২৯ নভেম্বর, ঘড়ির কাঁটায় রাত তখন ১০টা পেরিয়েছে। রাজধানীর রামপুরায় রাস্তা পার হচ্ছিলেন একরামুন্নেসা স্কুলের সদ্য এসএসসি পরীক্ষা দেওয়া শিক্ষার্থী মাইনুদ্দিন। ওই সময় অনাবিল পরিবহনের বেপরোয়া একটি বাসের ধাক্কায় ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান তিনি। ঘটনার পরই ওই এলাকায় অন্তত আটটি বাসে অগ্নিসংযোগ এবং আরও চারটি গাড়ি ভাঙচুর করে বিক্ষুব্ধ জনতা।
মাইনুদ্দিনের মৃত্যুর পরদিন তার হত্যার বিচার ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে রামপুরা ব্রিজ অবরোধ করে আন্দোলনে নামে তার সহপাঠীরা। পরে তাতে যোগ দেয় বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। এক পর্যায়ে আন্দোলনের সঙ্গে যোগ হয় ‘হাফ পাস’ এবং নিকট অতীতে সড়কে শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনাগুলোর সুষ্ঠু বিচার দাবি। মাত্র একদিনের ব্যবধানে সে দাবি রূপ নেয় ১১ দফায়। রাজধানীর বেশ কয়েকটি জায়গায় স্ফূলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ে শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলন।
২০১৮ সালে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের মতো এতটা তীব্র না হলেও এবার সেই আন্দোলন থেকেই অনুপ্রেরণা খুঁজে নিয়েছিল বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। সড়কে যান চলাচলে শৃঙ্খলা ফেরাতে এমনকি ট্রাফিকের ভূমিকায়ও দেখা যায় শিক্ষার্থীদের। আন্দোলন চলাকালে সরকারি-বেসরকারি সব গাড়িতেই চালক ও গাড়ির লাইসেন্স যাচাই করে তারা।
আন্দোলনের মুখে বাসে শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ পাস তথা অর্ধেক ভাড়া নেওয়ার আশ্বাস দেয় গণপরিবহন মালিক সমিতি। তবে এর সঙ্গে আরও পাঁচটি শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়। এই শর্তের মধ্যে আছে ভ্রমণকালে শিক্ষার্থীদের অবশ্যই নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ইস্যু করা ছবিযুক্ত হালনাগাদ বৈধ পরিচয়পত্র সঙ্গে রাখা, সকাল ৭টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত বেসরকারি বাসে চলাচলের ক্ষেত্রে এ হাফ ভাড়ার সুযোগ রাখা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটির দিনে এ হাফ ভাড়া প্রযোজ্য না হওয়া এবং দূরপাল্লার বাসে এ হাফ ভাড়া প্রযোজ্য না হওয়া।
মালিক সমিতির পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হয়, সব চালকের পেন্ডিং ড্রাইভিং লাইসেন্স বুঝিয়ে দেওয়া হবে এবং পরিবহন শ্রমিকেরা মাদকাসক্ত অবস্থায় গাড়ি চালাচ্ছেন কি না, তা নিশ্চিত করতে ডোপ টেস্ট করা হবে। এরপরই মাইনুদ্দিনের মা রাশিদা বেগমের করা মামলায় গ্রেফতার হন সেই অনাবিল বাসের চালক, হেলপার ও কন্ট্রাক্টর।
নভেম্বরের শুরু থেকে টানা ১১ দিন চলে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। আন্দোলনের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিতর্কিতভাবে হাফ পাসের ঘোষণা কার্যকর হলেও নিরাপদ সড়কের দাবিতে তাদের যে মূল স্লোগান ও দাবি, তার কিছুই আদায় হয়নি। আন্দোলন থেকে অর্জিত সফলতায় সন্তুষ্ট নন তারা।
আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের একজন খিলগাঁও মডেল কলেজের শিক্ষার্থী সোহাগী সামিয়া বলেন, ‘আগে কিন্তু যথাযথভাবে হাফ ভাড়া নেওয়া হতো না। আমাদের দুই নম্বর দফায় ছিল হাফ ভাড়ার কথা। সেটা হয়তো পুরোপুরি মানা হয়নি, শর্ত দিয়ে আংশিক মানা হয়েছে। তবু তো মানা হয়েছে। আন্দোলনের প্রভাব কিছুটা হলেও তো পড়েছে।’
সোহাগী বলেন, ‘আমাদের আরেকটা দাবি ছিল, চালকরা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় গাড়ি চালায় কি না তার একটা ব্যবস্থা নেওয়া। চালকদের ডোপ টেস্ট ও কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা খবরে দেখতে পেলাম যে, জানুয়ারি মাস থেকে চালকদের ডোপ ডেস্টটা করা হবে। কাউন্সেলিংয়ের কথাটা যদিও বলেনি, কিন্তু ডোপ টেস্টের কথা বলেছে। আন্দোলন করে অন্তত এই দুটো জিনিস আংশিকভাবে পাওয়া গেছে। আমরা মনে করি, আন্দোলনের পথ ধরেই এটুকু অর্জন সম্ভব হয়েছে।’
দাবি মেনে গণপরিবহনে হাফ পাস কার্যকর করা হলেও শর্ত বেঁধে দেওয়ায় সন্তুষ্ট নন শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনে অংশ নেওয়া সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তানজিলা আহমেদ বলেন, ‘প্রথমে তো বলেছিল রাত ৮টা পর্যন্ত হাফ পাস নেবে। যদিও রাত ৮টার পরও হাফ ভাড়া আমরা নিতে দেখছি। এছাড়া তারা যে পাঁচ শর্ত দিয়েছে, সে শর্তগুলোও তো আমরা শিক্ষার্থীরা মানি না। শর্ত মেনে হাফ ভাড়া দেওয়ার মধ্যে কোনো সন্তুষ্টি নেই আমাদের। এ অর্জনে আমরা সন্তুষ্ট নই। এই ১২ দিনে আমাদের কোনো সফলতা আসেনি বলেই মনে করি। হাফ পাসের আন্দোলন তো আরও আগে থেকেই চলছিল। বিশেষ করে রামপুরায় মাইনুদ্দিন নিহত হওয়ার পর নিরাপদ সড়কের যে আন্দোলন হলো, তাতে বিশেষ কোনো ফলাফল আসেনি।’
আন্দোলনে কী পেলেন জানতে চাইলে আরেক শিক্ষার্থী সেঁজুতী খন্দকার বলেন, ‘সড়কে যে অন্যায় চলে, তা তো আর আমরা হুট করে থামিয়ে দিতে পারবো না। এর জন্য রাস্তায় দাঁড়াতে হবে। সে লক্ষ্যেই আমরা রাস্তায় দাঁড়িয়েছি। সড়কে চালকদের বিভিন্নভাবে সচেতন করেছি। আমাদের কার্যক্রমগুলো তো সাধারণ মানুষের চোখে পড়েছে। প্রশাসনের চোখেও পড়েছে। এটাই হয়তো আমাদের প্রাপ্তি। আমরা প্রশাসন ও মালিক সমিতি কিংবা পরিবহন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে একটা সময় দিয়েছি। যদি এই সময়ের মধ্যে সমাধানের পথ বের করা না হয়, তবে আবার রাজপথে নামবো। আমরা কিন্তু ঘরে বসে নেই। লিফলেট বিতরণের মাধ্যমে কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছি, সাধারণ জনগণের কাছে যাচ্ছি। আমাদের ১১ দফা সবার কাছে পৌঁছে দিচ্ছি। মানুষ আমাদের অকুণ্ঠ সমর্থন দিচ্ছে।’
হাফ পাস নিয়ে এই শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমরা হাফ পাস নিয়ে আইন করতে বলেছিলাম। রাত ৮টার পরেও তো আমরা ছাত্রই থেকে যাই। মালিক সমিতি বলেছে আইডি কার্ড দেখাতে হবে। বন্ধের দিন হাফ পাস হবে না। ১০ টাকার ভাড়া ১৫ টাকা করে আবার ১০ টাকাই নেওয়া হচ্ছে আমাদের কাছ থেকে। তার মানে হাফ পাসও হয়নি, কোনো কিছুই হয়নি। চালকদের ডোপ টেস্টের কথা বলা হলেও এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। লাইসেন্স দেওয়া হবে বলা হলেও এখনো তেমন কিছু চোখে পড়ছে না। এর মানে আমাদের উল্লেখযোগ্য কিছুই অর্জিত হয়নি।’
গণপরিবহনে হাফ পাসসহ নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখা আরেক শিক্ষার্থী পৃথু হামিদ বলেন, ‘রামপুরা থেকে জেগে ওঠা আন্দোলনে কোনো সফলতা বা অর্জন বলতে আমরা কিছুই পাইনি। মাইনুদ্দিন হত্যার আগে থেকেই আমাদের হাফ পাসের দাবি ছিল। বিনা শর্তে আমরা সেটি চেয়েছিলাম। কিন্তু সরকার সেটি আমাদের দেয়নি। আমাদের শর্তসাপেক্ষে হাফ পাস দিয়েছে। আমরা কিন্তু সেটা মেনে নেইনি। যেহেতু সরকার সিদ্ধান্ত দিয়েছে সেটা বাধ্য হয়ে মানতে হবে, কিছু করার নেই। আমরা শর্তসাপেক্ষে হাফ পাসকে সম্পূর্ণ বয়কট করেছি। রামপুরায় আন্দোলনে নামার প্রথমদিনই মালিক সমিতি যে ঘোষণা দিয়েছিল, সেটাই কিন্তু সরকার প্রজ্ঞাপন হিসেবে জারি করেছে। যেটা আমরা প্রথমদিনই বর্জন করেছিলাম। পরবর্তীতেও তো বর্জনই করেছি।’
আন্দোলন থেকে কী প্রাপ্তি, জানতে চাইলে আক্ষেপ করে এই শিক্ষার্থী বলেন, ‘পাওয়া-না পাওয়ার কথা বলতে গেলে, আন্দোলনের ১২ দিনেও আমরা সড়কে চারটা লাশ পড়তে দেখলাম। পাওয়ার মধ্যে শুধু এতটুকুই।’
আবারও আন্দোলনে নামার পরিকল্পনা আছে কি না জানতে চাইলে পৃথু হামিদ বলেন, ‘আমরা যারা সাধারণ শিক্ষার্থী, তাদের জন্য একত্রিত হওয়াটা কঠিন। ২০১৮ সালে হঠাৎ যেভাবে একত্রিত হয়েছিলাম, ২০২১ সালে এসে কিন্তু ততোটা সংঘবদ্ধ নই আমরা। আমরা তো কারও ডাকে আন্দোলনে নামি না। কোনো ঘটনার প্রেক্ষাপটে নিজেদের মতো করেই নামি। নিজেদের দাবিগুলো নিয়ে সংশ্লিষ্টদের চাপ প্রয়োগ করার মতো সক্ষমতা আমাদের নেই। কিন্তু আমরা শিক্ষার্থীরা যার যার ক্যাম্পাস থেকে যতটুকু সম্ভব নিজেদের সক্ষমতায় কথা বলা এবং দাবিগুলো সরকারের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছি এবং করে যাবো।’
ভবিষ্যতে আন্দোলনে নামার কথা জানিয়ে সোহাগী সামিয়া বলেন, ‘আমরা সড়ক আন্দোলনের এখনো ইতি টানিনি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ডিসেম্বর মাসের শেষ ২০ দিনের সময় দিয়েছি। যদি আমাদের দাবি-দাওয়া কার্যকর না হয়, তবে ১ জানুয়ারি থেকে আবারও রাস্তায় নামবো। গণস্বাক্ষর নেবো এবং এ প্রক্রিয়ায় ছোট পরিসরে হলেও আমরা আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যাবো।’
‘দাবি-দাওয়া আদায় না হলেও একটা আন্দোলন একেবারে বিফলে যায় না। আন্দোলন থেকে সমাজ নতুন কিছু শিক্ষা নেয়, প্রতিবাদের প্রেরণা পায়। সচেতনতা হচ্ছে। শিক্ষার্থীরাও অধিকার ও দাবি আদায় করতে শেখে। নতুন কিছু গ্রহণ করে’—বলেন এ শিক্ষার্থী।