মেয়েরা পর্দা করবে! সংসার করবে, ঘর সামলাবে, মেয়েরা কেন ঘরের বাহিরে থাকবে? আমাদের সমাজে মেয়েদের এমনভাবেই দেখে মানুষ। কিন্তু সবকিছুকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে নারীরা। নারী ফুটবলাররা আজ দেশ ছাড়াও বিদেশে জায়গা করে নিয়েছে। যতই দিন যাচ্ছে টাঙ্গাইল তথা সারা দেশসহ বিশ্বে নারী ফুটবল এগিয়ে যাচ্ছে। যতই দিন যাচ্ছে টাঙ্গাইলে নারী ফুটবল এগিয়ে যাচ্ছে।
সমাজের সর্বক্ষেত্রের ন্যায় খেলাধুলায়ও নারীরা নিজেদের ধাপে ধাপে তুলছেন নতুন উচ্চতায়। দেশে-বিদেশে, ঘরোয়া এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এখন বিভিন্ন সাফল্যের স্বাক্ষর রাখছেন নারীরা। অদম্য এই নারীরা ফুটবল খেলে নিজেদের পরিবারকে বদলে দিচ্ছেন। গোপালপুর সূতী ভিএম পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের ক্রীড়া শিক্ষক গোলাম রায়হান বাপনের বড় ভাই জাতীয় নারী ফুটবল দলের কোচ ছোটনের পরামর্শে ফুটবল কোচ হিসেবে যাত্রা শুরু করেন। তিনি ফুটবলে ছেলে ও নারী উভয়েই প্রশিক্ষণ দেন। দীর্ঘ ২১ বছর যাবত তিনি ওই স্কুলের ক্রীড়া শিক্ষক। কোচ হিসেবে তার বড় সাফল্য ২০২০ সালে টাঙ্গাইল বালিকা (অনুর্ধ্ব-১৪) ফুটবল দল নিয়ে। বিগত ২০০৬ সালে মাত্র ১৮ জন নারী নিয়ে টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলায় ফরহাদ হোসেন স্মৃতি ফুটবল একাডেমির পথ চলা শুরু হয়। বর্তমানে এই একাডেমিতে ২৫ জন নারী ফুটবলার প্রতিদিন উপজেলার সূতী ভিএম পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে সকাল-বিকাল প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। বর্তমানে এই একাডেমির কৃষ্ণা রানী সরকার, ইতি, নিতি, মাহফুজাসহ ৭ জন নারী ফুটবলার জাতীয় দলে খেলছেন।
এখানে যে ক’জন নারী ফুটবলার আছেন তাদের বেশিরভাগই নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা। খেলার ছলে ফুটবল খেলেছেন তারা। প্রথমে প্রাথমিক স্কুল ভিত্তিক ফুটবল থেকে আসা এই মেয়েরা এখন স্কুলে সারাবছরই প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। খেলছেন বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় অনুষ্ঠিত হওয়া টুর্নামেন্টগুলোতে। প্রধানমন্ত্রী যদি তার মায়ের নামে প্রাইমারি স্কুল পর্যায়ে ফুটবল শুরু না করতেন তাহলে তারা এ পর্যন্ত আসতে পারতেন না। তখন জানতেন না ফুটবল খেললে টাকা পাওয়া যায়, বিদেশে যাওয়া যায়। এখন তারা বুঝেন ফুটবলের মূল্য। পরিবারের নানা প্রতিকুলতাকে দূরে ঠেলে তারা ফুটবল খেলছেন।
প্রত্যন্ত উপজেলা পর্যায়ে নারীদের এমন ফুটবল প্রশিক্ষণ চালিয়ে যাওয়া অনেক কষ্টকর। নানা কষ্টের মধ্যেই এই ক্যাম্পের নারী ফুটবলাররা অনেক সফলতা বয়ে আনছে। একসময় তাদের পরিবার অনেক কষ্ট করে চলতো। প্রায় প্রতিটি পরিবারেই রয়েছে আর্থিক অনটন।
সম্ভাবনায় তরুণ ফুটবল খেলোয়াড়দের জেগে তোলার পিছনে কিংবা সম্ভাবনায় তরুণ ফুটবলার নিয়ে একটা দলকে চ্যাম্পিয়ন করাতে একজন ভালো মানের ফুটবল কোচ। একজন দক্ষ কোচ তার নিবিড় প্রশিক্ষণ ও কৌশলের মাধ্যমেই তরুণ ফুটবলারদের উৎসাহ দিয়ে শতভাগ খেলা আদায় করে দলকে চ্যাম্পিয়ন করানো যায়। সেটা এক সময়ের টাঙ্গাইল জেলার গোপালপুর উপজেলার তারকা ফুটবলার স্টাইকার বাপনের দ্বারাই সম্ভব। ছোট বেলা থেকেই ফুটবলকে ভালোবেসে ফুটবলের সাথে জড়িয়ে গেছেন গোলাম রহমান বাপন। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা ফুটবল দলের কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন যার বড়ভাই। দুই ভাই ছোটন ও বাপন একসময় নিজ জেলার পাশাপাশি সারাদেশে দাপিয়ে ফুটবল খেলেছেন। ১৯৮৯ সালে পাইওনিয়ার কদমতলা সংসদের হয়ে বাপনের ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু। সেবার তারা চ্যাম্পিয়ন হয়। এরপর দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবলে বাসাবো তরুণ সংঘ ও মানবান অভিবারিক ক্লাবের হয়ে খেলেছেন। বিগত ১৯৯৫ সালের ফেডারেশন কাপে বাসাবো তরুণ সংঘের হয়ে খেলেছেন। আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ ও ইয়ংমেন্স ফকিরের পুলের জুনিয়র দলেও খেলেছেন। ছিলেন স্টাইকার, কিন্তু কোচের কারণে হয়ে অতন্দ্র প্রহরীর মতো রাইটব্যাক। তিনি বলেন, ঢাকায় খেলতে এসে কোচের চাহিদার কারনে রাইটব্যাকের ফুটবলার হয়ে যাই। ঢাকায় খেলার পূর্বে টাঙ্গাইল প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে তার বড় অর্জন উদয়ন ক্লাব ও থানাপাড়া ক্লাবের হয়ে শিরোপা জয়। এছাড়া খেলেছেন জেলা দল এবং রাজশাহী মোহামেডানের হয়ে।
গোপালপুর সূতী ভিএম পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের ক্রীড়া শিক্ষক বাপন বড় ভাই ছোটনের পরামর্শে ফুটবল কোচ হিসেবে যাত্রা শুরু করেন। তিনি কোচিং ছেলে ও মেয়ে উভয়েই প্রশিক্ষণ দেন। ২১ বছর যাবত তিনি ওই স্কুলের ক্রীড়া শিক্ষক। কোচ হিসেবে তার বড় সাফল্য ২০২০ সালে টাঙ্গাইল বালিকা (অনুর্ধ্ব-১৪) ফুটবল দল নিয়ে। জেএফএ কাপ অনুর্ধ্ব-১৪ বালিকা জাতীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়নশীপের ফাইনালে ৩-০ গোলে হারায় প্রতিপক্ষ ঠাকুরগাঁও জেলাকে। ২০১৭ সালে একই আসরের চূড়ান্ত পর্বে সেমিফাইনালে টাইব্রেকারে ৩-৪ গোলে একই দল ঠাকুরগাঁও জেলা দলের কাছে হেরে গিয়েও প্রশংসা অর্জন করেন। ফুটবলে সাফল্য মানেই কোচের অবদান। কোচই পারে তার মেধা খাটিয়ে দলের ফুটবলারদের সুন্দর কৌশলে দক্ষতার সাথে ফুটবল খেলা শিখানো।
নারীদের ফুটবলকে এগিয়ে নেওয়ার পিছনে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন গোলাম রহমান বাপন। তিনি সারাক্ষণ ফুটবলকে আষ্টেপিষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছেন। তিনি বঙ্গমাতা ফুটবলের সাত আসরেও টাঙ্গাইল বাগুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কোচ ছিলেন। বিগত ২০১৬ আসরে স্কুলটি তৃতীয় স্থান অর্জন করে। এছাড়া তারই কোচিংয়ে জাতীয় নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের গত দুই আসরেই টাঙ্গাইল জেলা দল সেমিফাইনালে খেলেছে। তার প্রশিক্ষণে গোপালুপর সূতী ভিএম পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয়কে পাঁচবার চ্যাম্পিয়ন এবং একবার রানার্সআপ হয়। মেয়েদের বিভাগে ২০১১, ১২ ও ১৩ সালে হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়ন হয়। তিনি তারই অধীনে প্রশিক্ষণে থাকা শাহেদা, রেহারান, উন্নতি, প্রান্তিকে জাতীয় বয়স ভিত্তিক দলে ডাক পাওয়ার যোগ্য মনে করেন।
ফরহাদ হোসেন স্মৃতি ফুটবল একাডেমির ছাত্রী ইতি আক্তার বলেন, আমি এই একাডেমির একজন নিয়মিত খেলোয়াড়। আমি এখানে দুই বেলা সকাল ও বিকালে প্রশিক্ষণ নিচ্ছি। আমি যখন ছোটাবেলা থেকে খেলাধুলা করি। তখন এলাকার লোকজন অনেকেই অনেক মন্তব্য করতো। আমি কোনো মন্তব্য না শুনেই নিয়মিত ফুটবল খেলা চালিয়ে যাচ্ছি।
জ্যোসনা আক্তার বলেন, আমাদের এই একাডেমিতে অনেক সমস্যা। আমরা এখানে নিয়মিত প্রশিক্ষণ নিচ্ছি। আমাদের সব সমস্যা সমাধান করেন বাপন ও ছোটন স্যার। তারা আর কত সাহায্য করবে। যদি সরকার আমাদের এই ফরহাদ হোসেন স্মৃতি ফুটবল একাডেমির দিকে একটু সুনজর দেয়। তাহলে এই একাডেমি এগিয়ে যাবে অনেক দূর।
গোপালপুর ফরহাদ হোসেন স্মৃতি ফুটবল একাডেমি প্রতিষ্ঠাতা ও কোচ গোলাম রায়হান বাপন বলেন, আমরা পাঁচ ভাই। দুই ভাই ফুটবলে জড়িয়ে আছেন। বাকী তিনজনের একজন সাবেক জেলা ক্রীড়া কর্মকর্তা, একজন কাষ্টমসে চাকরি করেন এবং অন্যজন ব্যবসায়ী। আমি সবার ছোট। ‘সি’ লাইসেন্সধারী কোচ হওয়া লক্ষ্য, কোচ হিসেবে আরও শানিত হওয়া। তবে ‘এ’ লাইসেন্স পেতেই হবে- এমন উচ্চাকাঙ্খা পোষণ করি না। তিনি বলেন, আমি তৃণমূল নিয়েই কাজ করতে বেশি আগ্রহী। আমার বাচ্চারা ফুটবল শিখে জাতীয় দলে খেলবে-এটাই আমার স্বপ্ন ফুটবল ভালোবাসি। সারাজীবন ফুটবলকে ভালে বেসে যাব। সারাজীবন ফুটবল নিয়েই কাজ করে যেতে চাই। এসব নারীদের আশা ফুটবল খেলে আরও এগিয়ে যাওয়া। নিজের ও পরিবারকে সহায়তার মধ্য দিয়ে অভাব দূর করাই তাদের লক্ষ্য। সরকারের কাছে একটাই অনুরোধ আমাদের একাডেমিকে যেনো আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করে।