ঢাকা, মঙ্গলবার ১১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ২৯শে মাঘ ১৪৩১

চট্টগ্রাম আইআইইউসিতে কওমীপন্থী ১০ শিক্ষককে অব্যাহতি, সমালোচনার ঝড়

শফকত হোসাইন চাটগামী, বাঁশখালী | প্রকাশের সময় : সোমবার ১০ ফেব্রুয়ারী ২০২৫ ০৩:৩১:০০ অপরাহ্ন | চট্টগ্রাম প্রতিদিন
অব্যাহতি পাওয়া ১০ কওমী শিক্ষক

আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের শিক্ষকতার পদ থেকে কোন ধরনের কারণ দর্শানো ছাড়াই বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা গ্রেজুয়েট কওমী আলেমদেরকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। অব্যাহতি পাওয়া অধিকাংশ শিক্ষকের বাড়ি চট্টগ্রামের বাঁশখালী এবং কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলায়।

আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম (আইআইইউসি) থেকে কওমীপন্থী ১০ শিক্ষককে অন্যায়ভাবে অব্যাহতি দেয়ার ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সর্বত্র তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। সব ধরণের যোগ্যতা ও দক্ষতা থাকা সত্বেও শুধুই কওমী মাদ্রাসা থেকে উঠে আসায় এবং জামায়াতের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত না থাকার অপরাধে তাদের বাদ দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

এনিয়ে কয়েকদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক লেখালেখি ও সমালোচনা সৃষ্টি হয়েছে। আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগ আমলে ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান সাবেক এমপি আবু রেজা মো. নেজাম উদ্দীন নদভী কর্তৃক অবৈধ পন্থায় ওই শিক্ষকদের নিয়োগের কথা বলা হলেও অব্যাহতি পাওয়া শিক্ষকরা বলছেন, সব ধরনের নিয়ম-কানুন মেনে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি, লিখিত ও ভাইভা পরীক্ষা দিয়েই তাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। নদভী আমলের বলে শুধু কওমী ব্যাক গ্রাউন্ডের কারণেই তাদের ছাটাই করা হয়েছে।

অব্যাহতি পাওয়া ১০ শিক্ষক হলেন, দাওয়াহ বিভাগের প্রভাষক ড. আবদুর রহিম ; যিনি আইআইইউসি থেকে কৃতিত্বের সাথে অনার্স ও মাস্টার্স পাস করেছেন। এছাড়াও আবদুর রহিম সৌদি আরবের কিং আবদুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেছেন। হাদিস বিভাগের প্রভাষক ড. আসেম মক্কী সৌদি আরবের মক্কা নগরীর উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স, মাস্টার্স ও পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। কোরানিক সাইন্স এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের লেকচারার ড. মাওলানা আব্দুস সালাম রিয়াদী সৌদি আরবের রিয়াদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেছেন। 

এছাড়াও কুরআনিক সাইন্সেস বিভাগের প্রভাষক মাওলানা হারুন আজিজি নদভী আইআইইউসি থেকে মাস্টার্স পাস করেছেন। তিনি গ্রাজুয়েশন সমাপ্ত করেছেন ভারতের নদওয়াতুল উলামা থেকে। তিনি এর আগে জামিয়া ইসলামিয়া বাবুনগরের দাওরায়ে হাদিস ও সিনিয়র মুহাদ্দিস ছিলেন। কোরানিক সাইন্স এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের লেকচারার মাওলানা শাহাদাত হোসাইন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিল গবেষক। কোরানিক সাইন্স এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের লেকচারার মাওলানা মিসবাহ উদ্দিন মাদানী একজন অভিজ্ঞ আলেম। এছাড়াও হজের খুতবার বাংলা অনুবাদক ড. শুয়াইব রশীদ মাক্কী সৌদি আরবের উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেছেন। তিনি দাওয়াহ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের লেকচারার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। হাদীস এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের লেকচারার মাওলানা ইহতিশামুল হক মাদানীকেও অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। বাদ পড়া এরাবিক বিভাগের লেকচারার মাওলানা যুহাইর ফুরকান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গোল্ডমেডেলিস্ট ও এমফিল গবেষক এবং এরাবিক বিভাগের লেকচারার মাওলানা কাউসার মাহমুদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিল গবেষক।

জানা গেছে, ২০২২ সালের ২৮ জুন তারিখের বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা ও বিশ্ববিদ্যালয় ওয়েবসাইটে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের সার্কুলার প্রকাশ করা হয়। যাতে ৫ দিন সময় দিয়ে আবেদন আহ্বান করা হয়। সার্কুলারের ভিত্তিতে নতুন এডহক শিক্ষকবৃন্দ এবং বাহির থেকে আরও অনেকেই আবেদন করেন। নিয়মতান্ত্রিক রিটেন ও ভাইভা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ২০২২ সালের ৩০ জুলাই অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৪২তম সিন্ডিকেট মিটিং-এ অনুমোদন সাপেক্ষে নির্বাচিত শিক্ষকদেরকে স্থায়ী নিয়োগপত্র প্রদান করা হয়, যা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) কর্তৃকও অনুমোদিত হয়ে আসে।

তারা নিয়মিত দক্ষতার সাথে শিক্ষকতা করে আসছিলেন। কিন্তু জুলাইয়ের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পর আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি আবু রেজা নদভী আত্মগোপনে চলে গেলে আনম শামসুল ইসলাম পুনরায় বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ারম্যান হন।

গত ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে বর্তমান প্রশাসন নতুনভাবে শিক্ষক- কর্মকর্তা-কর্মচারীর চাহিদা দেখিয়ে সার্কুলার প্রকাশ করে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আবু রেজা নদভীর আমলে যথাযথ প্রক্রিয়ায় নিয়োগ পাওয়া সকল শিক্ষককেও পুনরায় আবেদন করতে বাধ্য করে। সে সময় অনেককে কৌশলে বাদ দেয়া হয়। বাদ পড়াদের মধ্যে এই ১০ জন কওমী ব্যাকগ্রাউন্ডের দক্ষ প্রাজ্ঞ শিক্ষকও রয়েছেন।

বাদ পড়া শিক্ষক আবদুস সালাম রিয়াদী জানান, আমাদের সম্পুর্ণ অন্যায়ভাবে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। বৈষম্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জাতি স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনলেও আমাদের উপর বৈষম্য করা হয়েছে। 

মাওলানা মিসবাহ উদ্দিন মাদানী জানান, কওমি অঙ্গনে প্রচণ্ড ক্ষোভ প্রকাশ পাওয়ার কারণ হলো, আবু রেজার আমলে নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে যারা কওমি তাদের একজনকেও রাখা হয়নি। অথচ একই সময়ে নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন, যারা শুধুমাত্র জামায়াত সমর্থক অথবা ট্রাস্টি মেম্বারদের কারও না কারও আত্মীয় হওয়ার সুবাদে স্বীয় পদে বহাল আছেন।

অব্যাহতিপ্রাপ্ত শিক্ষকদের অভিযোগ, বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশে দলীয় ও আত্মীয় কোটায় শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে মেধাকে অবমূল্যায়ন করায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্র, সারাদেশের মানুষ, বোদ্ধামহল ও বিশেষভাবে কওমি অঙ্গনে ব্যাপক নিন্দা ও সমালোচনার ঝড় সৃষ্টি হয়। সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে সারাদেশের মানুষ বিষয়টি প্রত্যক্ষ করেছে। নদভীর আমলে যথাযথ নিয়োগ প্রক্রিয়া অবলম্বন করে নিয়মিত পদে শরিয়াহ অনুষদের তিনটা বিভাগ ও কলা অনুষদের আরবি বিভাগে নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে যারা নন-জামায়াতী ও কওমিপন্থী, তাদের সবাইকে ছাঁটাই করে কেবল যারা নিজে জামায়াত করে অথবা যাদের পিতা বা পরিবার জামায়াত করে তাদেরকে বহাল রেখে প্রতিষ্ঠানকে দলীয়করণের অভিযোগ এসেছে চট্টগ্রামের আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসনের বিরুদ্ধে।

এ প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের রেজিস্ট্রার কর্ণেল মোহাম্মদ কাশেমকে ফোন দেওয়া হলে তার নম্বরটি বন্ধ পাওয়ায় বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।

বায়ান্ন/প্রতিনিধি/পিএইচ