দিনদিন বাড়ছে জনপ্রতিনিধি-আমলা দ্বন্দ্ব। মাঠ প্রশাসন থেকে শুরু করে কেন্দ্র পর্যন্ত প্রায় অভিন্ন চিত্র। সবখানেই কমবেশি বিরোধ এখন ওপেন সিক্রেট। গত আগস্টে বরিশালে ইউএনওর বাসভবনের সংঘাতকে কেন্দ্র করে এ দ্বন্দ্ব দেশে উত্তাপ ছড়িয়েছিল। ওই ঘটনার মামলায় সিটি মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহকে হুকুমের আসামি করা হয়।
এ ঘটনায় ‘রাজনৈতিক দুর্বৃত্ত’ শব্দ ব্যবহার করে প্রতিক্রিয়া জানায় প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন। ফলে সব মহলে সমালোচনার ঝড় ওঠে। এর আগে ২০২০ সালে ফরিদপুরের জেলা প্রশাসককে হুমকি এবং ইউএনওর ফোনে এসিল্যান্ডকে অকথ্য ভাষায় গালাগালের অভিযোগে স্থানীয় সংসদ সদস্য মুজিবর রহমান চৌধুরী নিক্সনের বিচার চেয়েছিল সংগঠনটি। পরে সরকারের উচ্চপর্যায়ের হস্তক্ষেপে তা নিরসন হয়।
উপজেলা চেয়ারম্যান ও পৌর মেয়রদের সঙ্গেও ক্ষমতার দ্বন্দ্বে দূরত্ব বাড়ছে মাঠ প্রশাসনের। চেয়ারম্যানদের অভিযোগ, ইউএনওরা সরকারি নির্দেশনা অনুসরণ না করায় উপজেলা পরিষদ অকার্যকর হয়ে পড়েছে। ভালো নেই পৌরসভাও। পাবনার বেড়া পৌরসভার মেয়র আবদুল বাতেন মাসিক সমন্বয় সভায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আসিফ আনামকে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল ও শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন। এ ঘটনায় পৌর মেয়রকে সাময়িক বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার বিভাগ। করোনাভাইরাসের সময় জনপ্রতিনিধিদের বাদ দিয়ে ত্রাণ তৎপরতা ও স্বাস্থ্যসেবা সমন্বয়ে সচিবদের দায়িত্ব দেওয়ায় সমালোচনা হয় জাতীয় সংসদে। প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়েও রয়েছে মন্ত্রী-সচিব দ্বন্দ্বের অসংখ্য নজির। মন্ত্রীর সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় মন্ত্রণালয় ছেড়ে অন্য মন্ত্রণালয়ে যাওয়ার নজিরও রয়েছে। ফলে জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কর্মকর্তাদের বিরোধ যে তুঙ্গে এসব ঘটনায় পরিষ্কার।
জানতে চাইলে সংবিধান ও বিদ্যমান আইন-বিধি মেনে দায়িত্ব পালনের পরামর্শ দিয়েছেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভুইঞা। তিনি গতকাল বলেন, ‘জনপ্রতিনিধি ও সরকারি কর্মকর্তারা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সংবিধান অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ আর এই জনগণের মালিকানা প্রয়োগ হতে হবে অবশ্যই সংবিধানসম্মতভাবে। সংবিধান ও সংশ্লিষ্ট বিদ্যমান আইনে স্পষ্টভাবে জনপ্রতিনিধি ও কর্মকর্তাদের কর্মপরিধি ও দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট করা আছে। জনপ্রতিনিধি ও কর্মকর্তা কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নন। সবাইকে যার যার ঊর্ধ্বতনের কাছে জবাবদিহি করার বিধান রয়েছে। কে কার কাছে কীভাবে জবাবদিহি করবে তা মনে রেখে নিজ কর্মপরিধি অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করলে দ্বন্দ্ব কমে যাবে। দ্বন্দ্ব তখনই হয় যখন যে কোনো পক্ষ সীমা লঙ্ঘন করে।’ তবে গণতান্ত্রিক অবস্থানে একটু-আধটু দ্বন্দ্ব থাকা অস্বাভাবিক নয় বলেও মন্তব্য করেন এই আমলা।
মোশাররাফ ভুইঞা আরও বলেন, ‘ফরিদপুর বা বরিশাল যে ঘটনাই বলুন না কেন এসব ঘটনার পেছনে অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে উভয় পক্ষই তাদের লিমিট ক্রস করেছে। তারা কেউ না কেউ নিজেদের সীমা অতিক্রম করেছেন। ফলে এ বিরোধ কমাতে হলে উভয় পক্ষকেই নিজ কর্মপরিধি মনে রেখে জবাবদিহিতার বিষয়টি খেয়াল করে আরও সংযত হতে হবে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অপর একজন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ব্যক্তিগত ইগো ও অতিমাত্রার রাজনীতির কারণেই অনাকাক্সিক্ষত ঘটনাগুলোর সূত্রপাত। বরিশালের ঘটনার উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, উপজেলা পরিষদ চত্বরের ব্যানার অপসারণের ক্ষমতা কিন্তু সিটি করপোরেশনের নেই। অন্যদিকে এ বিষয়টির জন্য সংশ্লিষ্ট ইউএনও নিজে সামনে না গিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যানকে সামনে আনতে পারতেন। তাহলে দুই জনপ্রতিনিধি বিষয়টি সমাধান করতে পারতেন। কিন্তু ওই ঘটনায় পুলিশ-আনসারদের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়েছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা। শেষ পর্যন্ত ঘটনা দাঁড়ায় বরিশাল সিটি মেয়র বনাম ইউএনওতে। মেয়রের বিরুদ্ধে একটি মামলায় বাদী হন ইউএনও। আবার মেয়র পক্ষের মামলার আসামি তিনি। সিটি মেয়র বরিশালের আওয়ামী লীগ নেতা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর ছেলে। তাই ঘটনার পর স্বাভাবিকভাবেই তার পক্ষে দাঁড়ায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ।
অন্যদিকে ইউএনও মুনিবুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা। সমসাময়িক শিক্ষার্থী ও ছাত্রনেতারা তার জন্য সামাজিকমাধ্যমে সরব হয়। তার পক্ষে সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থান নেয় প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সংগঠন অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন। তাদের বিবৃতিতে ‘রাজনৈতিক দুর্বৃত্ত’ শব্দমালা ব্যবহারের কারণে বুমেরাং হয়ে যায়।
জানা গেছে, ক্ষমতার দ্বন্দ্বে কেন্দ্র থেকে মাঠ প্রশাসনে এবং মন্ত্রী-এমপিদের মধ্যে দূরত্ব বাড়ছে। কোথাও কোথাও সম্পর্ক শীতল হচ্ছে। কোথাও কোথাও ঠান্ডা যুদ্ধও চলছে। প্রয়োজনে ক্ষেত্রবিশেষে সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করাচ্ছেন প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধিরা। আবার সুযোগ পেলে জনপ্রতিনিধিদের এক হাত দেখে নিতেও পিছপা হন না কোনো কোনো কর্মকর্তা। কিছু আমলা সবকিছু নিজের কব্জায় রাখার মনোভাব পোষণ করায় এমন ঘটনা ঘটছে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে দ্বন্দ্বের শুরু জনপ্রতিনিধিদের কারও কারও প্রভু সুলভ আচরণে। হুমকি-ধমকির মাধ্যমে ক্ষমতা প্রদর্শনের পরিণতিতে। দেশের কোথাও কোথাও পৌর মেয়রদের অনৈতিক কথা না শোনায় কর্মস্থল থেকে কর্মকর্তাদের পালাতে হয়েছে। জনপ্রতিনিধি ও আমলাদের অপ্রত্যাশিত দ্বন্দ্বে দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ড বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে উপজেলা চেয়ারম্যানদের সংগঠন বাংলাদেশ উপজেলা পরিষদ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হারুন-অর-রশীদ হাওলাদার বলেন, ‘সাংবিধানিক নির্দেশনা ও আইন প্রতিপালন না করে প্রতিটি স্তরে জনপ্রতিনিধিবিহীন একক কর্তৃত্বে জনপ্রশাসন পরিচালনার জন্যই আজকের এই দাম্ভিকতা ও দ¦ন্দ্ব। প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ, তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা করবেন সরকারের প্রতিনিধিত্ব, রাষ্ট্রের কর্মচারীরা কাজ করবেন প্রতিটি স্তরে নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানের অধীন। চাকরি করেন উপজেলায়, জবাবদিহিতা জেলায়- এটা সাংবিধানিক শাসনের পরিপন্থী।’
করোনাভাইরাসে স্বাস্থ্যসেবা ও অন্যান্য সরকারি কার্যক্রম সমন্বয়ে ৬৪ জেলায় সচিবদের দায়িত্ব দেওয়ার ইস্যুতে গত জুনে উত্তপ্ত হয় জাতীয় সংসদ। ওই দায়িত্ব দেওয়ার মাধ্যমে রাজনীতিবিদদের কর্তৃত্ব, কাজ ম্লান হয়ে যায় বলে মন্তব্য করেন প্রবীণ সংসদ সদস্য তোফায়েল আহমেদ। তিনি বলেন, তাদের ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে জেলার দায়িত্ব পেতেন মন্ত্রীরা। এখন সেটা আমলারা নিয়ে নিয়েছে। জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, দেশ চালাচ্ছে জগৎশেঠ আর আমলারা। রাজনীতিবিদরা এখন তৃতীয় লাইনে। এ ছাড়া আমলাদের সিদ্ধান্তে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রীও। করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে এ সংক্রান্ত একটি জাতীয় কমিটির সভাপতি স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। কিন্তু সভাপতি হলেও অনেক সিদ্ধান্ত তাকে না জানিয়ে নেওয়া হয় বলে গত এপ্রিলে প্রকাশ্যে অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের থেকে সিদ্ধান্ত না নিলেও অন্তত পরামর্শ তো করতে পারে। আমরা তাহলে আমাদের মতামতটা দিতে পারি। আমি দেশ-বিদেশের সাংবাদিকদের প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছি। তাদের প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারি না।’