বিজয় দিবস ও সাপ্তাহিক ছুটি মিলিয়ে তিনদিনের জন্য কক্সবাজার বেড়াতে এসে ভ্রমণসূচি সংক্ষিপ্ত করে ফিরে গেছেন অনেক পর্যটক। আগে থেকে রুম বুকিং না দিয়ে পরিবার কিংবা গ্রুপ ধরে বেড়াতে এসে বাজেট সংকটে ফিরে যেতে বাধ্য হন তারা। এ ঘটনা স্থায়ী পর্যটনের জন্য ‘অশনিসংকেত’ বলে মন্তব্য করেছে সচেতন মহল।
চট্টগ্রাম মহানগরীর কালামিয়া বাজার এলাকার আবদুল মান্নান নিজেদের গাড়িতে পরিবার নিয়ে ১৬ ডিসেম্বর বিকেলে কক্সবাজার আসেন। পরিকল্পনা ছিল ১৬-১৭ ডিসেম্বর দু’রাত হোটেলে থেকে ১৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম রওয়ানা হবেন। কিন্তু পরিচিত হোটেলে গিয়েও রুম খালি পাননি। আগেই বুকিং নেওয়া একজনের চারটি রুম ১৬ হাজার টাকায় নিয়ে এক রাত থেকে ১৭ ডিসেম্বর রাতে চট্টগ্রাম ফিরে যান।
হোটেলের নামটি প্রকাশ না করার শর্তে আবদুল মান্নান বলেন, ‘হোটেলটিতে অন্য সময় এলে রুমপ্রতি এক হাজার টাকায় থাকতাম। যেহেতু চাহিদা বেশি তাই হিসাব করেছিলাম দুই হাজার টাকায় রুম নিয়ে দিনে আট হাজার টাকা করে দুইদিনে ১৬ হাজার টাকা আবাসন বাবদ খরচ করবো। কিন্তু দ্বিতীয় হাত বদল হয়ে রুম নিতে হওয়ায় এক রাতেই ১৬ হাজার টাকা গুনতে হয়েছে। ফলে বাজেটের কারণে সফর সংক্ষিপ্ত করে ফিরে এসেছি।’
তারই মতো ১০-১২ জন সঙ্গী নিয়ে বিজয় দিবসের দিন কক্সবাজার পৌঁছান সিলেটের গোলাপগঞ্জের আফজাল হায়দার। অন্য সময় তিন রুমের ফ্ল্যাট বাসায় দুই হাজার টাকায় থেকে গেলেও ওইদিন তিন রুমের একটি ফ্ল্যাটের ভাড়া গুনেছেন ২০ হাজার টাকা। তিনিও আগে বুকিং করা একজনের কাছ থেকে ভাড়া নেন। ফলে তারাও সফর সংক্ষিপ্ত করে শুক্রবার রাতেই সিলেটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন।
আফজাল হায়দার বলেন, ‘এক ফ্ল্যাটে সফরসঙ্গী সবাই একসঙ্গে থাকতে পারলেও এত বেশি ভাড়া দিতে হওয়ায় মনটা খারাপ ছিল। কিন্তু শুক্রবার বিকেলে প্রশাসনের সহযোগিতায় কিছু টাকা ফেরত পেয়েছি। এরপরও ভালো না লাগায় আমরা ফিরে এসেছি।’
শুধু তারা নন, এভাবে দুদিন বা তিনদিনের বাজেট একদিন বা দুদিনে খরচ হওয়ায় অনেক পর্যটক সফর সংক্ষিপ্ত করে কক্সবাজার ত্যাগ করেছেন। তাদের মতে, লোকসমাগম বেশি হওয়ায় হোটেলের কক্ষ ভাড়া যেমন অতিরিক্ত গুনতে হয়েছে তেমনি টমটম-সিএনজি-রিকশা ভাড়াও দিতে হয়েছে বেশি। সঙ্গে নারী থাকলে হাঁটা সম্ভব না হওয়ায় পরিবার নিয়ে আসা পর্যটকরা এ ভোগান্তিতে পড়েন। এর পাশাপাশি রেস্তোরাঁয় মাছ, মাংসের দাম অন্য সময়ের চেয়ে বাড়তি দিতে হয়েছে। তবে ডিম, সবজি, ডাল দিয়ে যারা খেয়েছেন তারা মোটামুটি আগের নিয়মে বিল দিতে পেরেছেন।
রাঙ্গামাটির হানিফ মোহাম্মদ বলেন, ‘বন্ধুদের নিয়ে বেড়াতে এসে খাবার খেতে গিয়ে চরম বিড়ম্বনায় পড়ি। সামুদ্রিক মাছ, গরু ও মুরগির মাংস বা অন্য মাছের দাম যা চাওয়া হচ্ছিল তা আমাদের মতো মধ্যবিত্ত পর্যটকদের খাবার অনুপযোগী। একাধিক রেস্তোরাঁর একই অবস্থা বিদ্যমান। কোথাও ডিম, সবজি বা ডাল বিক্রি করছিল না। গ্রাহক বেশি হওয়ায় রেস্তোরাঁগুলো কথা বলার সময়টুকুও পাচ্ছিল না। পরে ওশান প্যারাডাইসের পূর্ব পাশের গলিতে ‘স্বাধীন বাংলা’ নামের একটি রেস্তোরাঁয় ডিম, সবজি ও ডাল দিয়ে ভাত খেয়ে জনপ্রতি ৯০ টাকা বিল দিয়ে স্বস্তি পেয়েছি।’
‘অবশ্য ব্যাচেলর বন্ধুর বাসায় থাকার সুযোগ পাওয়ায় আমাদের রুম ভাড়ার ভোগান্তি পোহাতে হয়নি। তবে কোথাও ভালোমতো হাঁটাচলার সুযোগ না পেয়ে আমরাও একদিন পর শুক্রবার রাতে কক্সবাজার ত্যাগ করে চট্টগ্রাম চলে এসেছি। শনিবার বিকেলে রাঙ্গামাটি পৌঁছালাম’—যোগ করেন এ পর্যটক।
সংশ্লিষ্টদের মতে, এবারের বিজয় দিবসের চলমান ছুটিতে নানাভাবে ভোগান্তিতে হাজারো পর্যটক। অনেক পর্যটক হোটেলে ঠাঁই না পেয়ে বাস, সৈকতের কিটকট চেয়ারে (বিনোদন ছাতা), ফুটপাত এবং দোকানের বারান্দা বা সৈকতের খোলা আকাশের নিচে রাতযাপন করেন। যারা রুম পেয়েছেন তাদের অনেককে অতিরিক্ত টাকা গুনতে হয়েছে। পরিবারসহ ভ্রমণ করতে আসা লোকজন রুম না পেয়ে বাস-ফুটপাতে রাত কাটাতে গিয়ে শৌচাগার নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েন।
হোটেল সি নাইটের ব্যবস্থাপক শফিক ফরাজী বলেন, পর্যটকরা এখনও অপরিকল্পিত ভ্রমণে বের হন। ডিজিটালের এই যুগে সব হোটেল-গেস্ট হাউজের যোগাযোগ নম্বর ওয়েবসাইট বা ফেসবুক পেজে দেওয়া আছে। সেখানে যোগাযোগ করে সরাসরি বুকিং দিলে তারা ঠকতেন কম। এছাড়া সবাই শুধু বন্ধের দিনগুলোতে আসার জন্য মুখিয়ে থাকেন। ফলে চাপের কারণে থাকা-খাওয়া সবখানেই বাড়তি টাকা গুনতে বাধ্য হন। সাপ্তাহিক খোলার দিনগুলোতে বেড়াতে আসা বুদ্ধিমান পর্যটকের কাজ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
পর্যটকদের ভোগান্তি কমাতে কোন সময়ে কী পরিমাণ বিল নেওয়া যাবে সেটা বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির ঠিক করে দেওয়া দরকার বলে মনে করেন কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী।
তিনি বলেন, ‘পরিকল্পিত নগরায়নের পাশাপাশি সুষ্ঠু ম্যানেজমেন্টও জরুরি। এটা এবারের বিজয় দিবসের ছুটি স্পষ্ট করে দিয়েছে। একটা পর্যটন এলাকায় যে যার মতো ভাড়া, খাবারের বিল নিতে পারেন না। কোন সময়ে কী পরিমাণ বিল নেওয়া যাবে সেটা বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির ঠিক করে দেওয়া দরকার। এটি নিশ্চিত করা না গেলে হয়রানি ভোগান্তির ভয়ে কক্সবাজারবিমুখ হবেন পর্যটকরা।’
কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের পর্যটন সেলের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ মুরাদ ইসলাম বলেন, অভিযোগ পেয়ে সি-পার্ল ১ ও ২ নামে ফ্ল্যাট আবাসনে শুক্রবার অভিযান চালান ভ্রাম্যমাণ আদালত। এসময় অতিরিক্ত নেওয়া টাকা ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাশাপাশি এ ফ্ল্যাট পরিচালকদের পাঁচ হাজার টাকা এবং অপর আবাসন প্রতিষ্ঠান হোটেল ওপেলাকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
জানতে চাইলে কক্সবাজার বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ বলেন, ‘বিজয় দিবস ও সাপ্তাহিক ছুটিতে আসা পর্যটকদের নিয়ে কিছু আবাসন ও রেস্তোরাঁয় অনৈতিক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। সামনের দিনে এসব বিষয় যেন আর পুনরাবৃত্তি না হয় সেজন্য করণীয় নির্ধারণ করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
কেউ প্রতারণার শিকার হয়েছেন বুঝলেই সৈকত এলাকার জেলা প্রশাসনের তথ্য সেলে যোগাযোগ করার অনুরোধ জানান ডিসি।