একটি বেসরকারি ক্লিনিকে ওটি বয় হিসেবে কর্মরত ছিলেন মাসুদ রানা। ক্লিনিকটির শুরু থেকে প্রায় বিশ বছর ধরে সুনামের সাথে কাজ করেছেন তিনি। করোনায় হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যায় প্রতিষ্ঠানটি। অসময়ে চাকরী হারিয়ে দিকবিদিকশুন্য হয়ে পরে মাসুদের জীবন। একদিকে করোনার প্রকোপ আরেকদিকে চাকরী হারিয়ে মানসিক ভাবে ভেঙে পরে সে ও তার পরিবার। কোন কাজ ছাড়াই বাড়িতে বসে কাটিয়ে দেয় দুটি মাস।
অভাবের সংসারে মাসে যা আয় হতো তা দিয়ে সংসারের ভরণপোষণ আর সন্তানদের পড়াশোনা করাতে খরচ হয়ে যেত। অধিক পরিমাণ টাকা জমানোর কোন সুযোগ ছিলনা। তবে দীর্ঘ সময় চাকরি করায় কিছু টাকা জমিয়ে ছিলেন তিনি। সংসারের খরচের টাকা জোগাড়ের জন্য নতুন কিছু করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। বসে না থেকে জমানো সব টাকা দিয়ে একটি অটো ক্রয় করে সেটি চালানো শুরু করেন। তবে বিধি বাম। এক মাস যেতে না যেতে অটো গাড়িটি চুরি হয়ে যায়। অনেক দৌড়ঝাঁপ করেও সেটিকে আর পাওয়া সম্ভব হয়নি।
একদিকে পরিবারের ভরণপোষণ, সন্তানদের পড়াশোনার খরচ অপরদিকে চাকরী ও শেষ সম্বল হারিয়ে নিরুপায় হয়ে পরে মাসুদ রানা। এভাবে কতদিন আর পরিবারের সদস্যদের মুখে দেখে থাকা যায়। যতটুকু চিকিৎসা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেছেন তা দিয়ে ছোট একটি চেয়ার ও টেবিলে ঠাকুরগাঁও জেলা স্কুল বড় মাঠে ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল দিয়েছেন তিনি। প্রতিদিন সন্ধ্যার ঠিক আগ থেকে রাত আটটা পর্যন্ত চলে তার এ হাসপাতালের কাজ। প্রেসার মাপা, ওজন মাপা ও প্রাথমিক চিকিৎসা পাওয়া যায় তার এ ভ্রাম্যমাণ হাসপাতালে।
নতুন দোকান নিয়ে বা টাকা ইনভেস্ট করে কোন কিছু শুরু করার মত অবস্থা না থাকায় জেলা স্কুল বড় মাঠে এমন দোকান খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন মাসুদ রানা। ঠাকুরগাঁও পৌরসভার কালিবাড়ির বাসিন্দা তিনি। পারিবারিক জীবনে এক ছেলে ও এক মেয়ের বাবা তিনি। সন্তানেরা দুজনে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।
মাসুদ রানা বলেন, ঠাকুরগাঁও চৌরাস্তায় ইউসুফ হাসপাতালের শুরু থেকে আমি চাকরী করে আসছিলাম। করোনায় ব্যবসা করতে না পেরে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে যায়। বিশ বছর ধরে ডাক্তার আর রোগীদের সাথে আমার চলাফেরা। আলাদা কোন কাজ তেমন পারিনা। মাসে যা বেতন পেতাম তা দিয়ে বাড়িভাড়া, সংসারের খরচ আর সন্তানদের পিছনে খরচ হয়ে যেত। তাও কষ্ট করে একটা অটো কিনেছিলাম। সেটাও চুরি হয়ে যায়। আমি একেবার নিঃস্ব হয়ে যাই। তবে বসে তো আর থাকা যায়না। কোন দোকান নিতে গেলে তার সিকিউরিটিসহ অনেক টাকার হিসাব-নিকাশ। তাই দোকান নিয়ে শুরু করা আপাদত স্বপ্নের মতন। মেয়েটার স্কুলের বেতন দিতে পারিনি স্কুল খোলার পর। বাড়িতে ঠিকমত খরচ করে দিতে পারিনা। দিনেরবেলা পরিচিত লোকজন মোবাইল করে যেতে বলে বাড়িতে চিকিৎসার জন্য সেগুলোতে যাই। আর সন্ধ্যার আগে মাঠে বসি রাত আটটা পর্যন্ত থাকি।
আমার এখানে প্রেসার, ওজন ও জ্বর মাপা যায়। মূলত যারা মাঠে আসেন হাঁটেন, দৌড়ান তারা ওজন ও প্রেসার বেশী মাপে থাকেন। আলহামদুলিল্লাহ এখান থেকে প্রতিনিয়ত তিনশো-চারশো টাকার মত আয় হয়। আপাদত এভাবেই সংসার চালিয়ে নিতে হচ্ছে। দেখা যাক আল্লাহ আবার কবে কিছু করার সুযোগ করে দেন।
ওজন মাপতে আসা মোখলেছুর রহমান বলেন, শারীরিক ভাবে ফিট থাকার জন্য বিকালে আমি মাঠে প্রতিনিয়ত হাটার জন্য আসি। আর শরীরের ওজন আয়ত্তে রাখা অতীব জরুরী। তবে ইচ্ছে করে ওজন মাপতে যাওয়া হয়না। এখানে উনি যে ওজন মাপেন এটা ভালো উদ্যোগ বলে আমি মনে করছি। এটার মাধ্যমে মাঠে আসা অনেকে উপকুত হবে।
ঠাকুরগাঁও পৌরসভার ০২ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আতাউর রহমান বলেন, বর্তমানে মাসুদ অনেক কষ্টকরে সংসারের খরচ বহন করেন। আমাদের পক্ষ থেকে আমরা তাকে সহযোগিতা করেছি আগামীতেও করব ইনশাআল্লাহ।