১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সাত সকালে বাবা আবদুল খালিকের হাকডাকে পরিবারের সদস্যদের ঘুম ভাঙ্গে। বাবা অনেকটা চিৎকার করে পরিবারের সদস্যদের জানিয়ে দিচ্ছিলেন জাতিরজনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। এই কথা বলে বাবা আবার বলছিলেন, না বঙ্গবন্ধুকে হয়তো হত্যা করা হয়নি। গ্রেফতার ও লুকিয়ে রেখে ক্ষমতা দখল করেছে বিপদগামীরা। আর রেডিওতে ঘোষণা করছে। বাবা এও বলেছিলেন বঙ্গবন্ধুকে হত্যার বিষয়টি মোটেই সত্য নয়। কারণ বঙ্গবন্ধুকে কেউ হত্যা করতে পারে না। এমন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে সারাদিন কেটে যায়।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতা এডভোকেট মোস্তাক আহমদ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের স্মৃতিচারণ করেন দৈনিক বায়ান্নের কাছে।
১৯৭৫ সালে এডভোকেট মোস্তাক আহমদের বয়স ছিল ১৪ বছর। সিলেট রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলের ৮ম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন তিনি। পরবর্তীতে ওই প্রতিষ্ঠানের নাম হয়েছে সিলেট ক্যাডেট কলেজ। রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলের চারটি আবাসিক হল ছিল। একটি হলে থাকতেন মোস্তাক আহমদ। ওই হলের নাম ছিল বঙ্গবন্ধু হল। এই স্কুলের শিক্ষার্থীরা খুব কমই ছুটি পেতেন। ২-৩ মাস পরপর ২-১ দিনের ছুটি পাওয়া যেত। এই ছুটি পেতে হলে অভিভাবক স্কুলে গিয়ে ছুটির প্রার্থনা করতেন। ১৪ আগস্ট মোস্তাক আহমদের ছোট চাচা বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল জলিল স্কুলে যান নিজে গাড়ি ড্রাইভ করে। ছুটি মঞ্জুর করিয়ে মোস্তাক আহমদকে গাড়িতে করে সিলেট শহরের শেখঘাটের বাসায় নিয়ে আসেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল জলিল।
মোস্তাক আহমদ বলেন, বাসায় প্রবেশ করতেই মমতাময়ী মা জড়িয়ে ধরেন মোস্তাক আহমদকে। খবর পেয়ে মোস্তাক আহমদের বাসায় আত্মীয়স্বজনরা জড়ো হন। বিশেষ করে মোস্তাক আহমদ যখন ছুটি নিয়ে বাসায় আসতেন তখন আত্মীয়স্বজনরা ওই বাসায় জড়ো হতেন। উৎসবের আমেজে মেতে উঠতেন সবাই। ১৪ আগস্ট একই অবস্থা হয়। রাতের খাবার শেষে সবাই ঘুমিয়ে পড়েন।
এডভোকেট মোস্তাক আহমদ জানান, তাঁর পিতা আবদুল খালিক নিয়মিত ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠতেন। ফজরের নামাজ শেষে কোরআন তেলওয়াত করতেন। এর পর রেডিওতে সকালের খবর শুনতেন। ১৫ আগস্ট সকাল বেলা একই ঘটনা ঘটে। কোরআন তেলওয়াত শেষে খবর শোনার সময় হয়ে আসে। রেডিও চালু করতেই অস্বাভাবিক ঘোষণা শুনতে পান বাবা আবদুল খালিক। ঘোষণায় বলা হচ্ছিল ‘স্বৈরাচারী মুজিব সরকারকে উৎখাত করা হয়েছে’। ঘোষণা শুনে বাবা আবদুল খালিক বিচলিত হয়ে পড়েন। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পরিবারের সকল সদস্যকে ডাকাডাকি শুরু করেন। সবাই ঘুম থেকে জেগে বাবার পাশে গিয়ে জড়ো হতে থাকেন। শুনতে পান রেডিওর ঘোষণা। এক সময় তিনি বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তায় গেলেন। সাথে মোস্তাক আহমদও ছিলেন। রাস্তায় গিয়ে দেখতে পেলেন অনেক লোকজন রাস্তায় জড়ো হয়েছেন। রেডিওর ঘোষণা নিয়ে অনেকে পক্ষে ও বিপক্ষে কথা বলছেন।
এডভোকেট মোস্তাক জানান, তিনি বাবার সাথে বাসায় ফিরেন। বাবার মধ্যে কিছুটা অস্থিরতা দেখা দেয়। কারণ মোস্তাক আহমদের শেখঘাটের বাসার আশপাশে তখনও বিপুল সংখ্যক স্বাধীনতা বিরোধী লোকজন বসবাস করতো। বাবা আবদুল খালিক সকলকে জানিয়ে দেন কেউ যাতে বিচলিত না হন। যেদেশে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়, সেদেশে লড়াই করে বেঁচে থাকতে হবে। প্রয়োজনে বঙ্গবন্ধুর জন্যে প্রাণ দিতে হবে। এই বলে সকলকে প্রস্তুত থাকার জন্যে বলেন। স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিকে প্রতিরোধ করতে হবে। এসময় বাবা আবদুল খালিকের চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছিল।
এডভোকেট মোস্তাক আহমদ জানান, সকালে ওই খবর পাওয়ার সারাদিন কেটেছে অনেক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু সিলেট সফর করেন। সে সময় মোস্তাক আহমদ সরাসরি সাক্ষাত পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর। বঙ্গবন্ধু জানতে চেয়েছিলেন কোন ক্লাসে পড়েন মোস্তাক আহমদ। সরাসরি বঙ্গবন্ধুর প্রশ্ন আজো ভুলতে পারেননি মোস্তাক আহমদ।