সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী দায়িত্ব গ্রহণের ৬ মাসের মাথায় একাধিক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখিন হয়েছেন। আওয়ামী লীগের এই নেতা প্রথমেই বিএনপির এক নেতার টার্গেট ফাঁদে পা দিয়েছিলেন। রাজনীতিতে চৌকস মেয়র আনোয়ারুজ্জামান স্বমহিমায় নিজকে ওই ফাঁদ থেকে নিজকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছেন কয়েক ঘন্টার মধ্যে। এই অবস্থার রেস কাটতে না কাটতে নিজ দলের নেতাদের রোষাণলে পড়েন তিনি। এখানেও ইট খেয়ে পাটকেল মারতে সময় ক্ষেপন করেননি মেয়র আনোয়ারুজ্জামান। একদিনের মাথায় কঠোর ভাষায় প্রতিবাদ জানিয়েছেন তিনি। প্রতিপক্ষরা এখন অনেকটাই নিরব। তবে সিলেটের রাজনৈতিক মহলের অনেকেই বলছেন, গ্রিন, ক্লিন ও স্মার্ট নগরীর স্বপ্নদৃষ্টা আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী ঘরে বাইরে প্রতিহিংসার রাজনীতির শিকার হতে পারেন তা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। আনোয়ারুজ্জামানও পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্যে প্রস্তুত বলে অনেকে ধারণা করছেন।
নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচিত আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী ২০২৩ সালের ৭ নভেম্বর মেয়র পদে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দায়িত্ব গ্রহণ করেই নগরবাসীকে দেয়া ওয়াদা বাস্তবায়নে পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। নগরবাসীর কাছ থেকেও দাবি উঠে, নগরকে হকারমুক্ত করার। মেয়র আনোয়ারুজ্জামানের ভাষায় হকারদেরকে বলেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। হকারদের জীবন জীবিকার কথা চিন্তা করেন। তাদেরকে উচ্ছেদ না করে পুনর্বাসনের পরিকল্পনা নেন। নগর ভবনের পেছনে বিশাল এক জায়গায় হকারদের পুনর্বাসন করা হয়। এজন্য ব্যয় করা হয় মোটা অংকের অর্থ। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে নগরজুড়ে মেয়র আনোয়ারুজ্জামান ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হন। ইতিবাচক মনোভাবের মেয়র আনোয়ারুজ্জামান এর পরপরই সিলেট নগরীকে পরিচ্ছন্ন করার পদক্ষেপ নেন। নগরীর প্রতিটি রাস্তা পরিচ্ছন্ন করতে সক্রিয় করে তুলেন পরিচ্ছন্ন কর্মীদের। মাঝে মাঝে মাঠে নামেন তদারকি কদরতে। সফলতা দেখছেন নগরবাসী। ব্যক্তি মালিকানাধীন অপরিচ্ছন বাসা বাড়িতে মাঝে মধ্যে হানা দেন। ভবন মালিকদের সাথে সৌজন্য সাক্ষাত করে নিজের ভবনকে পরিচ্ছন্ন করতে পরামর্শ দেন মেয়র। ভবন মালিকরাও খুশি হয়ে মেয়রের পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করেন। ফলে নগরীর অনেক এলাকার ভবন সৌন্দর্যমন্ডতী হয়ে উঠেছে। এছাড়াও নগরবাসীর উন্নয়নে একাধি প্রকল্পের পরিকল্পনা নিয়ে হাঁটছেন মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী।
নগর ভবন সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, নগরীর হোল্ডিং ট্যক্স নিয়ে যুগযুগ ধরে নানান ধরণের অনিয়ম চলে আসছে। হোল্ডিং ট্যাক্সের উপর নজরদারী করেন মেয়র। হোল্ডিং ট্যাক্সে শৃঙ্খলা আনতে কাজ শুরু করেন। এক সময় মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী জানতে পারেন, আগে আবাসিক ভবনের প্রতি বর্গফুট তিন টাকা ও বাণিজ্যিক ভবনের প্রতি বর্গফুটের জন্য পাঁচ টাকা নির্ধারিত ছিল; যদিও মেয়রের কাছে আবেদন করে অনেকে এর চেয়ে কম ট্যাক্স দিতেন।
সিটি করপোরেশনের রাজস্ব শাখা সূত্রে জানা যায়, ২০১৯-২০ সালে মাঠপর্যায়ে অনুসন্ধান শেষে হোল্ডিং সংখ্যা পুননির্ধারিত হয়। এতে নগরের পুরোনো ২৭টি ওয়ার্ডে হোল্ডিং নির্ধারিত হয় ৭৫ হাজার ৪৩০টি। এসবের ট্যাক্স আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ১১৩ কোটি ২৭ লাখ ৭ হাজার ৪০০ টাকা। নতুন হোল্ডিং ট্যাক্স ধার্যের সময় ধরা হয় ২০২১-২২ সাল। ওই সময়টি ছিল মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর সময়কাল। সেই করারোপের তালিকাই গত ৩০ এপ্রিল প্রকাশ করা হয়। এরপর থেকেই এনিয়ে নগরজুড়ে ক্ষোভ দেখা দেয়। নতুন নির্ধারিত হোল্ডিং ট্যাক্সকে অয্যেক্তিক ও অনায্য দাবি করে তা বাতিলের দাবি জানিয়েছেন নগরের বাসিন্দারা।
অভিযোগ উঠেছে নিজের সৃষ্টি করে ওই সমস্যার সমাধানে যখন নগরবাসী আন্দোলন শুরু করে তাতে ইন্ধন দিতে শুরু করেন সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী ও আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতা। আওয়ামী লীগ সরকারের এসএম কিবরিয়া হত্যা মামলার আসামি আরিফুল হক হোল্ডিং ট্যাক্সকে কেন্দ্র করে টার্গেট ফাঁদে পেলার চেষ্টা করেন আনোয়ারুজ্জামানকে। কিন্তু আরিফুল হকের সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয় গত ১০ মে। ১১ মে আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী সংবাদ সম্মেলন ডাকেন। তিনি সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে নগরবাসীকে আশ^াস দিয়েছেন নাগরিকরা ট্যাক্স দেবেন সহনীয় পর্যায়ের। মেয়র আনোয়ারুজ্জামানের বিশ^াসযোগ্য আশ^াসে ভেস্তে যায় আরিফুল হকের ফাঁদ।
কয়েকদিন না যেতেই নিজ দল আওয়ামী লীগের স্থানীয় শীর্ষ এক নেতা বিস্ফোরক বক্তব্য দেন। ১৪ মে মঙ্গলবার রাতে সিলেট জেলা পরিষদ মিলনায়তনে ওয়ান-ইলেভেনের সরকারের সময় সিলেটে আওয়ামী লীগের ৪০ নেতাকর্মীকে কারা নির্যাতনের ১৭ বছর উপলক্ষে আলোচনায় নাসির উদ্দিন খান বলেন, ‘অনেকে বিদেশে বসে মাল কামিয়েছেন। অনেক আন্দোলন করেছি। আজ মনে হয়, আমরা পরগাছা। সুবিধাভোগীরা অনেকে জনপ্রতিনিধি হয়ে গেছেন। এখন কেউ কেউ মনে করেন, তাঁর বাবার সম্পত্তি হয়ে গেছে সিলেট। আমরা টাকা খরচ করে অনেককে জনপ্রতিনিধি বানিয়েছি। সেটা ভুললে চলবে না। আমার পাওয়ার (ক্ষমতা) আছে, আমার অমুক আছে-তমুক আছে, সেটা থাকবে না। জনগণ যদি না থাকে, সংগঠন যদি না থাকে কারও অস্তিত্ব থাকবে না। রাজনীতিতে দুঃসময় এলে তারা থাকবে না, আমাদের দেশে থাকতে হবে। আমাদের দ্বৈত নাগরিকত্ব নেই। আমি বললাম, তারা চলে যাবে।’
নাসির উদ্দিন খানের ওই বক্তব্যে নিয়ে সিলেটের রাজনীতিতে তুমুল আলোচনা শুরু হয়। ওই আলোচনার মধ্যেই ‘কার দৌড় কতটুকু জানা আছে’ বলে হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন মেয়র আনোয়ারুজ্জামান। তিনি বলেছেন, নেতাকর্মীদের নির্যাতন করে নিজেদের নবাব ভাববেন না। কার দৌড় কতটুকু জানা আছে। আমরা এসব বিষয় নিয়ে বলতে চাই না। যদিও নিজের বক্তব্যে কারো নাম উল্লেখ করেননি সিলেট সিটি মেয়র।
এ সময় মেয়র আরও বলেন, কে কী বলল, তা দেখার বা শোনার সময় নেই। সবাই ঠান্ডা মাথায় মানুষের কল্যাণে কাজ করবেন। আপনারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক, শেষ হাসিনার একনিষ্ঠ কর্মী। তাই সকলে মানবতার কল্যাণে কাজ করবেন। আপনারা সকলে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য দোয়া করবেন। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এমদাদ রহমানের উদ্যোগে ১৮ মে দুপুরে আয়োজিত শোভাযাত্রা শেষে সংক্ষিপ্ত সভায় এসব কথা বলেন মেয়র আনোয়ারুজ্জামান।
নিজের বক্তব্যে মেয়র কারো নাম উল্লেখ না করলেও তার এই বক্তব্যের সাথে সম্প্রতি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন খানের দেওয়া একটি বক্তব্যের সম্পর্ক রয়েছে বলে মনে করছেন অনুষ্ঠানে উপস্থিত আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী।