কেউ অন্যায় বা অবিচারের শিকার হলে আইনি উপায়ে বিচার পেতে মামলা করেন। থানায় মামলা হলে এজাহার পাঠিয়ে দেওয়া হয় আদালতে। আসামি গ্রেফতার হলে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা প্রতিবেদনসহ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আসামিকে আদালতে হাজির করেন। শুরু হয় আইনি লড়াই। এখান থেকেই শুরু হয় বিচার পাওয়া-না পাওয়ার মূল চ্যালেঞ্জ। জায়গায় জায়গায় বকশিশের নামে ঢালতে হয় টাকা। মামলা চলতে থাকে বছরের পর বছর। বকশিশও দিতে হয় মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত।
বিচারপ্রার্থীদের মতে, বকশিশের চাপেই মামলার ব্যয় পাহাড় সমান হয়ে যায়। এ ব্যয়ের পাহাড় অনেককে নিঃস্ব করে দেয়। মামলা লড়তে লড়তে প্রায় সর্বস্ব খোয়াতে হয় বাদী ও বিবাদী উভয়পক্ষকে। মূলত মামলার কপি নেওয়া, হাজিরা দেওয়া, ওকালতনামায় সই করা, রিমান্ড বাতিলের শুনানি, জামিননামা দেওয়া, জামিনের শুনানি করা, মামলার নকল তোলাসহ মামলা সংক্রান্ত যে কোনো সেবায় বকশিশ বা খরচাপাতি ছাড়া এখন যেন চলেই না।
ব্রিটিশ আমল থেকে আদালতপাড়ায় বকশিশের রেওয়াজ। ঘুস হিসেবে নয়, বকশিশ হিসেবে এটা প্রচলিত। খুশি হয়ে অনেকে বকশিশ দেন। চাপ প্রয়োগ করে যারা বকশিশ নেন তারা অন্যায় করেন। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। নিয়মের বাইরে কেউ নয়। সবাইকে নিয়মের মধ্যে চলতে হবে।
বিচার চাইতে এসে লাগামহীন খরচের পাল্লায় পড়ার অভিযোগ প্রায়ই পাওয়া যায় নিম্ন আদালতে। তাদের অভিযোগ, বখশিশ বা খরচাপাতি দিতে হয় নিম্ন আদালতের ফাইলিং শাখা, সেরেস্তা, জিআর শাখা, আদালতের পেশকার, উমেদার, মামলার জিআরও, আদেশ লিখতে সংশ্লিষ্ট কম্পিউটার অপারেটর, বিচারকদের আরদালি (যিনি বিচারকের চেয়ার ঠিক করে দেন), আদালতের পিয়ন, সমন জারিকারক, আইটি সেকশন ও ডিসপাস শাখায়। এসব জায়গায় কতিপয় কর্মচারী অনিয়মের সঙ্গে জড়িত। টাকা না দিলে ফাইল নড়ে না। টাকা দিলে কাজ হয় দ্রুতগতিতে। আদালত অঙ্গনে নিয়মবহির্ভূতভাবে এ ধরনের লেনদেনকে বলা হয় খরচাপাতি। আবার যারা নিচ্ছেন, তারা এটাকে ‘ঘুস’ বলতে নারাজ। তাদের ভাষ্য— নির্বিঘ্নে কাজ শেষ করতে ‘বকশিশ’ দিতে হয় অনেককে।
ওকালতনামার জন্য আসামিপক্ষ থেকে ৫০০ থেকে ৫ হাজার টাকা আদায় করা হয়। জামিন শুনানির পুটআপ নিতে সংশ্লিষ্ট আদালতের কর্মচারী, পিয়ন, উমেদারদের ৫০ থেকে ১০০ টাকা দিতে হয়। এছাড়া রিলিজ অর্ডার বা মুক্তিনামা কারাগারে পাঠানোর আগে জামিননামা যাচাই করতে পুলিশের জিআর শাখায় দিতে হয় ৫০০ থেকে দুই হাজার টাকা। কারাগার থেকে বের হতে দ্রুত রিলিজ অর্ডার কারাগারে পাঠাতে দিতে হয় এক থেকে দুই হাজার টাকা। আসামির জামিন হওয়ার পর প্রতি মাসে দু-একবার বা আদালত নির্ধারিত তারিখে আসামিকে হাজির হতে হয়। প্রতি হাজিরায় জিআর শাখায় সংশ্লিষ্ট থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশকে ৫০ থেকে ১০০ টাকা বা তারও বেশি দিতে হয়। অধিকাংশ সময় আইনজীবীরা এসব বকশিশ বা খরচাপাতি নেন সহকারীদের মাধ্যমে। আবার কখনো নিজেরাই নেন।
বিচারপ্রার্থীদের অভিযোগ, দিনের পর দিন এভাবে চললেও আদালতকেন্দ্রিক দুর্নীতি ঠেকানোর কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেই। এ বিষয়ে কোনো নজরদারিও নেই। সবার চোখের সামনেই ঘটছে এসব বকশিশ-বাণিজ্য। যদিও এ ধরনের চর্চা চরম দুর্নীতির বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করেন আইনবিদরা।
বিচারপ্রার্থী ভুক্তভোগী মানুষ ন্যায়বিচারের আশায় আদালতে আসেন। অথচ এখানে এসে পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে তাদের। আদালতের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দিতে হচ্ছে বাড়তি টাকা। এ টাকা আমাদের নিতে হচ্ছে মক্কেলের কাছ থেকে। এজন্য মক্কেলের কাছে আমাদের জবাবদিহিও করতে হচ্ছে। আদালতের ইট, বালু ও সিমেন্ট টাকা খায়। আমরা বকশিশ-বাণিজ্যের অবসান চাই। আদালত হচ্ছে ন্যায়বিচারের জায়গা। আমরা সব সময় ন্যায়বিচার চাই।
রাব্বী শেখের অভিজ্ঞতা
রাব্বী শেখ (৩৩)। পেশায় একজন মুদি দোকানি। ভাই রহমতের গ্রেফতারের খবর পেয়ে রাজধানীর রামপুরা থেকে আসেন ঢাকার নিম্ন আদালতে। রহমত মির্জা (২২) বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সে অধ্যয়নরত। প্রতিবেশীর সঙ্গে মারধরের এক মামলায় গ্রেফতার হয়ে সাতদিন ধরে কারাগারে। রাব্বীর আদালতে আসার উদ্দেশ্য তার ভাই রহমতকে জামিন করানো। এজন্য আদালতে এসে তার পরিচিত আইনজীবী জি এম মিজানুর রহমানের সঙ্গে দেখা করেন। তখন আইনজীবী মিজান তাকে বলেন, ‘আগে মামলার কাগজ তুলতে হবে। এজন্য যেতে হবে আদালতের সাধারণ নিবন্ধন (জিআর) শাখায়। মামলার কাগজ দেখে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কীভাবে জামিন করানো যাবে। মামলার কাগজ তুলতে জিআর শাখায় চা-নাস্তা বাবদ কিছু খরচাপাতি দিতে হয়। আপনি চাইলে আমার সঙ্গে যেতে পারেন।’
এরপর রাব্বী আইনজীবীর সঙ্গে যান জিআর শাখায়। সেখানে এক কর্মচারীকে বলেন, রহমতের নামে মারামারির কোনো মামলা আছে কি না। জিআর শাখার ওই কর্মচারী বললেন, এ নামে একটা মারামারির মামলা আছে। আসামি সাতদিন ধরে কারাগারে। তখন আইনজীবী বলেন, এ মামলার এজাহারসহ যাবতীয় কাগজ লাগবে। ওই সময় জিআর শাখার সেই কর্মচারী বলেন, ২০০ টাকা চা-নাস্তা বাবদ খরচাপাতি দিতে হবে। আইনজীবী রাব্বীকে তাদের দাবি মোতাবেক টাকা দিতে বলেন। রাব্বী ২০০ টাকা ওই কর্মচারীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে মামলার কাগজ ফটোকপি করে নেন।
মামলার কাগজ দেখে আইনজীবী মিজান বলেন, এ মামলায় জামিন আবেদন করতে হবে। জামিন আবেদন করলে আদালত তার জামিন মঞ্জুর করবেন। এজন্য আগে ওকালতনামা কিনতে হবে। এরপর জামিনের জন্য আবেদন করতে হবে। রাব্বী আইনজীবীর সঙ্গে গিয়ে ওকালতনামা কেনেন। এরপর ওকালতনামাটি তার ভাইয়ের স্বাক্ষরের জন্য আদালতের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেন কারাগারে। পরদিন কারাগার থেকে ওকালতনামা স্বাক্ষর হয়ে আসে। আইনজীবী জামিনের আবেদন করলে বিচারক দুদিন পর আসামির উপস্থিতিতে জামিন শুনানির জন্য দিন ধার্য করেন। এদিন রহমতকে আদালতে হাজির করা হয়। তার উপস্থিতিতে জামিন শুনানি করেন আইনজীবী। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষ তার জামিনের বিরোধিতা করে। এসময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন রাব্বী ও তার পরিবার। শুনানি শেষে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত রহমতের জামিন মঞ্জুর করেন।