ঢাকা, রবিবার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১

গদখালী ফুলচাষিদের নতুন শঙ্কা ওমিক্রন

যশোর প্রতিনিধি : | প্রকাশের সময় : বুধবার ১৯ জানুয়ারী ২০২২ ০৭:৩৬:০০ অপরাহ্ন | জাতীয়

মহামারি করোনা ও ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের কারণে টানা দুই বছর মন্দাভাব বিরাজ করছে যশোরের গদখালির ফুলের রাজ্যে। তবে এবার নতুন উদ্যোমে বাগানের পরিচর্যা শুরু করেছেন ফুলচাষিরা। তাদের টার্গেট পহেলা ফালগুন, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ও মহান শহীদ দিবস এবং স্বাধীনতা দিবসে ফুল বিক্রি করে আগের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া। কিন্তু ঘুরে দাঁড়ানোর মুখে হঠাৎ করোনার ধরণ ওমিক্রন চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে চাষিদের।

যশোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, চলতি বছর ঝিকরগাছার গদখালি ও পানিসারা এলাকায় সাড়ে ৬শ’ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন জাতের ফুল চাষ হয়েছে। করোনাকাল কাটিয়ে উঠে এখানকার চাষিরা অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন। এবার ফুলের উৎপাদন, চাহিদা ও দাম সবই বেশ ভালো ছিল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে ক্ষতি পুষিয়ে লাভবান হবেন ফুলচাষিরা।

স্থানীয় ফুলচাষি আমজেদ পাঠান এবছর দেড় বিঘায় গোলাপ, ১২ কাটা জমিতে জারবেরা ও দেড় বিঘা জমিতে গাঁদা চাষ করেছেন। ফুলে ফুলে ভরে গেছে বাগান। তবে করোনার বিধিনিষেধে ইতোমধ্যে সামাজিক ও রাজনৈতিক অনুষ্ঠান বন্ধ হওয়ায় কমতে শুরু করেছে ফুলের দাম। এমন পরিস্থিতিতে সামনের দিবসগুলোতে ফুল বিক্রি নিয়ে সংশয়ে পড়েছেন তিনি।

তিনি বলেন, করোনা আর আম্ফানে লন্ডভন্ড হওয়া ফুলবাগান ব্যাংক ও এনজিও থেকে ৮ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে ফের ঘুরে দাড়াতে চেষ্টা করছি। গত নভেম্বর থেকে ফুল বেচাকেনা শুরু করেছি। ১৪ ও ১৬ ডিসেম্বর দুই দিবসে ২ লাখ টাকার ফুল বিক্রি করেছি। আশা করেছিলাম, সামনের দিবসে ভালো দামে ফুল বিক্রি করতে পারলে ৮ লাখ টাকার ঋণ শোধ করতে পারব। কিন্তু জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকে করোনার নতুন ধরণ ওমিক্রন হানা দিয়েছে। এরই মধ্যে এ ধরণ যশোরে দেখা দিয়েছে। ফুলের ভরা মৌসুমে সরকার সব অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ায় কমে গেছে দাম। কোনো কারণে যদি আবার ফুল বেচাকেনায় ভাটা পড়ে তাহলে পথে বসা ছাড়া গতি থাকবে না। 

যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালি ও পানিসারা ইউনিয়ন। এই দুই ইউনিয়নসহ আশপাশের এলাকায় হাজার হাজার একর জমিতে বছরজুড়ে উৎপাদন হচ্ছে দেশি-বিদেশি নানা জাতের ফুল। যেদিকে চোখ যায় শুধু ফুল আর ফুল। ফুলে ফুলে রঙিন হয়ে আছে মাঠগুলো। পথের দুই ধারে গোলাপ, রজনীগন্ধা, গ্ল্যাডিওলাস, গাঁদা, জারবেরার ক্ষেত। লাল, নীল, হলুদ, বেগুনি আর সাদা রঙের এক বিস্তীর্ণ বিছানা যেন বিছিয়ে রেখেছে। এ দৃশ্যে চোখ জুড়ানোর পাশাপাশি হৃদয়ও জুড়িয়ে যায়।  দেশে উৎপাদিত ফুলের ৭০ ভাগ যোগান হয় এখান থেকে। যেখানে গেলে চোখে পড়বে কৃষকদের ব্যস্ততা। কেউ ফুল কেটে বাজারে নিয়ে যাচ্ছেন, সেখান থেকেই বান্ডিল করে চালান হয়ে যাচ্ছে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে। কেউ ফুল কাটছে, কেউ নিড়ানি দিচ্ছেন। ফুলের ভরা মৌসুমের এমন কর্মব্যস্ততায় মুখে চওড়া হাসি থাকার কথা থাকলেও করোনা নতুন ধরণ ওমিক্রনে চিন্তার ভাজ এখানকার ফুল চাষিদের কপালে।

পানিসারা এলাকার ফুলচাষি হিরু শেখ জানান, গেল দুই বছর লকডাউনের কারণে ফুল বিক্রি করতে না পেরে নিঃস্ব হতে বসেছিলাম। কেউ আবার ফুলের আবাদ ছেড়ে অন্য ফসলের আবাদ শুরু করেছেন। করোনার প্রকোপ কিছুটা কমায় গেল সেপ্টেম্বর থেকে ঘুরে দাঁড়াতে ঋণ নিয়ে নতুন করে শুরু করেছিলাম ফুলের আবাদ। কিন্তু চার মাস ফুল পরিচর্যা করে ভরা মৌসুমে এসে চিন্তা ভর করেছে। পানিসারার হাঁড়িয়াদাড়া এলাকার ফুলচাষি সাঈদ আলী জানান, ২০ হাজার টাকা খরচ করে দেড় বিঘা জমিতে গাঁদা ফুল চাষ করেছি। ডিসেম্বর পর্যন্ত ভালো দাম ছিল। তবে জানুয়ারি থেকে করোনা আবারও বাড়ায় অনুষ্ঠান বন্ধ হচ্ছে। সেইসঙ্গে আমাদের ফুল বেচাকেনায় ধস নেমেছে।

গদখালির টাওয়া গ্রামের চাষি নিমাজ উদ্দিন বলেন, করোনার কারণে গত বছর বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ও পয়লা ফালগুনে কোনো উৎসব হয়নি। ফলে ফুল বিক্রি করতে পারিনি। তবে গেল বছরের সেপ্টেম্বর থেকে করোনা স্বাভাবিক হওয়ায় ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন অনুষ্ঠান হওয়ায় ফুল বেচাকেনা ছিল ভালো। এবছরও করোনা হানা দিয়েছে। তাই ফুল বিক্রি হওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে আছি। 

গদখালি বাজারে চাষি ও স্থানীয় পাইকার ব্যবসায়ী ইসমাঈল হোসেন বলেন, বর্তমানে ফুলের বাজার খারাপ। লকডাউন না দিলেও করোনা আতঙ্কে ফুল বেচাকেনা কম। বর্তমানে বাজারে প্রতি হাজার গাঁদা ফুল বিক্রি হচ্ছে ২শ’ টাকা। যা সপ্তাহ খানেক আগে ছিল ৮ থেকে ৯শ’ টাকা। একেকটি গোলাপ বিক্রি হচ্ছে ২ টাকা, যা আগে বিক্রি হয়েছে ৪/৬ টাকায়। রজনীগন্ধা একেকটি বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ৫ থেকে ৬ টাকায়, যা আগে ছিল ৭/১০ টাকায়। 

রঙিন গ্ল্যাডিউলাস প্রতিটি মানভেদে বিক্রি হচ্ছে ৬/৯ টাকায়, যা আগে ছিল ৯ থেকে১৫ টাকায়। জারবেরা বিক্রি হচ্ছে ৬/৮টাকায়, যা আগে ছিল ৮থেকে ১৫ টাকায়। কামিনী পাতা বিক্রি হচ্ছে প্রতি আঁটি ৩০/৪০ টাকা, যা আগে ছিল ৫০/৬০ টাকা। জিপসির আঁটি বিক্রি হয়েছে ২০/৩০ টাকা, যা আগে বিক্রি হতো ৩০থেকে ৪৫ টাকায়।

ফ্লাওয়ার্স সোসাইটির সভাপতি আব্দুর রহিম এ প্রতিবেদককে বলেন, ফুলের ব্যবসা মূলত অনুষ্ঠানকেন্দ্রিক। গত দুই বছর লকডাউনের কারণে ফুল বিক্রি করতে না পেরে নিঃস্ব হতে বসেছিল চাষিরা। কেউ আবার ফুলের আবাদ ছেড়ে অন্য ফসলের আবাদ শুরু করেছিলেন। করোনার প্রকোপ কিছুটা কমায় ঘুরে দাঁড়াতে ঋণ নিয়ে নতুন করে শুরু করেন ফুলের আবাদ। কিন্তু ঘুরে দাঁড়ানোর মুখে নতুন দরণ ওমিক্রন চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে তাদের কপালে। লকডাউন হলে ফুলের বাজার বলে আর কিছু থাকে না। আমরা আশা করব সরকার আমাদের দিকে দৃষ্টিপাত করবে।