ঢাকা, বৃহস্পতিবার ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ঠা আশ্বিন ১৪৩১

টাঙ্গাইলের কালিহাতীর বীর মুক্তিযোদ্ধা দিলীপ কুমার , জীবনযুদ্ধে পরাজিত এক বীর

হাসান সিকদার, টাঙ্গাইল | প্রকাশের সময় : বৃহস্পতিবার ১৬ ডিসেম্বর ২০২১ ০৪:৫৯:০০ অপরাহ্ন | জাতীয়

 

“এতো সুর আর এতো গান, যদি কোন দিন থেমে যায় সেই দিন তুমিওতো ওগো ভুলে যাবে যে আমায়...।” “ডেকোনা আমারে তুমি কাছে ডেকো না, দূরে আছি সেই ভালো নিয়ে বেদনা..।” হাট-বাজার, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ডে মানুষকে এমন গানগুলো শুনিয়ে রোজগার করেন টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার বাংড়া ইউনিয়নের উত্তর বাগুটিয়া গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা দিলীপ কুমার দে। মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে জয়লাভ করলেও ঠিক তার গানের কথার মতো তার সুর যেন থেমে যাচ্ছে। চির অভাবের সংসারের বিভিন্ন প্রয়োজন মেটাতে নেয়া ঋণের কিস্তি পরিশোধের পর থাকে না তেমন কিছু। এই ৮২ বছর বয়সেও তাই মাঝে মাঝেই বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়েন আশে পাশের মানুষদের গান শুনিয়ে পাঁচ-দশ টাকা পাওয়ার আশায়। কেউ যদি দয়া করে অসুখের জন্য দুটো ট্যাবলেট কিনে দেয়। একসময় গান গেয়ে সংসার চালালেও বয়স ভারে নানা রোগশোকে এখন তা সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়াও সরকারের দেয়া বীর নিবাস ও মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পেলেও ঋণের কারনে চলছে না তার পরিবার। ফলে স্বাধীন দেশে জীবনযুদ্ধে প্রতিনিয়ত পরাজিত হচ্ছেন এই বীর।

বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তির সময়টাতে কেমন চলছে এ যোদ্ধার জীবন? তা জানতেই পা রাখি এ বীর মুক্তিযোদ্ধার বাড়িতে। আলাপচারিতায় তিনি বলেন, আমি ১৫ বছর বয়স থেকেই গান গাওয়া শুরু করি। লেখাপড়া তেমন করতে পারিনি। তখনকার সময়ে হঠাৎ পাকিস্তানিরা ঢাকায় অত্যাচার শুরু করে। ক্রমে তা গ্রামে ছড়াইয়া পড়লো। খামখেয়ালি করে মানুষের ঘর-বাড়িতে আগুন দিছে, মানুষ মাইরা ফালাইছে, অনেক অত্যাচার করছে। সেগুলো দেইখা আমার ভিতরে একটা রাগ হইলো। তারপর মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। হানাদার বাহিনীরে এই দেশ থেকে নিপাত করা না পর্যন্ত আমাদের আর কোন রক্ষা নাই। ওরা দেশ ধ্বংস করে দিবো। কিছু কিছু পোলাপানরে ওরা গুলি করে মারছে। তারপর যারে যেখানে পাইছে সেখানেই মারছে। মানুষের ঘরবাড়ি আগুন দিয়া পুইড়া ফালাইছে। গ্রামের মধ্য দিয়া হাইটা হাইটা যাইয়া ভারতের মেঘালয়ে গেছি। মানুষ ডরাইয়া তখন বাড়ি-ঘর ছাইড়া কেউ জঙ্গলে কেউ গর্ত কইরা পলাইয়া থাকছে। ওরা যে অত্যাচার করছে মানুষরে। অনেক সময় আমারও চোখে জল আইছে। কত নারীগো ধইরা নিয়া নির্যাতন করছে। তখন কিছু করতে পারি নাই। তখন তাড়াতাড়ি  যাইয়া ট্রেনিং নিয়া যুদ্ধে অংশ নেই। আমি ছিলাম কামালপুর ১১ নম্বর সেক্টরে। জামালপুর জেলার বকশিগঞ্জ থানায় যুদ্ধ করছি। সেক্টর কমান্ডার ছিলেন কর্ণেল আবু তাহের। সাব সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর আফছার আর আমাদের কমান্ড করতেন কর্নেল আবু তাহেরের ছোট ভাই ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল। 

এই বীর মুক্তিযোদ্ধা আরও বলেন, লক্ষ্য ছিল হানাদার বাহিনীকে ধ্বংস করতে হবে নইলে উপায় নাই। আমি মরি আমার রক্তে সবাই বাইচা যাক, সবাই শান্তিতে থাকুক, স্বাধীন দেশে বসবাস করুক। তখন কোন ভয়ও পাই নাই। এখনতো সবাই স্বাধীন দেশে শান্তিতে বসবাস করতেছে। বর্তমানে যারা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, নাতি-পুতি ওরা ভালোভাবে থাকবো, স্বাধীন দেশে বসবাস করবো। আমাদের সময়ের মতো এখন যাতে তাদের এ রকম বিপদ না আসে এই আর্শিবাদ করি। দেশের মানুষের জন্যও দোয়া করি তারা যেন আমাদের মতো এ রকম অত্যাচার ভোগ না করে। তারা যেন ভালোভাবে থাকতে পারে। কারন দেশ স্বাধীন করছি দেশের জন্য মায়া আছে। 

গান গাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিগত ১৯৬৫ সাল থেকে আমি গান গাই। এখন বয়স হয়ে গেছে। আগেতো ভাতা পাইনি। গান গেয়েই তখন সংসার চলছে। কাজেই আমার দিনাতিপাত খুব কষ্টে চলছে। আমার বোন বিয়ে দিয়েছি খুব কষ্টে। তারপর বিয়ে করলাম পরে সন্তান হলো, বড় হলো। দুইটা মেয়ে বিয়ে দিলাম। সন্তান লইয়া অনেক সময় অনাহারেও থাকছি। তখন কেউ কিচ্ছু কইরা দেয় নাই। এরশাদ সাহেব গেল, জিয়া সাহেব গেল, খালেদা জিয়া গেল কিন্তু ভাতা করলো না। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৩০০ টাকা করে ভাতা করলো। সেই থেকে ভাতা পাই আমি। এখন প্রতি মাসে সেই ভাতা হইছে ২০ হাজার টাকা। ভাতা থেকে থেকে ৩ লক্ষ টাকা ঋণ আনার পর দুই লক্ষ টাকা বাকি ছিল এবং পরে আরও ৩ লক্ষ টাকা ঋণ আনি। ঋণের কারনে সব কেটে নেওয়ার পর এখন পাই মাত্র ৯ হাজার ৫৯০ টাকা। ১০ হাজার ৪১০ টাকা কাইটা নেয়। তাতে আমার কষ্ট হয়। পরিবার চলে না। বয়স হইছে এখন। অসুস্থ থাকি প্রায়ই। গান গাইতে আগের মতো বাইরেও যাইতে পারি না। ফলে ওই টাকায় সংসার চলেনা। ঠিকমতো ভালো খাবার, ওষুধ, একটু ভালো পথ্যও খেতে পারি না। কষ্ট হয়। আগে গান গেয়েই চলছে। আগেতো কারো কাছ থেকেই কোন সহযোগিতা পাই নাই। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আইসা এই ভাতার ব্যবস্থা করলো। বর্তমানে আমার সংসারে দুই ছেলে, ছেলের বউ, নাতি-পুতি ৪ জন। স্ত্রী বিগত প্রায় দেড় বছর আগে মারা গেছে। আমার ছেলে একটা সেলুনে কাজ করে আরেকজন অন্যের সিএনজি ভাড়া নিয়ে চালায়। আমার একটা ছেলেরেও সরকারি চাকরি দিতে পারলাম না। আমার ভাগ্যে হইলো না। আমি কিছুই করতে পারলাম না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমার দুইডা ছেলেরে নূন্যতম সরকারি চাকরি দিতো তাইলে খুব ভালো হইতো। একটা পিয়ন পদেও যদি তারা সরকারি চাকরি পাইতো তাইলে আমি মইরাও শান্তি পাইতাম।