বরিশালের বাকেরগঞ্জে থ্রি-হুইলারকে পিষ্ট করা বিআরটিসি বাসটি বরিশাল থেকে তালতলী যাত্রী পরিবহন করলেও গাড়িটির অনুমোদিত রুট ছিল বরিশাল থেকে সাতক্ষীরা। বছরের পর বছর ধরে এই বাসটি অনুমোদিত রুট বাদ দিয়ে অন্য রুটে যাত্রী পরিবহন করলেও কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। তবে দুর্ঘটনার পর দুটি কারণ দেখিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ব এই বাসের ইজারা বাতিল করেছে বিআরটিসি।
অন্যদিকে আরেক রাষ্ট্রায়ত্ব প্রতিষ্ঠান বিআরটিএ জানিয়েছে, দুর্ঘটনাকবলিত কুমিল্লা-ব-০০৫৫ নম্বরের বাসটির ফিটনেস ছিল না সাত বছর। ছিল না বাসটি নিবন্ধনের সনদও। এমনকি এই বাসটি প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজের মালিকানায় ছিল। বিআরটিসির নামে মালিকানা বদল হওয়ার আগেই তা দীর্ঘ মেয়াদি ইজারা প্রদান করে বিআরটিসি। ইজারাদার স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে গাড়িটি শুধু পরিচালনাই করেনি, চালকের কোনো তথ্যও সরবারহ করেনি বিআরটিসি কর্তৃপক্ষকে।
বিশিষ্টজনরা প্রশ্ন তুলেছেন, এত অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে গাড়িটি পরিচালিত হলেও বিআরটিসি বা বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ কেন ব্যবস্থা নিতে পারেনি?
নিরাপদ সড়ক চাই বরিশাল জেলার আহ্বায়ক মো. রুহুল আমিন বলেন, পরিবহনখাতের যেখানে যাবেন সেখানেই অব্যবস্থাপনা। আমি অবাক হই, একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের গাড়ির যদি এই হাল হয়ে থাকে তাহলে বিআরটিসি ও বিআরটিএ এতদিন ধরে করল কী? প্রতিদিনইতো বিআরটিসির বড় বড় কর্মকর্তাদের সামনে দিয়ে বাসটি চলাচল করেছে।
তিনি বলেন, বাসটি দুর্ঘটনায় পতিত হয়েছে দেখে এখন অব্যবস্থাপনার থলের বিড়াল বেড়িয়ে আসছে। এই অব্যবস্থাপনা রোধে তো কর্মকর্তারা রয়েছেন। তারা কী করেন? শুধু চালক-হেলপার না, যারা দায়িত্ব অবহেলা করেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন বরিশালের সদস্য সচিব এনায়েত হোসেন শিবলু বলেন, বিআরটিসি নাগরিকদের সেবা দেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি নিয়ে এসেছিল সেই মৌলিক চরিত্র তারা হারিয়ে ফেলেছে। জনগণের এই সম্পদ কর্মকর্তারা গনিমতের মাল হিসেবে ব্যবহার করছেন। এই খাতটি এখন সেবার তুলনায় বাণিজ্যিক খাতে পরিণত হয়েছে। আমি মনে করি এই দুর্ঘটনার জন্য শুধু চালক আর হেলপার দায়ী নন, ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বিআরটিসি ও বিআরটিএ বরিশালের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। বছরের পর বছর ধরে একটি ফিটনেসহীন, চালকের পরিচয়হীন, নির্ধারিত রুট ছাড়া কীভাবে গাড়িটি চলছিল? তাদের কি এসব দেখার দায়িত্ব না?
সাংবাদিক ইউনিয়ন বরিশালের সভাপতি সাইফুর রহমান মিরন বলেন, বিআরটিএ ও বিআরটিসি দুটি সরকারি দপ্তর। আমি মনে করি তাদের দায়িত্ব অবহেলার কারণে সড়কে বিশৃঙ্খলা তৈরি হচ্ছে। বিআরটিএর উচিত সড়ক থেকে ফিটনেসবিহীন গাড়িগুলো তুলে ফেলা। কিন্তু তারা সেটা করছে না। আবার বিআরটিসি ফিটনেসবিহীন বাসগুলো এক রুট থেকে তুলে আরেক রুটে চালায়। ফলে কে চালায়, কোথায় চালায় এবং কীভাবে চালায় তার কোনো তথ্য এই দুই দপ্তরের কাছে নেই। যে কারণে মানুষকে প্রাণ হারাতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে দুর্ঘটনা রোধে এই দুই দপ্তরকে আরও পর্যবেক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা উচিত। তাছাড়া বরিশালের সড়কগুলো ওয়ান ওয়ে করার দাবি জানাচ্ছি। সড়ক প্রশস্ত না করে এত সরু সড়কে ডাবল লেনের গাড়ি চলাচল করাটাও দুর্ঘটনার বড় কারণ।
বিআরটিসির নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র বলছে, রুট অনুমোদন ছাড়াই বরিশাল-তালতলী রুটে চলাচলকারী কুমিল্লা-ব-০০৫৫ নম্বরের বাসটির দীর্ঘ মেয়াদি ইজারাদার ছিলেন চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার খুরুমখালী গ্রামের ছলেমান ভূঁইয়ার ছেলে গিয়াস উদ্দিন। তিনি গিয়াস উদ্দিন ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের মালিক। তার নামে আরও একটি বাস (কুমিল্লা-ব-০০৫৭) দীর্ঘ মেয়াদি ইজারা ছিল। বাকেরগঞ্জের ঘটনার পরদিন (২১ জুলাই) বিআরটিসির জেনারেল ম্যানেজার স্বাক্ষরিত এক আদেশে এই দুটি গাড়ির ইজারা বাতিল করা হয়।
ইজারা বাতিলের আদেশে কারণস্বরূপ উল্লেখ করা হয়, কুমিল্লা-ব-০০৫ নম্বরের বাসটি অনুমোদিত রুট ব্যতীত তালতলী থেকে বরিশাল রুটে পরিচালনা করা হয় এবং ২০ জুলাই দুর্ঘটনাকবলিত হয়ে ৬ জন যাত্রীর মৃত্যু হয়েছে। এতে বিআরটিসির ভাবমূর্তি ও সুনাম ক্ষুণ্ন হয়েছে। কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ব্যতীত রুট পরিবর্তন করায় ইজারাদার নীতিমালা-২০০৭ এর ১৮ নং শর্ত ভঙ্গ করেছেন। ইজারা নীতিমালা ৪১ অনুসারে তার দুটি গাড়ির ইজারা বাতিল করা হলো।
এই আদেশে ‘কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ব্যতীত রুট পরিবর্তন’ উল্লেখ করা হলেও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাসটি প্রতিদিন নথুল্লাবাদ বিআরটিসি বাস ডিপো থেকে তালতলী রুটে দুটি করে ট্রিপ চলত।
এছাড়া বিআরটিএ বরিশাল অফিস থেকে জানা গেছে, দুর্ঘটনাকবলিত বাসটি (কুমল্লিা-ব-০০৫৫) ২০১৫ সালের ২৮ মের পর ফিটনেস নবায়ন করা হয়নি। আর ২০১৯ সালের ১৫ ডিসেম্বরের পর বাসটির নিবন্ধনের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। অর্থাৎ সরকারি দুটি গুরুত্বপূর্ণ লাইসেন্স শেষ হয়েছে যথাক্রমে ৭ ও ৩ বছর হলো। এত বছরেও বিষয়টি নিয়ে কার্যকর কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি বিআরটিসি বরিশাল ডিপো এবং বিআরটিএ বরিশাল অফিস।
বিআরটিসি বরিশাল ডিপো থেকে জানা গেছে, প্রয়োজনীয় কাগজের মেয়াদ শেষ হলেও ঠিকাদারের সঙ্গে ইজারা চুক্তি ঠিকই নবায়ন করা ছিল ২০২৩ সাল পর্যন্ত।
এসব বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বিআরটিসি বরিশাল ডিপোর ম্যানেজার জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ইজারা শর্ত ভঙ্গ করায় ওই ইজারাদারের দুটি বাসের ইজারা ইতোমধ্যে সদরদপ্তর থেকে বাতিল করা হয়েছে। এর বাইরে আসলে আমার কাছে আর কোনো তথ্য নেই। তবে আমি চাই এতগুলো মানুষ মৃত্যুর ঘটনায় দায়ীদের বিচার হোক। আমি নিহতদের স্বজনদের আশ্বস্ত করেছি, বিচার পেতে তাদের সব ধরনের সহায়তা করা হবে। বিআরটিসির পক্ষ থেকে নিহতের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে সহায়তা দেওয়া হয়েছে।
তিনি জানান, বাসটির চালক জাহাঙ্গীর হোসেন ইজারাদারের নিয়োগপ্রাপ্ত চালক। ফলে তার কোনো তথ্যই বিআরটিসির কাছে নেই।
তবে বিআরটিএ বরিশালের সহকারী পরিচালক মো. শাহ আলম বলেন, আমার ধারণা ছিল বিআরটিসির গাড়িগুলো নিরাপদ এবং শৃঙ্খলিত। কিন্তু সেই ধারণার এবার ব্যত্যয় হলো বাকেরগঞ্জের ঘটনায়। বাসটি দীর্ঘ মেয়াদি ইজারায় চলছিল। প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজের নামে মালিকানায় এখনো। বিআরটিসির নামে মালিকানা বদলের আগেই তা বিআরটিসির আওতায় দীর্ঘ মেয়াদি ইজারায় দিয়ে দেওয়া হয়। যেহেতু সরকারি প্রতিষ্ঠান বিআরটিসি, এজন্য আমরা (বিআরটিএ) সাধারণত ওখানে দেখভালে যাই না। তবে বরিশাল ডিপো ম্যানেজারের উচিত ছিল এগুলো খেয়াল করা।