ঢাকা, সোমবার ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ই পৌষ ১৪৩১

মায়ের মতো পাই না তো কাউকে-সৈয়দা শেফালি খানম

এমএ রহিম, সিলেট : | প্রকাশের সময় : মঙ্গলবার ৪ জুন ২০২৪ ০৩:০১:০০ অপরাহ্ন | সিলেট প্রতিদিন

‘আমার মায়ের ভালোবাসা, পৃথীবির কোনো সম্পদের সাথে তুলনা করা যায় না। তুলনা করা যায় না অন্য কারো ভালোবাসার সাথে। সব কিছুতেই পাওয়া যায় ভেজালের মিশ্রণ। কিন্তু আমার মায়ের ভালোবাসায় নেই বিন্দু পরিমাণ ভেজাল। মায়ের রাগান্বিত চেহারায়ও বিরাজ করে ঘাঁটি ভালোবাসার আহŸান। দুই হাত তুলে মহান আল্লাহুর দরবারে হৃদয় নিঙ্গাড়ো দোয়া করেন আমাদের (১০ ভাই-বোন) জন্যে। মায়ের দোয়া আমাদের জীবন চলার পথে একমাত্র অবলম্বন। শুধু মা নয়। বাবা অনেক অসুস্থ। বয়স ৯০ বছর। একটু সুস্থতা অনুভব করলে আমাদের ভাই বোনসহ সকলের খোঁজ নেন। আমার এই বাবা আমার জন্মের পর আয়োজন করে মিলাদ মাহফিলের আয়োজেন করেছিলেন। আমার জন্ম নিয়ে বাবার যে কি আনন্দ ছিল-শুনেছি মায়ের মুখে।’

সিলেট জেলার ওসমানীনগর উপজেলার সাদিপুর ইউনিয়নের সৈয়দপুর গ্রামের ঐতিহ্যবাহী পরিবারের সন্তান সৈয়দা শেফালি খানম। বাবা সৈয়দ শফি উদ্দিন, মা সালেহা খানম। ১০ ভাই বোনের মধ্যে শেফালি খানম তৃতীয়। পুরো পরিবার বসবাস করেন যুক্তরাজ্যে। সবাই বৃটিশ নাগরিক। পরিবারের সবাই নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে সফল ও প্রতিষ্ঠিত। জন্মমাটির টানে তাঁদের পরিবারের সকল সদস্যই প্রায় সময় ছুটে আসেন দেশে। বিশেষ করে দুই ঈদকে কেন্দ্র করে গ্রামের বাড়ি হয়ে উঠে জমজমাট। এই দুই ঈদের সময় মা ও বাবা অবস্থান করেন দেশে। মা-বাবাকে কেন্দ্র করে শেফালি খানমের ভাই বোনেরাও ছুটে আসেন দেশে। বিশেষ করে বড় ভাই সৈয়দ সাজিদ উদ্দিন কামরান সার্বক্ষণিক মা-বাবার আশপাশে অবস্থান করেন। মা-বাবার সাথে আসেন গ্রামের বাড়িতে। আবার ফিরে যান একসাথে। ভালোবাসার অসাধারণ এক প্রমাণ।

শেফালির ভাষায় ‘বড় ভাই কামরান আমাদের পুরো পরিবারের অক্সিজেন। আমরা ১০ ভাই-বোন বসবাস করি পৃথক বাসা-বাড়িতে। কর্মস্থলও পৃথক। কিন্তু আমাদের চলাফেরার কেন্দ্রবিন্দু মা-বাবাকে ঘিরে। মা-বাবার নির্দেশনায় পরিচালিত হয় পরিবারের প্রতিটি সদস্য। আর বড় ভাই কামরান ছায়ার মতো হয়ে থাকেন। আমাদের নানান ধরণের কর্মকান্ডে বড় ভাইয়ের ডাক পড়ে।’

জুন মাসের শেষ দিকে দেশে এসেছেন শেফালি খানম। মা অসুৃস্থ-এই খবর পেয়ে ছুটে আসেন দেশে। হিথ্রো বিমানবন্দর থেকে বিমানে উঠেন। বিমানে আরোহনের পরপরই মায়ের কথা স্মরণে আসে। দুই চোখ ভরে পানি আসে। ১০ বছর পর দেশে আসছেন-এই কথা সামনে আসতেই কান্নার বেগ আরো বেড়ে যায়। পাশের নারী যাত্রী স্বাভাবিক করেন শেফালিকে। ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমেই বের হয়ে আসেন বাইরে। একটি গাড়ি নিয়ে প্রায় ৫০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে সোজা বাড়িতে। নতুন বাড়ির মায়ের কক্ষে পৌঁছে যান। সবাই অবাক। কিন্তু ততক্ষণে মায়ের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন মা ও মেয়ে। নয়ন ভরে মা-কে দেখে নেন।

বাড়িতে পৌঁছেই কোনো বিশ্রাম নেই। সকল আয়োজন থাকার পরও মা-বাবার দেখাশোনা করার দায়িত্ব নিজ কাধে তুলে নেন। নিজ হাতে রান্নার আয়োজন করেন। বাড়ির প্রতিটি কাজে তদারকি শুরু করেন। গভীর রাত, অনেক সময় সকাল পর্যন্ত মা-বাবার শিয়রে বসে নির্ঘুম রাত কাটিয়ে দেন। মা-বাবা ঘুমিয়ে পড়লে বিশ্রামে যান শেফালি খানম। সকাল হতেই জেগে উঠেন। নিজ হাতে সকলের জন্যে নাস্তা তৈরি করেন। আত্মীয়স্বজনসহ সকলের খাওয়া দাওয়ার খবর নেন। কাজের ফাঁকে খোঁজ নেন মা-বাবার। সিলেটি মায়ের এক অসাধারণ সন্তান শেফালি খানম। মায়ের কাছে দিক্ষা নিয়ে অহঙ্কারমুক্ত জীবন ধারণ করছেন তিনি।

শেফালি খানম ভাই বোনের মধ্যে তৃতীয়। ১০ ভাই বোন হলেন, সৈয়দ কামরান, সৈয়দ কামাল, সৈয়দা শেফালি, সৈয়দা সোহেলী, সৈয়দা চামেলী, সৈয়দ কাওছার, সৈয়দ কুদ্দুস, সৈয়দা লাইলী, সৈয়দা সাহেদা ও সৈয়দা জাহেদা। যুক্তরাজ্যের মাটিতে নিজ নিজ  কর্মস্থলে সবাই প্রতিষ্ঠিত। সবাই ব্যস্ত থাকেন নিজ নিজ কাজ নিয়ে। কিন্তু মা-বাবা যখন যাকে ডাকেন তিনি ছুটে যান মা-বাবার কাছে। এখানে কোনো ধরণের উজর আপত্তি করার সুযোগ নেই।
শেফালি খানম জানান, ‘মায়ের আদর্শকে আমরা সকল ভাই বোন অক্ষরে অক্ষরে পালন করি। শৈশব থেকে মায়ের আদর্শে আমরা দীক্ষা নিয়েছি। শৈশবে বুঝতে শেখার পর প্রথমেই মায়ের মুখে শুনেছি আল্লাহ নবীর নাম। আরবি হরফের প্রথম শিক্ষা অর্জন মায়ের কাছে। দেখেছি ভোরবেলা মা জেগে উঠতেন। ফজরের নামাজের পর ডেকে তুলতেন আমাদেরকে। সকলকে প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশনা দিয়ে মা চলে যেতেন পাকঘরে। সকালের নাস্তা তৈরিতে মনোযোগ দিতেন। আমাদেরকে আরবি পড়ার টেবিলে যেতে বলতেন। মা আমাদের সবাইকে পড়াতেন আরবি। যদিও গৃহশিক্ষক ছিল, কিন্তু আরবি পড়া গুরুত্বসহকারে তদারকি করতেন মা। আরবি পড়ানোর পাশপাশি নামাজ পড়ার তালিম দিতেন। বলতে গেলে শিশু বয়সেই মায়ের কাছ থেকে নামাজ পড়তে শিখেছি। একই সঙ্গে মায়ের কাছ থেকে বাংলা পড়ার হাতেখড়ি হয়েছে। বয়স ৫ হতেই স্থানীয় প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করানো হয়। শুরু হয় স্কুল জীবন। লেখাপড়ার বিষয়ে মা ছিলেন অত্যন্ত কঠোর। কোনোভাবেই ফাঁকি দেয়া যেত না। সকালে আরবি ও বাংলা পড়া শেষে স্কুলে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত করে দিতেন মা। স্কুলের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার সময় কপালে চুমো দিয়ে দিতেন। কারো সাথে দুষ্টুমি বা অন্যায় আচরণ না করার জন্যে পরামর্শ দিয়ে দিতেন। স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পর দেখতাম মা অপেক্ষা করছেন। ঘরে ফিরতেই মা মুখের দিকে তাকাতেন। ফ্রেস হয়ে খাবার টেবিলে যেতে বলতেন। বিকেলের সময়টা কেটে যেত বিশ্রামে অথবা মায়ের বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করে। সংসারের তৃতীয় সন্তান আমি। কিন্তু মেয়ে হিসেবে ছিলাম বড়। স্বাভাবিকভাবে মায়ের প্রতিটি কাজে সহযোগিতা করার চেষ্টা করতাম। সন্ধ্যা হতেই কিছুটা সময় আরবি পড়ার পেছনে সময় দিতাম। পড়ে আমরা সকল ভাই বোন এক টেবিলে বসে বাংলা পড়তাম। এসময় আমাদেরকে সহযোগিতা করতেন গৃহশিক্ষক। বাবা কর্মস্থল যুক্তরাজ্যে থাকতেন। স্বাভাবিক অবস্থায় মা ও বাবা এই দুইজনের দায়িত্ব পালন করতেন মা। রাতের পড়া ও খাবার শেষে মা আমাদের নিয়ে ঘুমের আয়োজন করতেন। আমরা না ঘুমানো পর্যন্ত মা জেগে থেকে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করতেন। আমরা ঘুমিয়ে পড়লে সংসারের শেষ কাজ সম্পন্ন করে ঘুমাতে যেতেন মা। ১৯৮৭ সালে আমাদের পুরো পরিবার যুক্তরাজ্যে চলে যাই স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্যে। যুক্তরাজ্যের মাটিতে গিয়ে মা আমাদেরকে মানুষের মতো মানুষ করার জন্যে নিজকে আত্মনিয়োগ করেন। লেখাপড়া শেষে আমরা সকল ভাই বোন নিজ নিজ কর্মস্থলে সফলতার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হই। মায়ের দোয়া, উৎসাহ, অনুপ্রেরণা আমাদেরকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আজো। মায়ের অনুপ্রেরণায় শিক্ষকতা করেছি দীর্ঘদিন। এখন অন্য পেশায় যুক্ত। মা ও বাবার আদর্শই আমাদের জীবনের পাথেয়। আজো আমাদের পছন্দের খাবারসহ অন্যান বিষয়ে নজর রাখেন তিনি।’

‘এইত ৩ জনু ২০২৪ সালের কথা। আমার মেজ ভাই কামাল যুক্তরাজ্য থেকে দেশে এসেছেন। মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে তিনি ছুটে এসেছেন দেশে। ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কামাল ভাইকে রিসিভ করেন আমাদের গুরুজন বড় ভাই কামরান। বাড়িতে পৌঁছতেই মা ও বাবা অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেন। ভাইকে কাছে পেয়ে মা ও বাবার মাঝে নেমে আসে আনন্দ। পরে কামাল ভাই ছুটে যান হযরত সৈয়দ শাহ তাজ উদ্দিন (রহ.) এর মাজার জেয়ারত করতে। বিকেল থেকেই আত্মীয়স্বজনসহ বন্ধুদের মিলনমেলা হয় বাড়িটিতে। মায়ের বয়স ৭০ বছর অতিক্রম করেছে। শারীরিকভাবে অসুস্থ। কিন্তু আমাদের পছন্দের মাছ আনার জন্যে তিনি গাড়ি চালককে নিয়ে বাজারে গিয়েছিলেন। নানান পদের মাছ নিয়ে বাড়িতে ফেরেন মা। অসুস্থ হয়েও মা আমাদেরকে প্রাণবন্ত রাখতে সার্বক্ষণিক নজরদারী করে যাচ্ছেন।’

শেফালি খানম জানান, ‘আমি এখন চার সন্তানের জননী। আমার দুই মেয়ে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত। অপর দুই সন্তান লেখাপড়ায় আছেন। কিস্তু  মায়ের কাছে আজো আমি শিশু। শিশুর সাথে যে আচরণ করেন মা একই আচরণ আমার সাথে করেন আমার মা। আমার মা আমার গর্ব, অহঙ্কার, আদর্শ ও জীবন গড়ে দেয়ার কারিগর।’