বগুড়ায় পুলিশ-বিএনপির সংঘর্ষের সময় পুলিশের ছোড়া টিয়ারশেলের ধোঁয়া ও বিএনপির ছোড়া ককটেলের শব্দে ইয়াকুবিয়া স্কুলের প্রায় অর্ধশতর বেশি শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এদের মধ্যে ৫৪ জন শিক্ষার্থীকে বগুড়ার ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। এছাড়া শহরের অন্যান্য ক্লিনিক ও বাড়িতে নিয়েও তাদের চিকিৎসা দেয়া হয়। মঙ্গলবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বগুড়া শহরের ইয়াকুবিয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের মোড়ে সংঘর্ষের ঘটনায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
সরেজমিনে দেখা যায়, দুপুরে বগুড়া জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আলী আজগর হেনার নেতৃত্বে একটি বিশাল পদযাত্রর মিছিল শহরের দিকে প্রবেশ করার উদ্দেশ্যে ইয়াকুবিয়া স্কুল মোড়ে পৌছিলে পুলিশ বাধা প্রদান করেন। এসময় পুলিশ ও বিএনপি নেতা কর্মীদের মধ্যে তর্ক বিতর্কের এক পর্যায়ে বহরটির পেছন থেকে ইটপাটকেল, লাঠি ও ককটেল ছুড়লে বিকট শব্দ শুরু হয়। এসসময় পুলিশ বহরটিকে ছত্র ভঙ্গ করতে টিয়ারসেল নিক্ষেপ করে। এতে করে এই এলাকায় ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে পুরো এলাকা ছড়িয়ে পড়লে ইয়াকুবিয়া স্কুলের রাস্তার ধারের শ্রেণিকক্ষের শিক্ষার্থীরা অসুস্থ থাকে। বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাদের প্রথমে মালেকা ক্লিনিকে নিলে সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসক মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে নিয়ে যেতে পরামর্শ দেন সে অনুযায়ী মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে নিয়ে তাদের চিকিৎসা দেয়ার কাজ শুরু হয়।
মোহাম্মদ আলী হাসপাতালের নার্সিং সুপার ফিরোজা বেগম বলেন আহত শিক্ষার্থীদের বার্ন ইউনিটের আইসিইউ রুমে নিয়ে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। তিনি আরোও বলেন শিক্ষার্থীদের কারও চোখে জ্বালা পোড়া বেশি। কারও শ্বাসকষ্ট বেশি হচ্ছে। আমরা অবস্থা দেখে চিকিৎসা দিচ্ছি। এখন অনেকে চিকিৎসা নিয়ে চলে গেছে।
আইসিইউ বেডে শুয়ে থাকা নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী স্নেহা আক্তার বলে, দুপুরে ক্লাশ করছিলাম। হঠাৎ অনেক জোরে জোরে শব্দ হতে থাকে। এরপর ক্লাশের ভিতর ধোঁয়ায় ভরে যায়। তখন চোখ জ্বালা করছিল, নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছিল। পরে ম্যাডাম এসে আমাদের হাসপাতালে নিয়ে আসেন।
৭ম শ্রেণির আফিয়ার মা খাদিজা বেগম জানান, বিদ্যালয় থেকে খবর পেয়ে হাসপাতালে আসেন। মেয়ে টিয়ারশেলের ধোঁয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাকে স্যালাইন দিয়ে রেখেছেন চিকিৎসকরা।
ইয়াকুবিয়া স্কুলের সিনিয়র শিক্ষক বদরুন্নাহার বলেন, একটার দিকে থেকে মেয়েরা অসুস্থ হতে থাকে। প্রথমে আমি কয়েকটি মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালে চলে আসি। পরে আরও কয়েকজন শিক্ষক, আয়া তারাও মেয়েদের নিয়ে আসে হাসপাতালে।
স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক ফেরদৌস কবির বলেন, প্রথমে আমরা শিক্ষার্থীদের ক্লাশরুমের বাইরে নিয়ে আসি। পরে অবস্থা বেশি খারাপ মনে হলে তাদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। আমাদের অন্তত এক দেড়শ শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়। অনেকে প্রাথমিক চিকিৎসায় সুস্থ হয়। অনেকের বাবা-মা বেসরকারি ক্লিনিকে নিয়ে গেছেন। হাসপাতাল গিয়ে দেখা যায়, বিকেল সাড়ে তিনটার পর্যন্ত ৩২ জন শিক্ষার্থী চিকিৎসা নিয়ে চলে গেছে।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ শাহাদৎ হোসেন বলেন দুপুরে হঠাৎ বিকট শব্দ শুরু হলে রাস্তার পাশের ক্লাশ রুমগুলোর শিক্ষার্থীরা জানালা খুলে দেখতে গেলে বাহিরের ধোঁয়া ভেতরে প্রবেশ করে। এতে করে শিক্ষার্থীরা অসুস্থ হতে থাকলে তাদেরকে দ্রুত বগুড়া মোহাম্মাদ আলী হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দেয়া হয়। এদের প্রায় সবাই সুস্থ্য হয়ে বাড়ি ফিরে গেছে।
বিদ্যালয়ের সভাপতি রফি নেওয়াজ খান রবিন বলেন শিক্ষার্থীদের অসুস্থ্যতার কথা শুনে আমি দ্রুত হাসপাতালে ছুটে যাই। সেখানে গিয়ে দেখতে পাই শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। আমি একজন অভিভাবক হিসেবে এমন ঘটনার তীর্ব নিন্দা জানাই। কারন একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাছে বিএনপির এমন কাজে লিপ্ত হওয়া মোটেও কাম্য নয়। আমি প্রশাসনের কর্মকর্তাদের দৃষ্টি আকর্ষন করে বলতে চাই। আগামীতে যেনো এমন ঘটনা আর না ঘটে সেজন্য আপনাদেরকে সজাগ থাকতে হবে।
মোহাম্মদ আলী হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক মো. শফিক আমিন কাজল জানান, স্কুলের পাশের রাস্তায় টিয়ারশেল নিক্ষেপের কারণে শিক্ষার্থীরা ধোঁয়ায় বমি করে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অনেকের সাময়িকভাবে শ্বাসকষ্ট হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, শিক্ষার্থীদের অনেকে ধোঁয়ার কারণে ভয় পেয়ে বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তবে এটা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঠিক হয়ে যাবে। আর হাসপাতালে অনেক লোকজন ভিড় করছেন, এতেও তারা নার্ভাস থাকছে।
খবর পেয়ে অসুস্থ শিক্ষার্থীদের দেখতে হাসপাতালে যান জেলা বিএনপি সভাপতি রেজাউল করিম বাদশাসহ অন্য নেতা-কর্মীরা। পরবর্তীতে সদর আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রাগেবুল আহসান রিপু পরিদর্শন করেন। এ সময় আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা-কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
এদিন বেলা সাড়ে ১২ টার দিকে এক দফা দাবিতে বিএনপির পদযাত্রা মিছিলটি ইয়াকুবিয়া মোড়ে এসে সোজা রাস্তা দিয়ে সাতমাথায় প্রবেশ করতে যায়। ওই সময় মিছিলটিকে সাতমাথা হয়ে দলীয় কার্যালয়ে যাওয়ার জন্য বাধা দেয় পুলিশ। এই বাধাকে কেন্দ্র করে বিএনপির নেতা-কর্মীরা উত্তেজিত হয়ে পড়েন। মিছিলের পিছন থেকে লাঠি সোটা, ইট ছুড়তে থাকেন তারা। এ সময় ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনাও ঘটে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ লাঠিচার্জ শুরু করে। এক পর্যায়ে সংঘর্ষ তীব্র হলে টিয়ারশেল পরবর্তীতে রাবার বুলেট ছুড়ে পুলিশ। সংঘর্ষে পুলিশের ১০ সদস্য আহত হন।