ঢাকা, শুক্রবার ৩১ জানুয়ারী ২০২৫, ১৭ই মাঘ ১৪৩১

গ্রেনেড হামলা মামলায় তারেক রহমানকে বেআইনিভাবে সাজা দেওয়া হয়েছিলো

সালেহ্ বিপ্লব, ঢাকা | প্রকাশের সময় : সোমবার ২ ডিসেম্বর ২০২৪ ১০:১৫:০০ পূর্বাহ্ন | আইন-আদালত
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান

একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলার সম্পূরক চার্জশিট এবং বিচারের প্রক্রিয়াটাই ছিল বেআইনি। যে কারণে আপিল না করেই খালাস পেয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ বিচারিক আদালতে দণ্ডপ্রাপ্ত কয়েক জন। পুরো মামলায় তারেক রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগের কোনো উপাদানই ছিল না। ‘আপনি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করবেন’, মুফতি হান্নানকে ১৬৭ দিন রিমান্ডে নিয়ে তারেক রহমান তাকে এ কথাটি বলেছিলেন বলে স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছিল। শুধু এই একটি কথার ভিত্তিতেই তারেক রহমানকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। অথচ জেলখানায় গিয়ে মুফতি হান্নান এই স্বীকারোক্তি প্রত্যাহারেরও আবেদন করেছিলেন। তাকে নির্যাতন করে এই একটি কথা বলাতে বাধ্য করা হয়েছিল বলেও হান্নান দাবি করেছিলেন। যদিও একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলার বিচার শেষ হওয়ার আগেই অন্য মামলায় তাকে ফাঁসি দেওয়া হয়। যে কারণে আসামি পক্ষ তাকে এই জবানবন্দির বিষয়ে জেরা করার সুযোগ পায়নি। সূত্র: ইত্তেফাক

বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ১ ডিসেম্বর একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায় দেন। এর আগে বিচারিক আদালতের রায়ে ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ১৯ জনকে যাবজ্জীবন এবং বাকিদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। হাইকোর্টের রায়ে সবাইকে খালাস দেওয়া হয়েছে। আপিল না করেও খালাস পেয়েছেন তারেক রহমানসহ কয়েক জন।

এ ধরনের ঘটনাকে আইনের ভাষায় ‘নথি খালাস’ বলে অভিহিত করা হয়। উচ্চ আদালত যদি দেখেন নিম্ন আদালতের বিচারিক প্রক্রিয়াটাই অবৈধ এবং অভিযোগ ছিল সাজানো, তাহলে আদালত সবাইকেই খালাস দিতে পারেন। উচ্চ আদালত তার  রায়ে বিচারিক আদালতের বিচারটা অবৈধ বলে ঘোষণা করেছেন। এ ধরনের ঘটনা বিরল হলেও নজিরবিহীন নয়। উপমহাদেশের বিভিন্ন ফৌজদারি মামলার রায়ে এ ধরনের নজির রয়েছে। ‘রাষ্ট্র বনাম মাসুদ চৌধুরী মামলা’য় বিচারপতি হামিদুল হকের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বিভাগে আপিল না করেও একাধিক আসামি খালাস পেয়েছিলেন।

একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলার মামলায় বিচারিক আদালতের বিচার কার্যক্রম আইনের ভিত্তিতে হয়নি। এক সাক্ষীর সঙ্গে অন্য সাক্ষীর বক্তব্যের মিল নেই। শোনা সাক্ষীর ওপর ভিত্তি করে বিচারিক আদালত রায় দিয়েছিল। কেউ স্বচক্ষে দেখেছেন মর্মে কোনো অ্যাভিডেন্স (প্রমাণ) ছিল না। যাদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে, তা নির্যাতনের মাধ্যমে নেওয়া হয়েছে। মুফতি হান্নান দুটি জবানবন্দি দিয়েছেন। প্রথম জবানবন্দিতে তারেক রহমানের নাম ছিল না। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দ্বিতীয় দফায় মুফতি হান্নানের স্বীকারোক্তি নেওয়া হয়। দ্বিতীয় দফার জবানবন্দির ভিত্তিতে কাউকে সাজা দেওয়ার নজির বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় নেই।

২০০৪ সালে যখন এই মামলা করা হয় তখন তারেক রহমানের নাম এফআইআরেও ছিল না। কয়েক দফা তদন্তের পর বিভিন্ন সময়ে আদালতে তিনটি চার্জশিট দেওয়া হয়েছিল। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আদালতে যে চার্জশিট জমা দিয়েছিল তাতেও তারেক রহমানের নাম ছিল না। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে ঘোষণা দেন যে, একুশে আগস্টের ঘটনায় তারেক রহমান জড়িত; তাকে বিচারের মুখোমুখি করা হবে।

এরপর চতুর্থ দফায় এ ঘটনায় তদন্ত শুরু হয়। ইতিমধ্যে জেলা ও দায়রা জজ আদালতে এই মামলার বিচার কার্যক্রম চলছিল। তখন রাষ্ট্রপক্ষ থেকে সম্পূরক তদন্তের আবেদন করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে জজ আদালত পুনঃতদন্তের আদেশ দেন। ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় মামলা তদন্তসহ বিচারের জন্য প্রস্তুত করার যাবতীয় কার্য সম্পাদনের দায়িত্ব ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের। বিচারিক আদালতের দায়িত্ব হলো সাক্ষ্য গ্রহণ, জেরা, যুক্তিতর্ক এবং আসামিদের পরীক্ষা করা সংক্রান্ত কার্যসম্পাদন করে মামলার রায় দেওয়া। কিন্তু তা না করে বিচারিক আদালত মামলার পুনঃতদন্তের আদেশ দেন। যা ঐ আদালতের এক্তিয়ারেই ছিল না। পুনঃতদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় একজন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা আব্দুল কাহহার আকন্দকে, যিনি ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছিলেন।

কাহহার আখন্দের চার্জশিটে বলা হয়, হারিস চৌধুরী, লুৎফুজ্জামান বাবর, আব্দুস সালাম পিন্টুসহ মুফতি আব্দুল হান্নান হাওয়া ভবনে গেলেন। সেখানে তারেক রহমানের সঙ্গে দেখা করলেন। তারেক রহমান তাকে দেখার পরিপ্রেক্ষিতে বললেন, ‘আপনি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করবেন।’

এই একটি কথার ভিত্তিতে তারেক রহমানকে আসামি করা হয়। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ার আগে ১৬৭ দিন রিমান্ডে ছিলেন মুফতি হান্নান। আমাদের আইন এবং সংবিধান অনুযায়ী কোনো একটি মামলায় কোনো আসামিকে ১৫ দিনের বেশি রিমান্ডে নেওয়া যায় না। সে কারণে বিভিন্ন মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে এত দীর্ঘ সময় মুফতি হান্নানকে রিমান্ডে রাখা হয়। এসব বেআইনি কার্যক্রমের কারণে গতকাল আদালত পুরো বিচার প্রক্রিয়াকেই অবৈধ বলেছেন।

এখন প্রশ্ন উঠেছে, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট যেসব মানুষ নিহত এবং আহত হয়েছেন তাদের স্বজনরা কি ন্যায়বিচার পাবেন না? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফৌজদারি মামলা কখনো তামাদি হয় না। আদালত চাইলে নতুন করে এই মামলার তদন্ত ও বিচার শুরু করতে পারবেন।

বায়ান্ন/এসবি