পণ্য আমদানি-রপ্তানির অন্যতম করিডোর সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর। অন্তত ৭২ ধরনের পণ্য এ বন্দর দিয়ে নিয়মিত আমদানি হয়। সবচেয়ে বেশি আমদানি হয় ফল। আপেল, আনার, দু-ধরনের আঙুর ও টমেটো আসে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে। এছাড়া মাছের শুটকি, সিরামিক সামগ্রী, পাথর, চাল, কাঁচা মরিচ, জিরা, পেঁয়াজ, আদাও আমদানি করা হয়। ফলে রাজস্ব আহরণেও কয়েকবারের রেকর্ড রয়েছে স্থলবন্দরটির।
তবে ভোমরা স্থলবন্দরের সঙ্গে রাজধানী ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থার বেহাল দশা। দীর্ঘদিন যশোর থেকে সাতক্ষীরা শহর হয়ে ভোমরাগামী সড়কটি চলছে জোড়াতালি দিয়ে। বর্ষা মৌসুমে সড়কের অবস্থা হয় ভয়াবহ। আমদানি করা পণ্য ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছাতে ব্যবসায়ীদের চরম বিপাকে পড়তে হয়। অনেক সময় পথে ট্রাকেই নষ্ট হয় ফলসহ অন্যান্য পচনশীল পণ্য। এ সংকট নিরসনে ঢাকার সঙ্গে ভোমরা স্থলবন্দরকে ফোর লেনে যুক্ত করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ)।
ভোমরা-সাতক্ষীরা-নাভারণ-যশোর-ঝিনাইদহ-বনপাড়া-হাটিকুমরুল অ্যালাইনমেন্টটি ওয়েস্টার্ন ইকোনমিক করিডোরের গুরুত্বপূর্ণ রুট, যার দৈর্ঘ্য হবে ২৬০ কিলোমিটার। ওয়েস্টার্ন ইকোনমিক করিডোর অ্যান্ড রিজিওনাল এনহ্যান্সমেন্ট (উইকেয়ার) প্রোগ্রামের আওতায় এতে বিনিয়োগ করবে বিশ্বব্যাংক। পাশাপাশি এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকও (এআইআইবি) এই প্রকল্পে বিনিয়োগ করবে। কয়েকটি ফেজে ভাগ করে ভোমরা স্থলবন্দর চার লেনে প্রথমে সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুলে যুক্ত হবে। এরপরে হাটিকুমরুল থেকে চার লেনে ঢাকার সঙ্গে যুক্ত হবে ভোমরা।
প্রকল্প বাস্তবায়নে ইউকেয়ার ফেজ-১-এর আওতায় ‘কুষ্টিয়া (লালন শাহ্ সেতু)-ঝিনাইদহ মহাসড়কও উন্নয়ন করবে এআইআইবি। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর। প্রকল্পে মোট ব্যয় পাঁচ হাজার ৫১৩ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। প্রকল্পে এআইআইবি বিনিয়োগ করবে তিন হাজার ৪৯৩ কোটি ৭২ লাখ টাকা। বাকি দুই হাজার ২০ কোটি ২৫ লাখ টাকা সরকারি তহবিল থেকে বরাদ্দ দেওয়া হবে। ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৬ সালের ডিসেম্বর মেয়াদে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে বলে জানিয়েছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী আবদুস সবুর জাগো নিউজকে বলেন, ভোমরা থেকে হাটিকুমরুল খুবই গুরুত্বপূর্ণ করিডোর। একটি অংশ বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বাস্তবায়িত হবে। অন্য অংশটি বাস্তবায়নে এআইআইব-এর কাছে ঋণ চাওয়া হয়েছে। প্রকল্পে অর্থায়নে আগ্রহ প্রকাশ করেছে সংস্থাটি।
‘২৬০ কিলোমিটার চার লেন হয়ে গেলে ভোমরা স্থলবন্দর, হাটিকুমরুল হয়ে ঢাকার সঙ্গে সরাসরি চার লেনে সংযুক্ত হবে। পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এআইআইবির এ অর্থায়ন। চার লেনে ভোমরা স্থলবন্দর ঢাকার সঙ্গে যুক্ত হলে দ্রুত ঢাকায় পণ্য সরবরাহ করা সম্ভব হবে।’
সওজ সূত্র জানায়, প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য-কুষ্টিয়ার লালন শাহ সেতু-ঝিনাইদহ মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করা। এর মাধ্যমে এশিয়ান হাইওয়ে, সার্ক হাইওয়ে করিডোর, বিমসটেক (বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টিসেক্টোরাল, টেকনিকাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন) রোড করিডোর ও সাউথ এশিয়ান সাব- রিজিওনাল ইকোনমিক কো-অপারেশন (সাসেক) রোড করিডোরের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন। এ অংশের মোট দৈর্ঘ্য ৬৬ দশমিক ৮২ কিলোমিটার। ধীরগতি সম্পন্ন যানবাহনের জন্য আলাদা লেন এবং ব্যস্ততম স্থানে ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হবে।
করিডোরটিকে মোট চারটি অংশে বিভক্ত করা হয়েছে, যার মধ্যে ভোমরা-সাতক্ষীরা-নাভারণ ৫৮ কিলোমিটার, যশোর-ঝিনাইদহ ৪৮ দশমিক ৫০ কিলোমিটার ও ঝিনাইদহ-কুষ্টিয়া ৬৬ কিলোমিটার। এছাড়া কুষ্টিয়া-বনপাড়া-হাটিকুমরুল ৮৭ দশমিক ৫০ কিলোমিটার। চারটি অংশের মধ্যে ভোমরা-সাতক্ষীরা-নাভারণ ও যশোর-ঝিনাইদহ অংশের উন্নয়নে বিশ্বব্যাংক এবং ঝিনাইদহ থেকে কুষ্টিয়া ও কুষ্টিয়া-বনপাড়া-হাটিকুমরুল অংশে এআইআইবি ঋণ সহায়তা দেবে।
তবে প্রাথমিক পর্যায়ে গুরুত্ব বিবেচনায় ঝিনাইদহ-যশোর পর্যন্ত মোট ৪৮ দশমিক ৫০ কিলোমিটার সড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ ও উভয় পাশে ধীরগতির যানবাহন চলাচলের লেন নির্মাণে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন করছে। উইকেয়ার ফেজ-১: ঝিনাইদহ-যশোর মহাসড়ক উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পে চার হাজার ১৮৭ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের ঋণ দুই হাজার ৭০৫ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। জানুয়ারি ২০২১ থেকে ডিসেম্বর ২০২৩ মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন করা হয়েছে।
এরপর গুরুত্ব বিবেচনায় কুষ্টিয়া (লালন শাহ সেতু)-ঝিনাইদহ পর্যন্ত মোট ৬৬ দশমিক ৮২ কিলোমিটার সড়কের অংশ চার লেনে উন্নীত করা ও উভয়পাশে ধীরগতির যানবাহন চলাচলের লেন নির্মাণে প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হচ্ছে।
প্রকল্পে অর্থায়ন চেয়ে ইতোমধ্যেই এআইআইবি অফিস বরাবর চিঠি দিয়েছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে কো-ফিন্যান্সিং করবে সংস্থাটি। এআইআইবির বিষয়টি দেখভাল করেন ইআরডির উপ-সচিব (এশিয়া-১ অধিশাখা) কাওসার জাহান।
তিনি জাগো নিউজকে বলেন, প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য ইতোমধ্যে এআইআইবিকে অবগত করা হয়েছে। আশা করছি, এআইআইবি অর্থায়ন করবে। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে কো-ফিন্যান্সিং করবে সংস্থাটি।
ইআরডি সূত্র জানায়, এআইআইবির এই ঋণ বাংলাদেশকে তিন বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ (এ সময়ের মধ্যে ঋণের আসল বা সুদ পরিশোধ করতে হবে না) ২০ বছরে পরিশোধ করতে হবে। ঋণের জন্য ফ্রন্ট অ্যান্ড ফি হিসেবে দশমিক ২৫ শতাংশ ও অব্যয়িত অর্থের ওপর বার্ষিক শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ কমিটমেন্ট ফি পরিশোধ করতে হবে। এই ঋণের সুদের হার নির্ধারিত হবে লাইবরের (লন্ডন আন্তর্জাতিক ব্যাংক লেনদেনে সুদের হার) সঙ্গে রেফারেন্স রেট ও ভেরিয়েবল স্প্রেড হারের সমন্বয়ে।
২০১৬ সাল থেকে বাংলাদেশে এআইআইবি কার্যক্রম শুরু করে। এই স্বল্প সময়ে ১৩টি প্রকল্পের আওতায় এরই মধ্যে বাংলাদেশে আড়াই বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করেছে সংস্থাটি। নতুন করে বিনিয়োগ বাড়াতেও বাংলাদেশের সঙ্গে ঋণচুক্তি সই করেছে। আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে আরও তিন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে তারা।
ফলে বাংলাদেশে এআইআইবির মোট বিনিয়োগ দাঁড়াবে সাড়ে পাঁচ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। প্রতি ডলার সমান ৮৫ টাকা ধরে বাংলাদেশি মুদ্রায় এই বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়াবে ৪৬ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। মোট অর্থায়নের মধ্যে ভোমরা থেকে হাটিকুমরুল করিডোরকে গুরুত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশের অন্যতম বন্ধু হয়ে ওঠা সংস্থা এআইআইবি।