ঢাকা, মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১২ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১
যানজটের পেছনের গল্পে নজর নেই কারও

গাড়ি বেড়েছে, সড়ক কমেছে, জনবল বাড়েনি ট্রাফিক পুলিশের

নিজস্ব প্রতিবেদক : | প্রকাশের সময় : শুক্রবার ১২ অগাস্ট ২০২২ ১২:২৯:০০ অপরাহ্ন | জাতীয়

 

চৈত্রের তপ্ত রোদ হোক বা শ্রাবণের বৃষ্টি, ট্রাফিক পুলিশের কাজে কোনো ব্যত্যয় নেই। হাতে ছাতা, মুখে বাঁশি নিয়ে কাজ চালিয়ে যেতে হয় তাদের। নগরীতে সড়কের প্রস্থ কমতে থাকা এবং যানবাহনের সংখ্যা বাড়তে থাকার বিষয়টি বাড়তি চ্যালেঞ্জ যোগ করেছে ট্রাফিক পুলিশের কাজে। এদিকে ট্রাফিক বিভাগের জনবল তো বাড়েইনি উল্টো চাহিদার তুলনায় কমেছে। বাড়তি চাপে সড়কে শৃঙ্খলা আনতে হিমশিম খাচ্ছেন মাঠ পর্যায়ের ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে রাজধানীতে ট্রাফিক বিভাগের জনবল ৩ হাজার ৮শ ৯৩ জন। সার্জেন্টদের অনেকে টিআই পদে পদোন্নতি পেলেও নতুন করে সার্জেন্ট আর নিয়োগ হয়নি।

সর্বশেষ ২০১৭ সালে পুলিশে সার্জেন্ট পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর আর কোনো নিয়োগ হয়নি। বর্তমানে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে সার্জেন্ট রয়েছেন ৭১১ জন। চাহিদার তুলনায় এখনো ২০০ সার্জেন্ট কম নিয়েই কাজ করছেন ট্রাফিক সদস্যরা। সংখ্যায় কম রয়েছে টিএসআই ও কনস্টেবলও। সব মিলিয়ে আরও ১২০০ জনবল দরকার ডিএমপিতে। জনবল সংকটের বিষয়টি পুলিশ সদর দপ্তরে জানানো হলেও নতুন নিয়োগের সুরাহা এখনও হয়নি।

ডিএমপির ট্রাফিক সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চারটি ট্রাফিক বিভাগ ভেঙে করা হয়েছে আটটি। বিভাগগুলো হলো- ট্রাফিক রমনা বিভাগ, মতিঝিল, রমনা, তেজগাঁও, গুলশান বিভাগ, উত্তরা, মিরপুর, ওয়ারী এবং ট্রাফিক লালবাগ বিভাগ।

পুরো ডিএমপিতে ট্রাফিক বিভাগ সামলানোর জন্য একজন অতিরিক্ত কমিশনার, উত্তর ও দক্ষিণ মিলে দুজন জয়েন্ট কমিশনার, ট্রাফিক-অ্যাডমিন অ্যান্ড রিসার্চ ও ট্রাফিক কমান্ড কন্ট্রোল সেন্টারের জন্য রয়েছেন মাত্র একজন করে অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) ও সহকারী কমিশনার (এসি)। 

নিয়োজিত ৪৪ জন কনস্টেবলই যেন এই বিভাগের ভরসা।

ডিএমপির আট ট্রাফিক বিভাগে ডিসি পদমর্যাদার কর্মকর্তা রয়েছেন ৮ জন, এডিসি ৯ জন, এসি ২৬ জন, টিআই ১২৬ জন, এসআই (সশস্ত্র) ৮ জন, এসআই (নিরস্ত্র) ৮ জন, সার্জেন্ট ৭১১ জন, ৬১ জন টিএসআই, এএসআই ১৮৫ জন, এটিএসআই ২১৯ জন আর কনস্টেবল ২ হাজার ৫২৯ জন। সব মিলিয়ে ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ সামলাতে নিয়োজিত রয়েছেন মোট ৩ হাজার ৮৯৩ জন।

সবচেয়ে বেশি জনবল নিয়োজিত রয়েছে ট্রাফিক রমনা বিভাগে ৬২০ জন। এরমধ্যে উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) একজন, এডিসি একজন, চারজন এসি, ১৭ জন ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (টিআই), সশস্ত্র ও নিরস্ত্র একজন করে দু’জন এসআই, ১১০ জন সার্জেন্ট, ১১ জন টিএসআই, ২৯ জন এএসআই, এটিএসআই ৩৪ জন, আর কনস্টেবল ৪০১ জন।

ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তাদের জন্য যানবাহন রয়েছে ৫০টি। সবগুলো বিভাগ মিলে সরকারি অনুদানে রেকার রয়েছে মাত্র সাতটি। তবে বেসরকারি অনুদান থেকে মিলেছে দু’টি। আর ডিএমপির ক্রয়সূত্রে রয়েছে ৪৮টি রেকার।

ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিদিনই জনবল কমছে ডিএমপিতে। এর চাপ পড়ছে সড়কে। সড়কে নিয়মিত ডিউটি করা কোনো ট্রাফিক সদস্য অসুস্থ হলে, ছুটি নিলে রিপ্লেস করার মতো জনবল থাকছে না। গত পাঁচ বছরে ট্রাফিকে জনবল বাড়েনি, উল্টো কমেছে।

ডিএমপির মাঠ পর্যায়ে কর্তব্যরত ট্রাফিক সদস্যরা বলছেন, রোদ-ঝড়-বৃষ্টিতে এত শ্রম দেওয়ার পরও একটু উনিশ-বিশ হলে অপবাদ শুনতে হয় ট্রাফিক সদস্যদের। দিন-রাত রাস্তায় থাকায় নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন তারা। সাইনোসাইটিস, শ্বাসকষ্ট, মাথাব্যথা সারা বছর লেগে থাকে।

মাঠ পর্যায়ে নিয়োজিত ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনার বিধি-নিষেধ তুলে নেওয়ার পর থেকে ঢাকায় যানজট করোনার আগের রূপে ফিরেছে। কখনো কখনো আগের চেয়ে বেশি যানজট হচ্ছে। এমন কোনো দিন নেই রাজধানীতে যানজট হচ্ছে না।

তাদের মতে, তিন কারণে বেড়েছে রাজধানীর যানজট- নগর জুড়ে উন্নয়ন কাজের খোঁড়া-খুঁড়ি, স্কুল-কলেজসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে বেশি বেশি যানবাহন আর আগের ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি। এর মধ্যে জনবল সংকটে থাকা ট্রাফিক বিভাগ খাবি খাচ্ছে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায়।

বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সাল থেকে প্রতি ২ বছর অন্তর গাড়ির ফিটনেস নবায়নের নিয়ম করা হয়। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে ৭ লাখ ৬ হাজার ৪১৩টি এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৭ লাখ ৫০ হাজার ৭২২টি যানবাহনকে ফিটনেস সার্টিফিকেট ইস্যু ও নবায়ন করেছে বিআরটিএ। বাকি যানবাহন ফিটনেস নবায়ন করেনি। যেগুলো রাজধানীতে চলছে অবৈধভাবে।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিআরটিএ-এর হিসেব অনুযায়ী, ঢাকায় রেজিস্ট্রেশনকৃত মোটরযানের সংখ্যা ১৮ লাখ ১০ হাজার ২৭৫টি। এর মধ্যে বাসের সংখ্যা মাত্র ৩৭ হাজার ৫৯৩। ২০২০ সালে ১ হাজার ৭৯২টি বাস রেজিস্ট্রেশন পায় আর ২০২১ সালে পায় ১২১৩টি। চলতি বছরের দুই মাসে বাসের রেজিস্ট্রেশন মেলে মাত্র ২৫১টির।

তবে বিপুল পরিমাণ ব্যক্তিগত পরিবহনকে রেজিস্ট্রেশন দিয়েছে বিআরটিএ। বর্তমানে ঢাকায় রেজিস্ট্রিকৃত প্রাইভেটকারের সংখ্যা ৩ লাখ ১৭ হাজার ৫০৯টি। এর মধ্যে ২০২০ সালে অনুমোদন পায় ১১ হাজার ১৫০টি, ২০২১ সালে ১৪ হাজার ৩২১টি। আর চলতি বছরের প্রথম দুই মাস অর্থাৎ জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতেই বিআরটিএ রেজিস্ট্রেশন দিয়েছে ২ হাজার ৭২৪টি প্রাইভেটকারকে।

বছরের পর বছর রেজিস্ট্রেশন পাওয়া গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও রাজধানীতে বাড়েনি সড়ক, উল্টো উন্নয়ন ও সেবার নামে বছর জুড়েই চলে খোঁড়াখুঁড়ি। এতে মূল সড়কও সংকুচিত হয়ে পড়েছে। সড়কে অবৈধ পার্কিংয়ের কারণে ব্যাহত হচ্ছে যান চলাচল, বাড়ছে যানজট।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর বিমানবন্দর এলাকা, উত্তরা, তেজগাঁও, গুলশান লিঙ্ক রোড, আগারগাঁও, ধানমন্ডি, মিরপুর, কালশীসহ রাজধানীর অসংখ্য স্থানে ছোট বড় খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। এজন্য চাইলেও সড়কে যান চলাচলে গতি বাড়ানো যাচ্ছে না।

গুলশান ট্রাফিক বিভাগের সহকারী কমিশনার (এসি) মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর চাপ বেড়েছে সড়কে। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের সামনে একেক ছাত্রের জন্য একেকটি প্রাইভেট গাড়ির চাপ সামলাতে হয় আমাদের। গুলশানের ভেতরে ব্যক্তিগত গাড়ির চাপ বেশি। মূল সড়কে ব্যক্তিগত গাড়ির সঙ্গে গণপরিবহন তো আছেই। অফিসগামী ও অফিসফেরত সময়ে চাপ আরও বেড়ে যায়।

অনেকটা অসহায় কন্ঠে তেজগাঁও ট্রাফিক বিভাগের উপ-কমিশনার সাহেদ আল মাসুদ বলেন, গত কয়েক বছরে তেজগাঁও এলাকায় কমেছে সড়কের প্রস্থ। ঢাকায় যদি যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি ঠেকানো না যায় তাহলে পরিস্থিতি আরও নাজুকের দিকে যাবে।

তিনি বলেন, ট্রাফিকে যেভাবে চাপ বাড়ছে সে হারে জনবল বাড়েনি, উল্টো নানা কারণে কমেছে। দিন শেষে দায় ও দোষ যায় ট্রাফিক পুলিশের ওপর। জনবল নিয়োগের ব্যাপারে ঊর্ধ্বতনরা ভালো বলতে পারবেন।

রাজধানীর শেরে বাংলা নগর, বিজয় সরণি, তেজগাঁও ও কাকরাইল এলাকায় সরেজমিনে দেখা যায়, সড়কে দাঁড়িয়ে এক হাতে ছাতা ধরে আরেক হাতের ইশারায় গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করছেন ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা। যানবাহনের শব্দ, প্রচণ্ড গরমে কাহিল দশা হলেও ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে সড়কেই থাকতে হচ্ছে পুলিশ সদস্যদের।