ছাত্রলীগের ২৯তম সম্মেলনে নেতৃত্ব নির্বাচনের ভার তুলে দেওয়া হয় সংগঠনের সাংগঠনিক অভিভাবক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে। আশা ছিল ঐতিহ্যবাহী সংগঠনটির নেতৃত্বকে সিন্ডিকেটমুক্ত করা। তবে ২০১৮ সালের ১১ ও ১২ মে ২৯তম সম্মেলন হওয়ার আড়াই মাস পর যে কমিটি হয়, তা আরও বেশি হতাশ করে। নানান ঘটনা আর অঘটনের পর সেই কমিটির সভাপতি ও সম্পাদককে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় ২০১৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর।
এরপর ভারপ্রাপ্ত হয়ে দায়িত্বে আসেন আল নাহিয়ান খান জয় এবং লেখক ভট্টাচার্য। সাড়ে তিন মাস পর ২০২০ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ‘ভারমুক্ত’ হন জয়-লেখক। তবে তারা ভারমুক্ত হলেও ঝামেলামুক্ত হয়নি ছাত্রলীগ। প্রেস রিলিজে কমিটি গঠন, বিবাহিত -চাঁদাবাজ-মাদকসেবিদের কমিটিতে আনা, বছরের পর বছর পদ আঁকড়ে থাকাসহ নানান অভিযোগে টালমাটাল ছাত্রলীগ। সংগঠনটিতে এবার শুরু হয়েছে সম্মেলন নিয়ে ধোঁয়াশা।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সম্মেলনের বিষয়ে প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দিলেও সেটা নিয়েও ধোঁয়াশা তৈরি করেছেন ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। তবে ছাত্রলীগের দেখভাল করা আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, ছাত্রলীগের আগামী সম্মেলন সময় মতই হবে।
ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রের দ্বিতীয় ভাগের ১১ ধারার (খ) তে বলা আছে, কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের কার্যকাল ২ বছর। উপরিউক্ত সময়ের মধ্যে সম্মেলন আয়োজন করতে হবে। অন্যথায় নির্বাহী সংসদের কার্যকারিতা লোপ পাবে। (গ) তে বলা হয়েছে, বিশেষ বা জরুরি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় কমিটির বর্ধিত সভায় অনুমোদন সাপেক্ষে কমিটির কার্যকাল ৩ মাস বৃদ্ধি করা যাবে। উক্ত সভায় প্রতিটি সাংগঠনিক জেলার সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় সদস্যবৃন্দ যোগ দেবেন।
ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রের দ্বিতীয় ভাগের ১৫ ধারার (ঙ) তে বলা আছে, প্রতি দুই মাসে অন্তত একবার কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভা বসবে। অন্যান্য সক নিম্নতম শাখাগুলোতে প্রতি মাসে অন্তত একবার নির্বাহী সংসদের সভা বসবে। এ হিসেবে জয়-লেখক কমিটির তিন বছরে নিয়ম অনুযায়ী দুই মাস পরপর যেখানে ১৮টি কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভা হওয়ার কথা সেখানে সভা হয়েছে মাত্র একটি। ইউনিটগুলোর সম্মেলন ও দলীয় সব কর্মসূচির সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় নেওয়ার কথা। সেসব সিদ্ধান্ত নেন শুধু জয় ও লেখক। ফলে ৩০১ সদস্যের কমিটি হলেও সংগঠনটি চলে শুধু সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের ইচ্ছায়।
গত চার বছরে সংগঠনের নিয়ম আর ঐতিহ্যের কিছুই মানা হয়নি। চাঁদাবাজি, মাদকসেবন, বিবাহিত, চাকরিজীবী, বয়স উত্তীর্ণ, ছাত্রদল করা, নিজ সংগঠনের নেতাদের উপরই হামলার মামলার গ্রেফতারি পরোয়ানার আসামি, ডাকাতি-ছিনতাই, মাদক মামলার আসামিসহ নানানভাবে বিতর্কিতদের পদে আনা, কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা না থাকা, বিতর্কিতদের দিয়ে শূন্যপদ পূরণ, কার্যনির্বাহী কিমিটির সভা না ডাকাসহ নানা বিতর্কে চলেছে ছাত্রলীগ। বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে চলতে থাকায় এখন অনেকটা টালমাটাল হয়ে পড়েছে ছাত্রলীগ।
২০২০ সালের ২১ ডিসেম্বর মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হল ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ফাল্গুনী দাস তন্বীকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারে ডেকে নিয়ে মারধর করেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বেনজীর হোসেন নিশি। তার সঙ্গে ছিলেন শূন্যপদে পরে সহ-সভাপতি হওয়া জিয়াসমিন শান্তা। ওই ঘটনায় জয়-লেখকের কাছে বিচার দিয়েও কোনো সমাধান না পেয়ে থানায় যান ফাল্গুনী। সেখানে মামলা না নিলে সিএমএম কোর্টে হত্যাচেষ্টার মামলা করেন তিনি। পরে নিশি ও শান্তাসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত।
চলতি বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারে ফুল দিতে গিয়ে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের সাবেক ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সম্পাদক এহসানুল হক ইয়াসিরের মাথা ফাটিয়ে দেওয়ায় আরও একটি হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি হন বেনজির হোসেন নিশি।
একাধিক মামলার এসব আসামি, মাদক, কমিটি বাণিজ্য ও বিভিন্ন বিষয়ে অভিযুক্তদের নিয়েই শীর্ষ নেতারা দলীয় সব অনুষ্ঠান পালন করেছেন, এখনো করছেন। নিজেদের কর্মীবাহিনী দিয়ে বলয় তৈরি করা কর্মীরাই নানা অপরাধে যুক্ত থাকায় নেওয়া হয়নি সাংগঠনিক কোনো ব্যবস্থা।
আহত ছাত্রলীগ নেতা মো. এহসানুল হক ইয়াসির ও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক বেনজীর হোসেন নিশি
এ বিষয়ে ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সৈয়দ আরিফ হোসেন বলেন, ছাত্রলীগ নীতিগতভাবে শৃঙ্খলার পক্ষে। কিন্তু বর্তমান সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দায়িত্বে আসার পর থেকেই শৃংখলা হারিয়ে গেছে নানা ধরনের বিতর্কের ফলে। এতে সংগঠনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। বিতর্কিত কাজের পর কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় একের পর এক বিশৃঙ্খলা হয়েছে যা এখন স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুরুতেই যদি তা দমনে পদক্ষেপ নিতো তাহলে সংগঠনে যে বিশৃঙ্খলা ও স্বেচ্ছাচারিতা, সেটা দেখা দিতো না। সভাপতি সাধারণ সম্পাদক তাদের কর্মীবাহিনী দিয়ে একটি বলয় সৃষ্টি করেছে। তারাই বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কাজ করে বিশৃঙ্খলা তৈরি করছে। ফলে তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপও নিতে পারেনি।
শোভন-রাব্বানীর করা কমিটির বিতর্কিতদের বাদ দিতে নতুন করে কেন্দ্রীয় কমিটিতে ৬৮ জনকে পদায়িত করেন জয়-লেখক। নতুন এই নেতাদের মধ্যে- ডাকাতি-ছিনতাইয়ে অভিযুক্ত ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক সুব্রত হালদার বাপ্পীকে সহ-সভাপতি, নিজ সংগঠনের জুনিয়র নেত্রী ফাল্গুনী দাস তন্বীকে মারধরে অভিযুক্ত আসামি জিয়াসমিন শান্তাকে সহ-সভাপতি, বিবাহিত শাহরিয়ার সিদ্দিক শিশিমকে সহ-সভাপতি ও সম্পাদক ওয়াহিদ খান রাজ উপ-গণশিক্ষা সম্পাদক, ঢাবির সাবেক উপাচার্য ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের স্বাক্ষর জাল করার অভিযোগে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কৃত দেবাশীষ সিদ্ধার্থকে সহ-সভাপতি করা হয়।
এদিকে ছাত্রলীগের দপ্তর সূত্রে জানা যায়, ছাত্রলীগের ১১১টি সাংগঠনিক ইউনিটের (জেলা, মহানগর, বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ) মধ্যে নতুন কমিটি হয়েছে মোট ৩৭টির। এর মধ্যে ২০১৯ সালে হয়েছে ১টি, ২০২০ সালে ৬টি এবং ২০২১ সালে ১৫টি, ২০২২ সালে ১৫টি ইউনিটের নতুন কমিটি ঘোষণা হয়েছে। নতুন ৩৭টির মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়েছে ২১টির। আর সবশেষ নোয়াখালী জেলাসহ মোট ২৪টি ইউনিটের কমিটি গঠনের জন্য প্রার্থীদের জীবনবৃত্তান্ত চেয়েছে কেন্দ্রীয় সংসদ।
ছাত্রলীগের নতুন কমিটি হওয়া ৩৭টি সাংগঠনিক ইউনিটের মধ্যে মাত্র ৪টির কমিটি হয়েছে সম্মেলনের মাধ্যমে। বাকি সবগুলো কমিটি ঢাকায় বসে শুধু প্রেস রিলিজের মাধ্যমে দিয়েছেন জয়-লেখক। প্রেস রিলিজনির্ভর এসব সাংগঠনিক কমিটি গঠনে পদ বাণিজ্যের অভিযোগও রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। অন্যদিকে যে ৭৪ সাংগঠনিক ইউনিটের নতুন কমিটি হয়নি তার সবগুলোই এখন মেয়াদোত্তীর্ণ।
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সহ-সভাপতি কামাল খান বলেন, ছাত্রলীগের একটি সুনির্দিষ্ট গঠনতন্ত্র রয়েছে। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ২ মাস অন্তর অন্তর কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সভা হওয়ার কথা থাকলেও বর্তমান কমিটির সভাপতি ও সম্পাদক একটি সাধারণ সভা বা বর্ধিত সভা করেনি। ফলে সংগঠন এখন সভাপতি ও সম্পাদক সর্বস্ব হয়ে উঠেছে। কেন্দ্রীয় কমিটিকে সর্বোচ্চ অবমূল্যায়নের রেকর্ড করে জয়-লেখক স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে সংগঠনের সাংগঠনিক মূল শক্তিকে থামিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড় থাকলেও আমরা চাই অবিলম্বে নেত্রীর নেওয়া সম্মেলনের সিদ্ধান্ত, চূড়ান্ত তারিখ হোক এবং একটি বর্ণাঢ্য সম্মেলনের মাধ্যমে সংগঠনের শৃংখলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা হোক। সাংগঠনিক ম্যাজিশিয়ানরা নেতৃত্বে আসুক।
গত ৭ মে আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় সহযোগী সদস্যগুলোকে সম্মেলন করার নির্দেশনা দেন দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা। এরপর গত ১০ মে আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর সভায় দলের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সম্মেলন করার নির্দেশনা দেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। কিন্তু এই নির্দেশনা মানতে নারাজ জয়-লেখক। এটি শেখ হাসিনার নির্দেশনা নয় জানিয়ে সম্মেলনপ্রত্যাশীদের সঙ্গে বিতণ্ডায় জড়ান তারা।
এ বিষয়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সভাপতি সৈয়দ আরিফ হোসেন বলেন, সম্মেলন নিয়ে ছাত্রলীগের সভাপতি-সম্পাদক যে ধোঁয়াশা সৃষ্টি করেছে আমরা তা আশা করিনি। আমাদের অভিভাবক, জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশেই ওবায়দুল কাদের সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ছাত্রলীগের সম্মেলনের কথা নিশ্চিত করেছেন। ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক নেত্রীর কাছ থেকে সম্মেলনের তারিখ না এনে বরং তারা বিভিন্ন জায়গায় তদবিরের জন্য দৌড়াদৌড়ি করছে সম্মেলনকে বিলম্বিত করার জন্য। এটি খুবই দুঃখজনক।
ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ও দলের সাধারণ সম্পাদকের সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্যের পরও সম্মেলন নিয়ে এক ধরনের ধোঁয়াশা তৈরির বিষয়ে জানতে চেয়ে একাধিকবার ফোনে যোগাযোগ ও ক্ষুদেবার্তা পাঠালেও ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যের কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
ছাত্রলীগের দেখভালের দায়িত্বে থাকা চার নেতার একজন, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হক সম্মেলন নিয়ে বলেন, তাদের বিষয়ে এখন আর কিছু বলতে চাই না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগ যেভাবে কাজ করার কথা ছিল সেভাবে কাজ করতে পারেনি। সামনে যাতে ভালো কিছু করতে পারে, আগামী নেতৃত্ব ভালো কাজ করবে এমনটাই চাই। ব্যর্থতা ও সফলতা নিয়েই ছাত্রলীগ। সব নেতৃত্ব তো এক রকম হয় না।
সম্মেলনকে ঘিরে ধোঁয়াশা তৈরি করেছে কি না এমন বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের দলের সাধারণ সম্পাদকের নির্দেশনা অনেকে অনেকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে। সম্মেলনের বিষয়ে আওয়ামী লীগের ফোরামে আলোচনা হয়েছে। নেত্রী সেটা পরিচালনা করেন। দলের মুখপাত্র তো সাধারণ সম্পাদক। তিনিই কথা বলবেন। কে এটা বিশ্বাস নাকি অবিশ্বাসে নেবে, এটা তার ব্যাপার।
ছাত্রলীগের দেখভাল করা আরেক নেতা, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রহমান বলেন, ছাত্রলীগ নিয়ে বিতর্ক সবসময়ই থাকবে। কাজ করলে বিতর্ক হবেই। সম্মেলন সময় মতই হবে। সম্মেলনের ব্যপারে তাদের (জয়-লেখক) প্রস্তুতি নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তারা নিশ্চয়ই তাদের প্রস্তুতি নিয়ে সম্মেলনের তারিখ জানাবে।