ঢাকা, রবিবার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১

ইউক্রেন যুদ্ধ: উন্নয়নশীল বিশ্বে বাড়ছে ঋণ দুর্ভোগ

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | প্রকাশের সময় : সোমবার ১৮ এপ্রিল ২০২২ ০৪:৪২:০০ পূর্বাহ্ন | আন্তর্জাতিক

 

 

উদীয়মান অর্থনীতির কয়েকটি দেশের বিদেশি ঋণ পরিশোধ কঠিন করে তুলছে ইউক্রেন যুদ্ধ। সম্ভাব্য সংকট নিয়ে উদ্বেগ যে গতিতে বাড়ছে, তাতে বিশ্ব অর্থনীতি বড় ধরনের ঝাঁকুনি খেতে পারে।

 

মূল্যস্ফীতি ও সুদের হার কম থাকা অবস্থায় গত এক দশকে অনেকগুলো উন্নয়নশীল দেশে জমেছে ঋণের পাহাড়। এর মধ্যে সিংহভাগ ছিল কোভিড সংশ্লিষ্ট ব্যয়।

 

 

রাশিয়ার আক্রমণ এবং তাদের ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে খাদ্য ও জ্বালানির মূল্য বাড়তে শুরু করলে, বেশিরভাগ কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতি ঠেকাতে সুদের হার বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়।

 

 

ইসলামাবাদ থেকে কায়রো, বুয়েনস এইরেস থেকে তিউনিস; সব দেশের কর্মকর্তারা মহামারির সঙ্গে আমদানির মূল্যবৃদ্ধি ও ঋণ পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছেন।

 

সম্প্রতি শ্রীলঙ্কা ঘোষণা দিয়েছে, তারা বিদেশি ঋণ পরিশোধ করবে না। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর কাছে জরুরি আর্থিক সহযোগিতাও চেয়েছে দেশটি। শ্রীলঙ্কার অর্থ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, মহামারি, ইউক্রেন যুদ্ধ ও পর্যটনের রাজস্ব কমে যাওয়ায় তারা ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না।

 

 

আরেকটি বৈশ্বিক ঋণ সংকট?

 

সম্প্রতি আইএমএফ একটি প্যানেল আলোচনার আয়োজন করে। এতে অংশ নেওয়া হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির অর্থনীতিবিদ কেনেথ রগোফ বলেন, ‘রাষ্ট্র খেলাপি হবে। আরও সংকট দেখা দেবে। যখন আমরা এখনকার পরিস্থিতিতে পড়ি তখন যেকোনও কিছু সম্ভব।’

 

অবশ্য আইএমএফ এই পর্যায়ে বৈশ্বিক ঋণ সংকটের আভাস দিচ্ছে না। সংস্থাটির কৌশল, নীতি ও পর্যালোচনা পরিচালক সেইলা পাজারবাসিওগলু বলেন, ‘এটি একটি বড় ঝুঁকি যা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন’।

 

তিনি জানান, উন্নয়নশীল দেশগুলোর ঋণ সংকট সমাধানের ফ্রেমওয়ার্কের বিস্তৃতি ও ত্বরান্বিত করার বিষয়টি থাকবে আসন্ন জি-২০ সম্মেলনের অগ্রাধিকার তালিকায়। জোটভুক্ত দেশগুলোর অর্থমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা সোমবার ওয়াশিংটনে মিলিত হবেন। উপস্থিত থাকবে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক।

 

পাজারবাসিওগলু আরও জানান, ২০২০ সালে বিশ্বের রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান ও পরিবারের ঋণ ২৮ শতাংশ-পয়েন্ট বেড়েছে। যা এখন বিশ্বের মোট উৎপাদনের ২৫৬ শতাংশ। এই মাত্রায় ঋণ বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে দুটি বিশ্বযুদ্ধের সময়ও দেখা যায়নি।

 

সুদের হার কম ও দৃঢ় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণে ধনী দেশগুলোকে ক্রমবর্ধমান ঋণ নিয়ে খুব বেশি সমস্যায় পড়তে হবে না। তবে অনেক উন্নয়নশীল অর্থনীতি বেশি চাপ অনুভব করছে।

 

নিম্ন আয়ের ৬০ শতাংশ— প্রায় ৭০টি দেশ মহামারিতে বৈশ্বিক ঋণ পরিশোধ স্থগিত কর্মসূচিতে যোগ্য বলে বিবেচিত হয়েছে।

 

আইএমএফ-এর মতে, এই দেশগুলো ২০২০ সালে ঋণ দুর্ভোগে পড়ার উচ্চ ঝুঁকিতে ছিল কিংবা ইতোমধ্যে দুর্ভোগে পড়েছে।

 

২০১৫ সালের তুলনায় এই ঝুঁকি ছিল ৩০ শতাংশ বেশি। যখন কোনও দেশ আর্থিক বাধ্যবাধকতা পূরণে ব্যর্থ হয় এবং ঋণ কাঠামো পুনর্গঠনের প্রয়োজন হয় তখন ঋণকে ‘দুর্ভোগ’ বিবেচনা করা হয়।

 

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নতুন ও অনভিজ্ঞ ঋণদাতাদের আবির্ভাবের কারণে ঋণ জটিলতায় থাকা দেশগুলোকে সহযোগিতা করা কঠিন হয়ে পড়েছে।

 

বিশ্বে ঋণ বৃদ্ধি

বিশ্বে ঋণ বৃদ্ধি

আইএমএফ-এর তথ্য অনুসারে, ৭৩টি উচ্চ ঋণগ্রস্ত দেশে চীনের বিদেশি ঋণের পরিমাণ ২০০৬ সালের ২ শতাংশের তুলনায় ২০২০ সালে বেড়ে হয়েছে ১৮ শতাংশ। বেসরকারি খাতে ঋণের পরিমাণ ৩ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ১১ শতাংশ।

 

একই সময়ে বহুপক্ষীয় প্রতিষ্ঠান আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক এবং পশ্চিমা ধনী দেশগুলোর ঋণদাতা ‘প্যারিস ক্লাব’-এর দেওয়া ঋণের পরিমাণ ৮৩ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ৫৮ শতাংশ।

 

বৈশ্বিক ব্যাংকগুলোর প্রতিনিধিত্ব করা ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স-এর গ্লোবাল পলিসি ইনিশিয়েটিভ-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালনা সঞ্জা গিবস বলেন, ‘কে ঋণ দিয়েছে সেই সম্পর্কে যদি ভালো ধারণা না থাকে তাহলে কার্যকর ঋণ কাঠামো পুনর্গঠন এবং সবাইকে নিয়ে আলোচনায় বসা কঠিন।’

 

শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের সংকট

 

দুর্বল উন্নয়নশীল দেশগুলো যে ঝুঁকির মুখে রয়েছে তার বড় উদাহারণ হলো শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের পরিস্থিতি। ইউক্রেন আক্রান্ত হওয়ার পর উভয় দেশেই বৃহত্তর রাজনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে।

 

কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বিশ্লেষক ও আইএমএফ-এর তথ্য অনুসারে, উভয় দেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ এত কমে এসেছে যে তারা শুধু আগামী এক বা দুই মাসের আমদানি মূল্য পরিশোধ করতে পারবে।

 

বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে পারবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে শ্রীলঙ্কা

বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে পারবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে শ্রীলঙ্কা

শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকটে গণবিক্ষোভ শুরু হয়েছে। টানা লোডশেডিং, ওষুধ ও গ্যাসের মতো গুরুত্বপূর্ণ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ঘাটতির এর এই বিক্ষোভ শুরু করেন দেশটির নাগরিকরা।

 

ডেটা সরবরাহকারী সিইআইসি’র মতে, ফেব্রুয়ারিতে শ্রীলঙ্কার বার্ষিক মূল্যস্ফীতি ছিল ১৭.৫ শতাংশ। গত দশকে অবকাঠামো প্রকল্পে সরকারি ঋণ ব্যাপক হয়েছে। এই বছরেই শোধ করতে হবে ৭ বিলিয়ন ডলার, জুলাইয়ে বন্ড পূর্ণতা পাবে ১ বিলিয়ন ডলারের। অথচ দেশটির বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ আছে মাত্র ২.৩ বিলিয়ন ডলার।

 

পাকিস্তানে আইএমএফ-এর সহযোগিতা কর্মসূচি সহযোগিতা করা হয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ফেব্রুয়ারিতে জ্বালানি ও বিদ্যুৎখাতে ১.৫ বিলিয়ন ডলারের ভর্তুকি ঘোষণার পর কর্মসূচি স্থগিত করে আইএমএফ। সংস্থাটির দাবি, এই বিষয়ে আইএমএফ-এর অনুমোদন নেওয়া হয়নি।

 

নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির মধ্যে ৯ এপ্রিল বিরোধীরা ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করে। সিইআইসি’র মতে, গত বছরের তুলনায় মার্চের এই তুলনায় এই বছর মার্চে পাকিস্তানে ভোক্তামূল্য বেড়েছে ১২.৭ শতাংশ।

 

ধুঁকছে মিসর

 

মহামারিতে পর্যটন খাত সংকটে পড়লে মিসরের অর্থনীতিও ধুঁকছে। আর এখন ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের পর মূল্যস্ফীতি বেড়েছে এবং বিদেশি বিনিয়োগ প্রত্যাহার হচ্ছে। আইএমএফ-এর সম্ভাব্য সহযোগিতার পথ সুগম করতে মার্চে মিসরের কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রার অবমূল্যায়ন করেছে ১৪ শতাংশ। এর আগে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে সরকার মুদ্রায় কঠোর নিয়ন্ত্রণ জারি রেখেছিল।

 

নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে ঋণ-ঝুঁকি

লন্ডনের ক্যাপিটাল ইকনোমিকসের উদীয়মান বাজার বিশেষজ্ঞ জেমস সোয়ন্সটন বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধ ছিল গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট। বাহ্যিক প্রতিযোগিতা এবং রফতানি বৃদ্ধি অর্জনের জন্য তাদের মুদ্রার অবমূল্যায়ন প্রয়োজন ছিল।

 

দীর্ঘদিন ধরে মিসর দারিদ্র বৃদ্ধি ও শ্রমশক্তির অংশগ্রহণসহ অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। ২০১৬ সাল থেকে আইএমএফ-এর কাছে দেশটি প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার ঋণ করেছে। ১৯৮০ দশকের পর সংস্থাটির কাছ থেকে সহযোগিতা নেওয়ার ক্ষেত্রে আর্জেন্টিনার পর দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে দেশটি। ২০২০ ও ২০২১ সালে মিসরের সরকার রাজস্ব সেবার ৪০ শতাংশ ঋণে ব্যয় করেছে এবং ২০২২ সালেও তা করার আভাস দিয়েছে।

 

মুদ্রার অবমূল্যায়নের পর পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলো মিসরে ২২ বিলয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন সহযোগিতা হিসেবে দিয়েছে ১০০ মিলিয়ন ডলার।

 

মিসর বলেছে, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি মোকাবিলা করছে তারা। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আইএমএফ-এর কাছে আরও সহযোগিতা চাইতে পারে মিসর।

 

জরুরি পণ্য সংকটে তিউনিসিয়া

 

সহযোগিতা চাওয়া আরেকটি দেশ হলো তিউনিসিয়া। দেশটির দোকানগুলোতে চিনি, ময়দা ও জরুরি খাদ্য সবরাহের ঘাটতি রয়েছে এবং সরকারি কর্মীদের বেতনও বিলম্বিত হয়েছে।

 

গত মাসে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ৪০০ মিলিয়ন ডলার সহযোগিতা পেয়েছে দেশটি এবং আইএমএফ-এর কাছ থেকেও সহযোগিতার আশা করছে।

 

এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল রেটিংস-এর সার্বভৌম রেটিংস বিষয়ক চিফ অ্যানালিটিক্যাল অফিসার রবার্তো সিফন-আরেভালো বলেন, ‘২০০৮ সালের মতো প্রতিটি সার্বভৌম রাষ্ট্রেরই এখন ঋণ বেশি। বিশ্বে কি আমরা আরেকটি ঋণ সংকট দেখছি? আমি তা বলবো না। কিন্তু কয়েকটি সার্বভৌম দেশ প্রকৃত অর্থে খুব কঠিন অবস্থায় রয়েছে।’