ঢাকা, রবিবার ১০ নভেম্বর ২০২৪, ২৬শে কার্তিক ১৪৩১

টাঙ্গাইলের করটিয়া হাটে ৫৮৫ টাকার ভিটি দুই লাখ টাকায় বিক্রি হচ্ছে!

হাসান সিকদার, টাঙ্গাইল : | প্রকাশের সময় : রবিবার ২৬ জুন ২০২২ ০৫:৫৬:০০ অপরাহ্ন | দেশের খবর

টাঙ্গাইলের বাণিজ্যিক কেন্দ্র খ্যাত করটিয়া হাটে ৫৮৫ টাকার একটি ভিটি সরকারের কাছ থেকে বরাদ্দ নিয়ে প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এতে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা হাটের ভিটি না পেয়ে চরম ক্ষতির মুখে পড়ছেন এবং তার দায় পড়ছে সাধারণ ক্রেতাদের উপর। 

জানা যায়, এ বছর হাটে ভিটি বরাদ্দের প্রক্রিয়া করে জেলা প্রশাসন। এ কারণে প্রকৃত ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ ভিটি বরাদ্দ পেতে আবেদন করেন। পরে তাদের জানানো হয় হাটে নতুন করে কোনো ভিটি বরাদ্দ দেওয়া হবে না। যারা ইতোমধ্যে অবৈধভাবে হাটের জায়গা দখল করে ব্যবসা করছেন- তাদের মধ্যেই ভিটি বরাদ্দ দেওয়া হবে। এতে অবৈধ দখলদারদের মধ্যে অশুভ প্রতিযোগিতা শুরু হয়। সরকারের পক্ষ থেকে স্বচ্ছভাবে প্রকৃত ব্যবসায়ীদেরকে সরাসরি ভিটি বরাদ্দ দেওয়া হয় না। এ কারণে সরকারি ইজারা মূল্য (ভিটি প্রতি) ৫৮৫ টাকার পরিবর্তে ব্যবসায়ীদের গুনতে হয় লাখ লাখ টাকা। এ কারণে ব্যবসার আনুসাঙ্গিক খরচ বেড়ে গিয়ে ক্রেতাদের ওপর প্রভাব পড়ে- পণ্যের দাম বেড়ে যায়। কিন্তু সরকারিভাবে ব্যবসায়ীদের কাছে ভিটি বরাদ্দ দেওয়া হলে হাটে দূর-দূরান্ত থেকে আসা ক্রেতারাও কম মূল্যে তাদের চাহিদামত পণ্য কিনতে পারতেন। তা না হয়ে হাটের সিন্ডিকেটের সদস্যদের কারণে ব্যবসায়ীসহ সাধারণ ক্রেতারাও ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। এ অবস্থার অবসান না হলে জেলার ঐতিহ্যবাহী করটিয়া হাট থেকে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। 

ব্যবসায়ীরা জানায়, হাটে বেশিরভাগ ব্যবসায়ী তাদের ভিটি ভাড়া বা অন্য কারো কাছ থেকে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে কিনে ব্যবসা পরিচালনা করেন। কিন্তু যারা প্রকৃত ভিটির মালিক তারা হাটে কোনো ব্যবসার সঙ্গে জড়িত নন। তারা সবাই রাজনৈতিক নেতা নইলে জনপ্রতিনিধি অথবা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের স্বজন। তাদের ওই সিন্ডিকেটের কারণে ভিটিগুলো দেড়, দুই এমনকি পাঁচ লাখ টাকায় ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি হয়।  অথচ এসব ভিটির বাৎসরিক সরকারি ইজারা মূল্য (ভিটি প্রতি) ৫৮৫ টাকা। 

সরেজমিনে করটিয়া হাটে গিয়ে দেখা যায়, করটিয়ায় হাটবার মূলত বৃহস্পতিবার। কিন্তু আকারে বড় ও বিকিকিনি বেশি হওয়ায় প্রতি মঙ্গলবার বিকাল থেকে একটানা বৃহস্পতিবার পর্যন্ত হাট বসে। এরমধ্যে মঙ্গলবার বিকাল থেকে বুধবার বিকাল পর্যন্ত কাপড়ের (শাড়িসহ নানা কাপড়) হাট বসে, বৃহস্পতিবার ভোর থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় অন্যান্য পণ্য সামগ্রীর হাট। সকাল থেকেই হাটে সাধারণ ক্রেতাদের ভিড় বাড়তে শুরু করে। দূর-দূরান্ত থেকে আসা ক্রেতা-বিক্রেতারা পণ্য কেনা-বেচায় ব্যস্ত সময় পার করেন। বগুড়া থেকে আসা সোলায়মান মিয়া নামে এক কাপড় ব্যবসায়ী জানান, গতবারের তুলনায় এবার কাপড়ের দাম অনেক বেশি। তারপরেও ব্যবসা ও ক্রেতাদের চাহিদার কারণে বেশি দাম দিয়েই কাপড় কিনতে হচ্ছে। কালিহাতী উপজেলার বল্লা এলাকার রাশেদ, ফরিদ, শরিফুল, আবিদ মল্লিক, মিলন মল্লিক, রামপুর-কুকরাইলের আজগর, লাল মিয়া, মফিজুলসহ অনেকেই জানান, তারা দীর্ঘদিন ধরে করটিয়ার হাটে কাপড়ের ব্যবসা করছেন। নিজেদের ফ্যাক্টরীতে শাড়ি উৎপাদন করে করটিয়ার হাটে এনে বিক্রি করেন। এজন্য তাদের ভিটির প্রয়োজন হয়। প্রতি বছর তারা এক লাখ, দেড় লাখ, দুই লাখ কোন কোন বছর তার চেয়ে বেশি টাকা দিয়ে ভিটি কিনতে হয়। এতে বেশি খরচ হওয়ায় তা তৈরিকৃত শাড়ির উপরই পড়ে।

করটিয়া এলাকার শাকের আলী জানান, দীর্ঘদিন ধরে হাটের কিছু জায়গা দখল করে তিনি ব্যবসা করেন। কিন্তু এবার বৈধভাবে জায়গা বরাদ্দ পেয়েছেন। তবে নিজের নামে না দেওয়ায় তার মেয়ে ও ভাই এবং ভাতিজার নামে ভিটি বরাদ্দ নিয়ে ব্যবসা করছেন। এগুলোর একটি তিনি নিজেই পরিচালনা করেন এবং বাকি তিনটি ভাড়া দিয়েছেন। এ হাটে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ী ও সরকারি চাকুরিজীবীদের ভিটি আছে। তবে এসব ভিটি তারা নিজের নামে না করে নিয়েছেন পরিবারের সদস্যদের নামে। এমনই একজন হচ্ছেন করটিয়া এলাকার কালিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক আরিফ মিয়া। এ হাটে তার তিন বোন, মা, মামা, মামাতো ভাইয়ের নামে আটটি ভিটি নিয়েছেন। পরে ওই ভিটিগুলো আবার একই এলাকার চাচাতো ভাই ইসমাইল হোসেনের কাছে এক বছরের জন্য ভাড়া দিয়েছেন। ইসমাইল হোসেন জানান, আরিফের কাছ থেকে আটটি ভিটি লিজ নিয়ে তিনিও সেগুলো ভাড়া দিয়েছেন। সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ায় আরিফ এগুলো তার বোন, মা, মামা ও মামাতো ভাইয়ের নামে বরাদ্দ নিয়েছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রভাবশালী এক জনপ্রতিনিধির ছত্রছায়ায় এলাকার প্রল্লাদ দাস, হেলাল উদ্দিন, ছানোয়ার হোসেন ছানু ও আনিসুর রহমান বিরু দীর্ঘদিন ধরে করটিয়া হাট নিয়ন্ত্রণ করছেন। এবারও তাদের মাধ্যমেই পুরো হাটে ভিটি বরাদ্দ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এমনকি তাদের প্রত্যেকের নামে একটিসহ বিভিন্ন স্বজনদের নামে একাধিক ভিটি নেওয়া হয়েছে। পরে সেগুলো ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে এক লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়েছে। এছাড়া ভিটিগুলো প্রতিবছর ৪০-৫০ হাজার টাকায় ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। নাম প্রকাশ না করে কয়েক ব্যবসায়ী জানান, তিনি গত ১০-১২ বছর ধরে এ হাটে ব্যবসা করছেন। ৪-৫ বার তিনি ভিটি বরাদ্দ পাওয়ার জন্য আবেদন করেও পাননি। তাই বাধ্য হয়ে ভিটি ভাড়া নিয়ে ব্যবসা চালাচ্ছেন। এ কারণে ক্রেতাদের কাছে কিছুটা বেশি দামে পণ্য বিক্রি করতে হচ্ছে। যদি প্রকৃত ব্যবসায়ীরা সরকারি মূল্য অনুযায়ী ভিটি বরাদ্দ পেতেন তাহলে সাধারণ ক্রেতাদের কাছ থেকে বেশি মূল্য নিতেন না। এ রকম প্রায় সব ব্যবসায়ীরাই প্রতিবছর মোটা অংকের ভাড়ার টাকা আদায়ের জন্য ক্রেতাদের কাছ থেকে বেশি মূল্য রেখে থাকেন।

সিন্ডিকেটের সদস্য ও করটিয়া হাটে হোটেল ব্যবসায়ী প্রল্লাদ দাস জানান, তিনি ভিটি বরাদ্দের বিষয়ে কিছু জানেন না। তবে তিনি গত ৩-৪ বছর আগে আনিসুর রহমান বিরুর কাছ থেকে একটি ভিটি কিনে হোটেল ব্যবসা করছেন। আনিসুর রহমান বিরু জানান, বর্তমানে তার কাছে কোন ভিটি খালি নেই। তবে যেগুলো ছিল- সেগুলো সব ভাড়া দিয়েছেন। ভিটি বরাদ্দ দেওয়ার বিষয়টি সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহজাহান আনছারী ও প্রল্লাদ দাস দেখেন। তারাই ঠিক করেন কার ভাগে কয়টি ভিটি পড়বে। ছানোয়ার হোসেন ছানু জানান, এবার যাদের ভিটি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তারা আগে থেকেই সেখানে দখলে ছিলেন। এবার একজন ব্যবসায়ী একটি মাত্র ভিটি পাবেন। তবে তার পরিবার বড় হওয়ায় তিনি ও তার স্বজনরা মিলে ১০-১২টি ভিটি বরাদ্দ পেয়েছেন।

এ ব্যাপারে টাঙ্গাইল সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহজাহান আনছারী জানান, করটিয়া হাটে আগে থেকেই যারা ভিটি দখল করে রেখেছিলেন তাদের মাঝেই বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। নতুন ভাবে কাউকে বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। এর বেশি কিছু তিনি জানেন না।