দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি হঠাৎ করেই যেন উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। সরকারবিরোধী বিএনপি ও তার মিত্ররা রাজপথে আন্দোলন শুরু করেছে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কর্মসূচি পালন করছে। হুমকি দিচ্ছে সরকার পতনের একদফা আন্দোলনের। তবে রাজনীতির মাঠে বিরোধী শক্তিকে মাথাচাড়া দেওয়ার সুযোগ দেবে না আওয়ামী লীগ। তাদের আন্দোলনের ইস্যুতে সরকার কিছুটা নমনীয় হলেও ছাড় দেবে না ক্ষমতাসীন দল। রাজনৈতিকভাবে বিরোধী শক্তিকে রাজপথেই মোকাবিলা করবে তারা। পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে তা প্রতিহত করবে। বিরোধী দল মাঠে সক্রিয় হওয়ার প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগও মাঠের কর্মসূচির ডাক দিয়েছে।
জানা গেছে, বিএনপি ও তার শরিকদের মাঠের রাজনীতিতে কিছুটা জায়গা দিলেও এটাকে কোনোভাবেই বাড়াবাড়ি পর্যায়ে যেতে দেবে না আওয়ামী লীগ। বিরোধী জোট যাতে রাজপথ তাদের দখলে নিতে না পারে, সেই বিষয়ে সতর্ক রয়েছেন দলটির নেতারা। এ কারণেই গত কয়েক দিনে বিএনপি মাঠের রাজনীতিতে নিজেদের অবস্থানের যে জানান দিচ্ছে, তার লাগাম টানতে চায় সরকারি দল। রাজনীতির মাঠ নিজেদের দখলে রাখতে ইতোমধ্যে কর্মসূচিরও ডাক দিয়েছে আওয়ামী লীগ।
সাম্প্রতিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দেশের প্রধান বিরোধী শক্তি এতদিন ঘরোয়া কর্মসূচির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও তারা মাঠের কর্মসূচি দিতে শুরু করেছে। গত ৭ মে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বাধা না দেওয়ার আভাস পেয়ে বিএনপি এবং তার সহযোগী ও অঙ্গ সংগঠন ধারাবাহিকভাবেই রাজপথের কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে। গত কয়েক দিনে বেশ কিছু কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে পালন করতেও সক্ষম হয়েছে তারা। বিএনপির অঙ্গ সংগঠন গত ১৬ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ মিছিল করে। তবে সংঘাত হয় ছাত্রদলের ২২ মে’র বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে। পদ্মা সেতু ইস্যুতে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিবাদে ওইদিন ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করে ছাত্রদল। ওই প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে কটূক্তি ও ‘পঁচাত্তরের হাতিয়ার-গর্জে উঠুক আরেকবার’ স্লোগান দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে বলে পাল্টা অভিযোগ তুলে ছাত্রদলকে প্রতিহত করার ঘোষণা দেয় ছাত্রলীগ। এর জের ধরে ঢাবি ক্যাম্পাসে কয়েক দফায় ছাত্রলীগ-ছাত্রদলের মধ্যে মারপিটের ঘটনা ঘটে। ছাত্রদলের ওপর বিনা উসকানিতে ছাত্রলীগ হামলা চালিয়েছে অভিযোগ তুলে বিএনপির এ ছাত্র সংগঠনটি ঢাকাসহ সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভের ডাক দেয়। তবে এর প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই তারা প্রতিরোধের মুখে পড়েছে।
ছাত্রদল ছাড়াও এক সপ্তাহ ধরে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে বিএনপির বিভিন্ন কর্মসূচিতে হামলা ও বাধা এসেছে। ঢাকার বাইরে বিএনপির কিছু কর্মসূচি পুলিশি বাধায় পণ্ড হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও পাল্টাপল্টি বিক্ষোভ সমাবেশের কারণে প্রশাসন ১৪৪ জারি করেছে। অবশ্য ঢাকার প্রেস ক্লাব প্রাঙ্গণসহ ঢাকার বাইরে বিএনপি বা এর অঙ্গসংগঠন বেশ কিছু কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে পালন করতে পেরেছে।
সরকারি দলের নেতারা বলেছেন, কোনও রাজনৈতিক দলের শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বাধা দেওয়ার পরিকল্পনা তাদের নেই। তবে আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস ও প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার হুমকি দিলে তারা বসে থাকবে না। রাজনৈতিকভাবেই তা প্রতিহত করবে। সম্প্রতি ছাত্রদলের মিছিল থেকে ‘পঁচাত্তরের হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার’ স্লোগানকে দলীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার প্রচ্ছন্ন হুমকি বলে মনে করছে আওয়ামী লীগ। দলটির অভিযোগ, বিএনপি ছাত্রদলকে এসব স্লোগান শিখিয়ে দিয়েছে। যে কারণে ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের আন্দোলন ছাত্রলীগের প্রতিহত করাটাকে সমর্থন জানিয়েছে আওয়ামী লীগ। দলীয় প্রধানকে কটূক্তি করে স্লোগান দেওয়ার প্রতিবাদে দলটির পক্ষ থেকে তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। পাশাপাশি সহযোগী ও অঙ্গ সংগঠনগুলোকেও কর্মসূচি পালনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার (৩১ মে) বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ এবং সহযোগী সংগঠনের যৌথ সভা হয়। ওই সভায় দলীয় প্রধানকে কটূক্তি করে স্লোগান ও তাকে হত্যার হুমকির প্রতিবাদে ৪ জুন সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচির সিদ্ধান্ত হয়েছে। একই ইস্যুতে ৮ জুন ঢাকা মহানগর উত্তর ও ১০ জুন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগ বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করবে। ঢাকা মহানগর দক্ষিণের এই কর্মসূচি পালিত হবে জাতীয় প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণে।
বিএনপি ও তার মিত্ররা জাতীয় প্রেস ক্লাব ও হাইকোর্ট প্রাঙ্গণকে আন্দোলনের ‘নিরাপদ জোন’ মনে করে ওই এলাকায় তাদের কর্মসূচি দিচ্ছে বলে মঙ্গলবারের বৈঠকের আলোচনায় উঠে আসে। যার কারণে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনকে কর্মসূচি দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রেস ক্লাব প্রাঙ্গণকে প্রাধান্য দিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এর অংশ হিসেবে শুক্রবার (৩ জুন) সকাল সাড়ে ১০টায় প্রেসক্লাব এলাকায় বিক্ষোভ কর্মসূচির ডাক দিয়েছে সহযোগী সংগঠন মহিলা আওয়ামী লীগ। এদিকে মঙ্গলবারের যৌথসভায় ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনকে কোনও কর্মসূচি না থাকলেও সকাল-বিকাল প্রেস ক্লাব ও তার আশপাশের গলিপথ দখলে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে সূত্রে জানা গেছে।
মঙ্গলবারের যৌথসভায় রাজপথে আন্দোলনের নামে অরাজকতা করলে কঠোর জবাব দেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপি ছাত্রদলকে দিয়ে রাজপথে অস্থিতিশীলতা তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকি দিয়ে ছাত্রদলকে মাঠে নামানো হয়েছে। তবে রাজপথ কাউকে ইজারা দেওয়া হয়নি। আওয়ামী লীগ দেখবে কত ধানে কত চাল। সব কিছুর শেষ আছে। আগুন নিয়ে খেললে পরিণাম ভালো হবে না। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এর উপযুক্ত জবাব দেবে। আওয়ামী লীগ রাজপথে ছিল, থাকবে। আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস করলে রাজপথে জবাব দেবে আওয়ামী লীগ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক রিয়াজউদ্দিন রিয়াজ বলেন, ‘আওয়ামী লীগ কোনও রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বাধা দেওয়ার রাজনীতিকে বিশ্বাস করে না। তবে রাজনীতির নামে সন্ত্রাস আমরা বরদাস্ত করবো না। তারা আমাদের নেত্রীকে নিয়ে কটূক্তি করবে, হত্যার হুমকি দেবে, আর আমরা বসে বসে দেখবো, সেটা তো হয় না। আমরা মহানগর কমিটি প্রতিটি ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে সতর্ক অবস্থানে আছি। রাজপথের অলিগলি যেখানেই তাদের পাই, প্রতিহত করবো।’
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেছেন, বিএনপি যদি শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করে তাহলে আমরা তাদের বাধা দেবো না। এটা আমাদের অঙ্গীকার। কিন্তু তারা যদি হুমকি দেয়, হত্যাকাণ্ড ঘটানোর মতো ভাষায় বক্তব্য দেয়, মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলে, তাহলে দেশের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে তাদের প্রতিহত করা হবে। আমরা কোনও খুনির কাছে মাথা নত করবো না। আমরা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তাদেরকে প্রতিহত করবো।’
দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মুহম্মদ ফারুক খান বলেন, ‘কয়েকদিন ধরে আমরা বিএনপির আন্দোলন কর্মসূচি দেখেছি। কিন্তু তারা শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে বিশ্বাস করে না। তারা আমাদের দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রীকে কটূক্তি করছে, হত্যার হুমকি দিয়েছে। আমরা বসে থাকতে পারি না। রাজনৈতিকভাবে তাদের মোকাবিলা করা হবে। এজন্য আমরা রাজনৈতিক কর্মসূচির ডাক দিয়েছি। তারা আন্দোলনের নামে অতীতের মতো অগ্নিসংযোগ ভাঙচুর করলে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে রাজপথেই প্রতিহত করা হবে।’