মেঘনার উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুরের অন্যতম অর্থকরী ফসল সুপারি। এ জেলায় বছরে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা সুপারিতে লেনদেন হয়। তবে এবার বন্যা পরবর্তী সময়ে জেলায় সুপারির ফলন কম হয়েছে। অপরদিকে বন্যা পরবর্তী সময়ে বেশি দামে সুপারি বিক্রি করে বাগান মালিক ও গৃহস্থরা লাভবান হয়েচ্ছেন। ব্যবসায়ীদের মুখেও হাসি ফুটেছে। গতবারের ক্ষতি এ মৌসুমে কাটিয়ে ওঠার সুযোগ রয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এদিকে উৎপাদন কম হওয়ায় এবার প্রায় ৩০০ কোটি টাকা কম লেনদেন হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, এবার ৭ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে সুপারি আবাদ হয়েছে। এতে প্রায় ৪০ হাজার মেট্রিক টন সুপারি উৎপাদন হয়। যদিও এবার ফলন কম ছিল। অন্যদিকে ২০২২ ও ২০২৩ সালেও একই পরিমাণ জমিতে সুপারির আবাদ হয়। তবে বেচাকেনায় প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে বলে জানানো হয়। গেল মৌসুমে প্রায় ৩৫ হাজার মেট্রিক টন সুপারি উৎপাদন হয়েছে বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ। এছাড়া চলতি মৌসুমে উৎপাদন কম হলেও কৃষি বিভাগ তা দেখিয়েছে ৪০ হাজার মেট্রিক টন। তবে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছে গত বছরের ফলনের চেয়ে এবার অন্তত ৫ হাজার মেট্রিক টন সুপারির উৎপাদন কম হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, লক্ষ্মীপুরের মাটির গুণাগুণ ও আবহাওয়া সুপারি চাষের জন্য উপযোগী। এ জেলার প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই সুপারি গাছ রয়েছে। অনেকেই সুপারি বিক্রি করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। সুপারি ব্যবসার সঙ্গে জেলার বহু মানুষ জড়িত। দেশের বিভিন্ন জেলায় এখানকার সুপারির চাহিদা রয়েছে। গত বছর প্রতি পোন (৮০টি) সুপারি বিক্রি হয়েছে ১০০ থেকে ১২০ টাকা। চলতি বছর বিক্রি হচ্ছে ১৬০-২০০ টাকা দামে। একটু বড় আকারের সুপারির পোন ২২০ টাকা পর্যন্ত কিনেছেন ব্যবসায়ীরা। এবার প্রতি কাউন (১৬ পোন) সুপারি ২৭০০ থেকে ৩০০০ টাকা পর্যন্ত বেচাবিক্রি হচ্ছে।
সুপারির বাগান মালিকরা জানান, সুপারি গাছ অল্প পরিমাণ জমিতে বেড়ে ওঠে। রাস্তার পাশে, বাড়ির আঙ্গিনায়, ঝোপ-ঝাড়ে, ফসলি খেতের কাছে, পুকুর বা খাল পাড়সহ আনাচে-কানাচে লাগানো হয় গাছটি। জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুপারি বাগান রয়েছে রায়পুর উপজেলাতে। এছাড়া লক্ষ্মীপুরের দক্ষিণ অঞ্চলের তুলনায় উত্তর এবং পশ্চিম অঞ্চলে সুপারির আবাদ বেশি হচ্ছে। অধিকাংশ সুপারি বাগানই পরিকল্পিতভাবে সৃষ্টি নয়। এসব সুপারি গাছ পূর্ব পুরুষের লাগানো। বাড়ির আশপাশে ছড়িয়ে থাকা গাছ থেকেই সুপারির ফলন হয়। তবে কিছু সচেতন ব্যক্তি রয়েছেন, যারা বছরে একাধিকবার বাগানের আগাছা পরিষ্কার করেন। এছাড়া গাছের আশপাশে গোবর সার ব্যবহার করেন।
জানা গেছে, সুপারি লাভজনক ফসল হওয়ায় গ্রামের মানুষ এখন পতিত জমিতে সুপারির চারা বা বীজ রোপণ করে। এছাড়া মৌসুমে ভালো মানের সুপারিগুলো বীজ হিসেবে সংরক্ষণ করে। পরে তা মাটিতে পুঁতে রাখে। বর্ষা মৌসুমে খালি জমিতে বা বাড়ির আঙ্গিনায় চারা গাছ রোপণ করে। তেমন কোনো পরিচর্যা ছাড়াই প্রাকৃতিক পরিবেশে গাছ বড় হতে থাকে। ৫-৭ বছরের মধ্যেই গাছে ফল আসতে শুরু হয়। একবার ফল দেওয়া শুরু করলে প্রতিটি গাছ ২৫-৩০ বছর পর্যন্ত ফলন দিতে থাকে। তবে গাছের বয়স যত বেশি হবে, ফলনের পরিমাণ তত কমতে থাকবে। প্রাপ্ত বয়স্ক একটি গাছে মৌসুমে ৪-৫ পোন সুপারি ধরে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, অক্টোবর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত সুপারির মৌসুম। তবে অক্টোবরের শেষ থেকে নভেম্বর ও ডিসেম্বরের শেষ সময় পর্যন্ত সুপারি সবচেয়ে বেশি সংগ্রহ করা হয়। লক্ষ্মীপুরের রায়পুর, সদর, রামগঞ্জ, রামগতি ও কমলনগর উপজেলার প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় সুপারি বিক্রি করতে দেখা যায় বাগান মালিক ও গৃহস্থদের। আর সাপ্তাহিক হাটগুলো জমে ওঠে সুপারি ব্যবসায়ীসহ বাগান মালিক ও গৃহস্থদের উপস্থিতিতে। গ্রামের গৃহবধূদেরকেও সুপারি বিক্রি করতে হাটে দেখা যায়।
সুপারির বড় বাজারগুলোর মধ্যে রয়েছে রায়পুর উপজেলার হায়দরগঞ্জ, খাসেরহাট, মোল্লারহাট, মিতালীবাজার, আলিয়া মাদরাসা মাঠ, রাখালিয়া বাজার, সদর উপজেলার দালাল বাজার, উত্তর তেমুহনী, রসুলগঞ্জ, চন্দ্রগঞ্জ, মান্দারি, রামগঞ্জ উপজেলার মীরগঞ্জ, পানপাড়া, কাঞ্চনপুর, দল্টা, কমলনগর উপজেলার হাজিরহাট ও রামগতি উপজেলার আলেকজান্ডার। চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকাররা লক্ষ্মীপুরে এসে সুপারি কিনে নানা প্রান্তে নিয়ে যায়। সেখান থেকে আবার বিদেশও পাঠাচ্ছেন আড়তদাররা। সাধারণত সুপারি কাঁচা, ভেজা ও শুকিয়ে বিক্রি করা হয়। এছাড়া প্রায় প্রত্যেক গ্রামের আনাচে-কানাচে এবং রাস্তার মোড়ে খুচরা বেপারীরা গৃহস্থদের থেকে সুপারি ক্রয় করে বাজারগুলোতে এনে পাইকারি দামে বড় ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন।
সুপারি ব্যবসায়ী জয়নাল, এমরান ও হাবিব উল্লাহ জানান, মৌসুমে পানের সঙ্গে সবাই কাঁচা সুপারি খায়। এছাড়াও কাঁচা সুপারিগুলো তারা বিক্রি করেন বড় ব্যবসায়ীদের কাছে। আবার অনেক খুচরা ব্যবসায়ী সুপারিগুলো ভিজিয়ে সংরক্ষণ করেন। প্রায় তিন মাস পানিতে ভিজিয়ে রাখার পর তা উঠিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকার বড় ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করা হয়। এছাড়া জেলায় খুচরা ব্যবসায়ীরা শুকিয়ে সারা বছর সুপারি বিক্রি করে থাকেন।
ব্যবসায়ী আমানত উল্ল্যা বলেন, গত বছর সুপারি বেশি উৎপাদন হওয়ায় দাম কম ছিল। এবার সুপারির উৎপাদন কম হওয়ায় দাম বেশি। গৃহস্থরা গত বছর এক কাউন সুপারি বিক্রি করেছেন ১৮০০-১৯০০ টাকা। এবার একই সুপারি বিক্রি করেছেন প্রায় ২৭০০ থেকে ৩০০০ টাকা। তবে গত বছর বব্যবসায়ীরা তেমন লাভ করতে পারেননি। এবার ভালো লাভের সুযোগ রয়েছে বলে জানান তিনি।
সুপারি ব্যবসায়ী শেকান্তর মিয়া বলেন, গত বছর যদি ৩৫ হাজার মেট্টিক টন সুপারি উৎপাদন হয়। তবে এবার তার চেয়ে ৫ হাজার মেট্টিক টন কম উৎপাদন হয়েছে। এবার ৩৫ লাখ টাকার সুপারি কিনেছি। গতবার সুপারিতে লাভ করতে পারিনি।
এ বছর বন্যায় সুপারির আকার কিছুটা ছোট এবং ফলন হয়েছে কম। তবে গত বছরের চেয়ে দাম বেশী পাওয়ায় স্থানীয় বাগান মালিকরা কিছুটা স্বস্থি প্রকাশ করেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সোহেল মো. শামছুদ্দিন ফিরোজ বলেন, এবার ৭ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে সুপারির আবাদ হয়েছে। উৎপাদন হয়েছে ৪০ হাজার মেট্রিক টন সুপারি। যার বাজারমূল্য ৭০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
বন্যা পরিস্থিতির কারণে এবার সুপারির ফলন কম হলেও সুপারির দাম বেশি। তাই বাগানি বা গৃহস্থদের পোষাচ্ছে। একেক বাগান মালিক মৌসুমে ৪ থেকে ৫ লাখ টাকার সুপারি বিক্রি করতে পারেন। এটা বাগানিদের জন্য অর্থের বড় একটা সংস্থান। সুপারির ফলন বাড়াতে এবং বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত বাগান মালিকদের ভালোমানের চারা রোপণ এবং দূরত্ব বজায় রেখে চারা লাগানোর পরামর্শ দেন এই কর্মকর্তা।
বায়ান্ন/প্রতিনিধি/পিএইচ