২০২০ সালের ১০ জানুয়ারি রেলবহরে যুক্ত হয় ১০টি নতুন লোকোমোটিভ (রেল ইঞ্জিন)। রেলওয়ের ক্রয় কমিটি ও ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের যোগসাজশে এসব ইঞ্জিনে দুর্বলতা ও ক্রয়ে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ ছিল।এসব অভিযোগ তোয়াক্কা না করেই রেল বহরে যুক্ত হয় এসব ইঞ্জিন। ওয়ারেন্টি পিরিয়ড শেষ না হতেই সেসব ইঞ্জিনে দেখা দিয়েছে ব্যাপক জটিলতা।
ইতোমধ্যে তিনটি ইঞ্জিন অকেজো হয়ে পড়ে আছে রেলওয়ে পাহাড়তলী লোকো শেড ও পাহাড়তলী ডিজেল লোকোমোটিভ ওয়ার্কশপে।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে মিটারগেজ ১০টি করে দুই চালানে মোট ২০টি লোকোমোটিভ (রেল ইঞ্জিন) আসে।
দীর্ঘ ১ বছর লাইনে দেওয়া হয়নি ইঞ্জিনগুলো। পরে যখন ইঞ্জিনগুলো লাইনে দেওয়ার ট্রায়াল চলে সেখানে দেখা যায় ৩টি ইঞ্জিন অকেজো রয়েছে।
কিন্তু আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বলছিল, ১০ বছরে হাতও দিতে হবে না। কিন্তু ১ বছরের মধ্যে দেখা দিয়েছে সমস্যা। ইঞ্জিনগুলোর নম্বর ৩০১৮, ৩০১২, ৩০০৮।
বিভাগীয় যান্ত্রিক প্রকৌশলী (লোকো) পাহাড়তলী ওয়াহিদুর রহমান বলেন, আমদানি করা ২০ ইঞ্জিনের মধ্যে ১৭টি সচল রয়েছে। তিনটি ইঞ্জিনে অপারেশন চলছে।
এদিকে, চুক্তি অনুযায়ী সঠিক ইঞ্জিন সরবরাহ দেয়নি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। ২ হাজার ২০০ অশ্বক্ষমতার এই ইঞ্জিন ১০টি চালাতে প্রতিটির জন্য ৩ হাজার ২০০ কেভিএ (কিলো ভোল্ট এম্পিয়ার) ক্ষমতাসম্পন্ন জেনারেটর ক্রয়ের চুক্তি হয়। কিন্তু ৩ হাজার ২০০ কেভিএ-এর দামেই কেনা হয়েছে ২ হাজার ২০০ কেভিএ জেনারেটর, যা দিয়ে লোকোমোটিভের প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এখন ইঞ্জিনগুলোর অশ্বক্ষমতা ২২শ কি না তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
২০১৮ সালের ১৭ মে ১০টি মিটার গেজ লোকোমোটিভ সরবরাহে দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই রোটেম কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে রেলপথ মন্ত্রণালয়। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে ২৯৭ কোটি ৬৩ লাখ ৩০ হাজার ৫৬০ টাকা ব্যয় হয়।
নানা সমস্যায় জর্জরিত এই ১০ ইঞ্জিন বাংলাদেশকে সরবরাহ করেছে কোরিয়ার হুন্দাই রোটেম প্রিশিপমেন্ট ইন্সপেকশন কোম্পানি (সিসিআইসি)। ইঞ্জিনগুলো তৈরিতে অনুসরণ করা হয়নি সঠিক কারিগরি নির্দেশনা। এতে চুক্তি অনুযায়ী অনেক কিছু দেয়নি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান।
জানা গেছে, আমদানি করা এসব ইঞ্জিনের প্রতিটির ওজন ৯০ টন। রেলে এর আগে তুলনামূলক ভালোমানের ইঞ্জিনগুলোর গড় ওজন প্রায় ৭০ টন। রেলের বহরে থাকা মেইল লাইনে চলমান ২৬০০, ২৭০০ ও ২৯০০ সিরিজের ইঞ্জিনগুলো ১৫০০ হর্স পাওয়ারের। এসব ইঞ্জিন গড়ে ৮০ কিলোমিটার গতিবেগে চলাচল করতে পারে। নতুন আমদানি করা ইঞ্জিনগুলো ২২০০ হর্স পাওয়ারের। নতুন এ ইঞ্জিনগুলোর সিরিজ নির্ধারণ করা হয়েছে ৩০০১ থেকে ৩০১০ পর্যন্ত।
অভিযোগ রয়েছে, যখন ইঞ্জিনগুলো আমদানি করা হয় তখন প্রকল্প পরিচালক ছিলেন নূর আহমেদ। তিনি ইঞ্জিনগুলো বুঝিয়ে নিতে গেলে সব ইঞ্জিনে নিম্নমান, ত্রুটি দেখতে পান। তিনি এ ইঞ্জিনগুলো বুঝে নিতে অস্বীকৃতি জানান। পরে প্রকল্প পরিচালককে সরিয়ে সেখানে নতুন পরিচালক নিয়োগ দিয়ে ইঞ্জিনগুলো নেওয়া হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলের একজন যান্ত্রিক প্রকৌশলী বলেন, ইঞ্জিনগুলো জাহাজে তোলার আগে কারিগরি স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী তৈরি করা হয়েছে কি না সেই সার্টিফিকেটও দেওয়ার কথা। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি লোকোমোটিভগুলোর কোনো প্রি-শিপমেন্ট ইন্সপেকশন রিপোর্ট দাখিল করেনি রেলওয়েকে। তাদের রিপোর্টে মূল কিছু যন্ত্রাংশের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ছিল না। দুই ধরনের সার্টিফিকেট ইস্যুর কারণে ওই সার্টিফিকেটের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও আমাদের সন্দেহ হয়। পরে প্রকল্প দপ্তর থেকে বারবার তথ্য চাওয়া হয়। কিন্তু তা পাওয়া যায়নি।
লোকোমোটিভগুলো চট্টগ্রামের পাহাড়তলী লোকো শেডে রয়েছে। প্রতিটি ইঞ্জিনে জেনারেটর, মডেল, কত কেভিএ বা ক্ষমতাসম্পন্ন সেই রিপোর্ট এখনো চূড়ান্ত করতে পারেনি রেলওয়ে।