক ব্যক্তি। এনিয়ে সম্প্রতি ঢাকা থেকে প্রকাশিত জাতীয় দৈনিক বায়ান্ন ও চট্টগ্রামের বহুল প্রচারিত দেনিক সাঙ্গু পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ হলে, প্রশাসন এসব বন্ধে তৎপর হয়ে ওঠলেও চাঁদাবাজ ও দালালচক্রের তদবীর বানিজ্য ও দৌড়ঝাঁপের কারণে থমকে যায় অভিযান। সূত্র মতে, স্থানিয় বায়েজিদ বোস্তামী থানা পুলিশ ও ট্রাফিক প্রশাসন ফুটপাত দখলমুক্ত করতে এবং অবৈধ যানচলাচল বন্ধে বারবার উদ্যোগ নিলেও ওই সিন্ডিকেট এবং দালাল চক্রের অপতৎপরতায় অনেকটা অসহায় হয়ে পড়ে তারা। তবে ওয়ার্ডের দূ-দুবার নির্বাচিত জনপ্রিয় কাউন্সিলর আলহাজ্ব শাহেদ ইকবাল এসব বন্ধে বরাবরই সোচ্চার ছিলেন বলে জানা গেছে। অন্যদিকে আধিপত্য বিস্তারের লড়াই,  চুরি-ছিনতাই, জুয়া আর মাদকের আগ্রাসন নিত্যদিনকার। পাহাড় কাটা ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিগত বছরগুলোতে দাঙ্গা-হাঙ্গামা, খুনোখুনির ঘটনা ছাড়াও বর্তমানে সত্য-মিথ্যা মামলা-অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ দায়ের লেগেই আছে। এসব অভিযোগ নিয়ে পুলিশকেও বিভ্রতকর অবস্থায় পড়তে হয় বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, বায়েজিদ বোস্তামী থানার একজন উপ পরিদর্শক (এসআই)। সূত্র জানায়, সরকার দলীয় কতিপয় নেতা ও বড় ভাই হিসেবে পরিচিতরা সামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে থানায় অভিযোগ দায়েরের পরামর্শ দেয় এবং অভিযোগটি গ্রহণের জন্যও থানায় তদবীর চালায়। পরবর্তীতে মীমাংসার নামে চলে উভয় পক্ষ থেকে ফায়দা হাসিল। এতে করে ভূক্তভোগীরা যেমনি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে, তেমনি পুলিশেরও স্বাভাবিক কাজে ব্যাঘাত ঘটছে। ওয়ার্ডটির আয়তন ৬.৪৮ বর্গ কিলোমিটার (২.৫০ বর্গমাইল)। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী ২ নম্বর জালালাবাদ ওয়ার্ডের মোট জনসংখ্যা ১,০৩,৩১৪ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৫৩,৬২০ জন এবং মহিলা ৪৯,৬৯৪ জন। মোট পরিবার ২৪,৭০৩টি। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের উত্তরাংশে জালালাবাদ ওয়ার্ডের অবস্থান। এর উত্তরে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ১নং দক্ষিণ পাহাড়তলী ওয়ার্ড ও হাটহাজারী উপজেলার চিকনদন্ডী ইউনিয়ন, পূর্বে হাটহাজারী উপজেলার শিকারপুর ইউনিয়ন, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ৩নং পাঁচলাইশ ওয়ার্ড ও ৭নং পশ্চিম ষোলশহর ওয়ার্ড, দক্ষিণে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ৩ নম্বর পাঁচলাইশ ওয়ার্ড ও ৮নং শুলকবহর ওয়ার্ড এবং পশ্চিমে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ৯নং উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ড ও সীতাকুন্ড উপজেলার সলিমপুর ইউনিয়ন অবস্থিত। ওয়ার্ডটির প্রশাসনিক কাঠামো হচ্ছে, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন ২নম্বর ওয়ার্ড। এ ওয়ার্ডের প্রশাসনিক কার্যক্রম চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের বায়েজিদ বোস্তামী থানার আওতাধীন এবং ২৮২ নং চট্টগ্রাম-৫ জাতীয় নির্বাচনী এলাকার অংশ। এখানকার উল্লেখযোগ্য এলাকা অক্সিজেন, কুলগাঁও, গ্রীনভ্যালি, রউফাবাদ, ও শেরশাহ কলোনী। ওয়ার্ডের শিক্ষা ব্যবস্থা বলতে ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ি সাক্ষরতার হার ৬৭.৩%। এ ওয়ার্ডে ১টি বিশ্ববিদ্যালয়, ১টি মেডিকেল কলেজ, ২টি কলেজ, ৩টি মাদ্রাসা, ১টি স্কুল এন্ড কলেজ, ৪টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১টি নিন্ম মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও ৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। ওয়ার্ডটিতে চট্টগ্রাম সেনানিবাস ও বায়েজিদ বোস্তামী (র.) মাজার, নান্দনিক পার্ক। কয়েকটি বাজার অসংখ্য মসজিদ, মাদ্রাসা, মন্দির ও বৌদ্ধ বিহার রয়েছে। এছাড়া রয়েছে অসংখ্য শিল্প কারখানাও। সরেজমিনে ওয়ার্ডের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ও বাসিন্দাদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, একসময় ওয়ার্ডটি অবহেলিত থাকলেও  বিগত ৫ বছরে ওয়ার্ডের ব্যাপক উন্নয়ণ হয়েছে। ভাঙ্গা ও আধা কাঁচা সড়কের দেখা না মিললেও অক্সিজেন ও বটতলের মাঝামাঝি এলাকার ঝাঁড়–য়ার দিঘীর পাড় প্রবেশ মুখ থেকে ভেতরের কিছু সড়কের অংশে উন্নয়ণ কাজ চলমান থাকায় বাসিন্দাদের কিছুটা ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। জেরিন আবছার নামে এক বাসিন্দা জানান, ভাই খুব কষ্টে আছি। সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, এই সড়কের ড্রেনের পাশের দোকান পাটগুলোর মালামাল দোকানের বাইরে অথ্যাৎ নালার ¯ø্যাবের উপর রাখার কারণে পথচারি ও বাসিন্দারা রাস্তার উপর দিয়ে চলাচল করতে হয়। ওই সড়কটি দিয়ে সিএনজি ট্যাক্সির চলাচল অত্যন্ত বেশী বলে জানিয়েছেন, স্থানিয় বাসিন্দারা। অনুসন্ধানে জানা যায়, মহানগরীতে চলাচল নিষিদ্ধ সিএনজি ট্যাক্সিগুলো পুলিশী ঝামেলা এড়াতে মূল সড়ক দিয়ে চলাচল না করে এই সড়ক দিয়ে চলাচল করে। ফলে মানুষের দূর্ভোগ আরো বেড়ে যায়। অপরদিকে অক্সিজেন মোড়ে চট্টগ্রাম উন্নয়ণ কর্তৃপক্ষের (সিডিএ)-এর জলাবদ্ধতা নিরসণ প্রকল্পের কাজের জন্য খুঁড়াখুড়ির কারণে সবসময় যানজট লেগে থাকে অক্সিজেন মোড়ে। এর প্রভাব পড়ে অন্যান্য সড়কেও। এছাড়া ওয়ার্ডের নতুন পাড়া ও বিআরটিএ-এর সামনে রাস্তার ওপর  অবৈধ ট্যাক্সি পাকিংয়ের কারণে সার্বক্ষণিক যানজট বিশৃঙ্খলা লেগে থাকে। ওয়ার্ডের কয়েকটি এলাকায় চুরি-ছিনতাই, কিশোর গ্যাংয়ের অপতৎপরতাসহ মাদক ব্যবসায়ি ও সেবীদের উৎপাতের কথাও জানিয়েছেন কেউ-কেউ। ওয়ার্ডের বিভিন্ন এলাকার স্থানিয় বাসিন্দাদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, এক সময়ে এই ওয়ার্ডটি ছিল খুব অবহেলিত। বিগত পাঁচ বছরে ওয়ার্ডটিকে অনেক আধুনিকায়ন করেছেন, কাউন্সিলর আলহাজ্ব শাহেদ ইকবাল বাবু। এবারও তিনি পূনরায় কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়ে এলাকার উন্নয়ণে প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখছেন বলে জানিয়েছেন, কুঁলগাও  মাইজপাড়া এলাকার স্থানিয় বাসিন্দা মো. খয়রাতি মিয়া। তিনি জানান, কাউন্সিলর শাহেদ ইকবাল বাবু  পূনরায় নির্বাচিত হয়ে সার্বক্ষনিক ওয়ার্ডের খোঁজ খবর নিচ্ছেন। তবে ওয়ার্ডের বিভিন্নস্থানে মশার উপদ্রব বেশী বলে জানিয়েছেন, কয়েক এলাকার বাসিন্দারা। ওয়ার্ডের সচিব মো. শহীদ আকতার জানান, মশক নিধনসহ পরিছন্নতা অভিযান চলমান রয়েছে। ওয়ার্ডের সমস্যা-সম্ভাবনা নিয়ে গতকাল এ প্রতিবেদক কাউন্সিলরের শরনাপন্ন হলে তিনি বলেন, চসিক মেয়রের নের্তৃত্বে চট্টগ্রামের উন্নয়ণ ও অগ্রগতির পথে যে যাত্রা তা আরো বেগবান করতে ২ নম্বর জালালাবাদ ওয়ার্ডকে ঢেলে সাজাতে চাই। এ লক্ষ্যে তিনি ওয়ার্ডবাসীর সহযোগীতা কামনা করে বলেন, কাউন্সিলর হিসেবে আমি দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হওয়ার পর ওয়ার্ডের প্রতিটি এলাকা ঘুরে-ঘুরে পরিদর্শন করেছি এবং যেখানে সমস্যা ছিল সেখানে তাৎক্ষনিকভাবে সমাধানের পদক্ষেপ নিয়েছি। তিনি বলেন, আমার গত মেয়াদে ১৭০ কোটি টাকার উন্নয়ণ কাজ করেছি। এটি সিটি কর্পোরেশনের সর্বোচ্চ বরাদ্ধ। তিনি ওয়ার্ডটিকে ঢেলে সাজাতে এবং সন্ত্রাস-চাঁদাবাজ, মাদকমুক্ত, সুন্দর, আধুনিক ও নান্দনিক ওয়ার্ড হিসেবে গড়ে তুলতে ওয়ার্ডবাসীর সর্বাতœক সহয়োগীতাও কামনা করেছেন।