গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষায় কোনো শিক্ষার্থী পাস করেনি। ঢাকা বোর্ডের অধীনে ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি থেকে শতভাগ শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছে। স্কুলটি থেকে এ বছর মোট ১২ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিয়েছিল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির নাম লখন্ডা জীরাতলি মাধ্যমিক বিদ্যালয়। বিদ্যালয়টি উপজেলার গোহালা ইউনিয়নের জিরাতলী গ্রামে অবস্থিত। স্কুল কর্তৃপক্ষ বলছে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় অমনোযোগী ও মোবাইল আসক্ত হওয়ায় এমনটি হতে পারে। তবে স্থানীয়রা ও শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা বলছেন, নিয়মিত ক্লাস না নেওয়া ও শিক্ষকদের গাফিলতির কারণে এমন ফলাফল এসেছে। উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বলছেন, এমন ফলাফল করায় স্কুলটির বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ১৯৭৩ সালে স্থাপিত স্কুলটিতে বর্তমানে শিক্ষার্থী রয়েছে প্রায় দেড় শতাধিক। তখন থেকে নিম্ন মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যক্রম চলে আসছিল। গত বছর প্রথমবারের মতো মাধ্যমিক পাঠদানের অনুমতি দেয় শিক্ষাবোর্ড। সেই বছর পার্শ্ববর্তী অন্য একটি স্কুলে রেজিস্ট্রেশন করে ১৪ জন শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ৯ জন শিক্ষার্থী পাস করেন। এ বছর প্রথমবারের মতো নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে রেজিস্ট্রেশন করে ১২ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নেয়। এবার ফল প্রকাশের পর দেখা যায় স্কুলটি থেকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা ১২ জন শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে স্কুলটিতে নিয়মিত পাঠদান হয় না। নির্ধারিত সময়ের আগেই স্কুল ছুটি দিয়ে শিক্ষকরা বাড়িতে চলে যান। এছাড়া শিক্ষার্থীরা মোবাইলে আসক্ত, পড়াশোনায় অমনোযোগী ও অভিভাবকদের উদাসিনতায় এমনটি হতে পারে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। বিষয়টি নিয়ে সরেজমিনে গেলে দেখা যায়, স্কুলটি বন্ধ। বিদ্যালয়টি টিনের বেড়া দিয়ে ঘেরা। বিদ্যালয়ে কোনো শিক্ষক-শিক্ষার্থী বা অফিস সহকারি নেই। টিনের বেড়ার দুইটি দরজা রয়েছে। দরজা দুটি তালা বন্ধ করা। কিছু সময় পর ওই বিদ্যালয়ের অফিস সহায়ক তন্ময় মন্ডলকে উত্তর পাশের বাড়ি থেকে লোকের মাধ্যমে খবর দিয়ে আনলে কিছু সময় পর সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পর তিনি সেখান থেকে কৌশলে পালিয়ে যান। ওই বিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিদিন আমাদের ক্লাস শুরু হওয়ার কথা দশটায় থাকলেও শিক্ষকরা আসেন সাড়ে ১১টায়। আবার আড়াইটা বাজলেই ছুটি দিয়ে দেন তিনটার মধ্যে তারা বিদ্যালয় বন্ধ করে চলে যান। এলাকার লোকজন এ বিষয় নিয়ে কোনো কথা বলেন না, কারণ এলাকা ও স্কুলটির বদনাম হবে তাই। কোনো শিক্ষকই ২০ থেকে ২৫ মিনিট এর বেশি ক্লাস নেন না। ওই সময় কথা হয় ওই বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী অধরা মন্ডলের সঙ্গে। সে বলেন, ঢাকায় আন্দোলন হচ্ছিল এজন্য বিদ্যালয়ে কোনো স্যার আসেননি। এ বছর মাধ্যমিক পরীক্ষায় ১২ জন অংশগ্রহণ করে সকলেই অকৃতকার্য হয়েছে। কিছু সময় পর ওই বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য তারাপদ মন্ডলের সঙ্গে দেখা হলে তিনি বলেন, বিদ্যালয়ের মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল খারাপ হওয়ার কয়েকটি কারণ রয়েছে। এর মধ্যে একটি অন্যতম কারণ হলো আমাদের গ্রামের পাশের তিনটি গ্রামের তিনটি ভালো মেধা স¤পন্ন বিদ্যালয় রয়েছে শিক্ষার্থীগুলো সেখানেই চলে যায়। কম মেধাবী শিক্ষার্থীগুলো এখানেই ভর্তি হয়। তাছাড়া আমাদের এখানকার শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অবহেলা রয়েছে। তারা জানে না তার শিক্ষার্থী কখন কোথায় যাচ্ছে ঠিকমতো লেখাপড়া করছে কিনা কোনো খোঁজ খবর রাখে না। নাম প্রকাশ না করা শর্তে ওই বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবকের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, এই বিদ্যালয়ের এ বছর ১৬ জন শিক্ষার্থী মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। এরমধ্যে ১২ জন শিক্ষার্থী নির্বাচনী পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়েছিল। অন্য চারজন শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হওয়ায় তাদের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হয়নি। আমার কথা হলো যারা নির্বাচনী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করল এবং কৃতকার্য হলো তারা কেন বোর্ড পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলো? এখানে শিক্ষকরা টাকার বিনিময়ে অকৃতকার্য সকল শিক্ষার্থীদের নির্বাচনী পরীক্ষায় পাস করিয়েছে। না হলে একটি স্কুল থেকে সকল শিক্ষার্থী ফেল করে কীভাবে? এ বিষয়ে অকৃতকার্য হওয়া এক শিক্ষার্থীর অভিভাবকের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, সারা বছর শিক্ষকরা ঠিকমতো পড়াশোনা করে নাই। শিক্ষার্থীদের ওপর ঠিকমতো নজরদারি নেই শিক্ষকদের। তাই এমন ফলাফল এসেছে। আমার সন্তানের একটি বছর লস হয়ে গেল। এ দায়ভার আমরা নাকি স্কুল কর্তৃপক্ষ নেবে? ওই বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি হরিপদ রায়ের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, বিদ্যালয় থেকে এ বছর ১২ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিল। একজনও পাস করতে পারল না। এটা খুবই দুঃখজনক। তবে আমরা শিক্ষকদের থেকে শিক্ষার্থীদেরই দোষ বেশি দেব। আর নির্বাচনী পরীক্ষায় কোনো অনিয়ম হয়েছে কিনা সেটা আমার জানা নেই। এটাই আমাদের বিদ্যালয় থেকে প্রথম পরীক্ষা, তাই হয়তো একটু সমস্যা হয়েছে আগামীতে এই সমস্যাগুলো থাকবে না। বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক ইবাদত শেখ বলেন, আমাদের স্কুল থেকে ১২ জন শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিল। তারা সকলেই অকৃতকার্য হয়েছে। এটা খুবই দুঃখজনক। সেই সঙ্গে বলব কিছুটা ব্যর্থতা আমাদেরও আছে। এ বছর প্রথমবারের মতো আমাদের স্কুল থেকে শিক্ষার্থীরা এসএসসি পরিক্ষায় অংশ নিয়েছে। এবারই স্কুলটি থেকে শতভাগ শিক্ষার্থী ফেল করল। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রমেন্দ্রনাথ টিকাদারের সঙ্গে ফোনে কথা হলে তিনি বলেন, ১২ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে একজনও পাস করতে পারেনি, এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। আমি কারও সামনেই কথা বলতে পারছি না। আসলে আমাদের কোথায় দুর্বলতা এ বিষয়গুলো আমি খুঁজে পাচ্ছি না। এজন্য বিদ্যালয়ে সভা আহ্বান করা হয়েছিল। কিন্তু সেখানে কেউই উপস্থিত হয়নি দুই একজন ব্যক্তি উপস্থিত হয়। এ বিষয়ে মুকসুদপুর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শাহাদাত আলী মোল্লা বলেন, বিষয়টি আমরা জেনেছি। স্কুলটিতে শতভাগ শিক্ষার্থী ফেল করেছে। আমরা এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে তাদের শোকজ করা হবে।
গোপালগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা) গোলাম কবীর বলেন, স্কুলটি থেকে ১২ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিয়েছিল। তারা সবাই ফেল করেছে। এটি দুঃখজনক। বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখব। সেই সঙ্গে নীতিমালা অনুযায়ী স্কুলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
দুলাল বিশ্বাস, গোপালগঞ্জ।
তাং-০৩-০৮-২০২৩