ঢাকা, শুক্রবার ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১

ভাড়া বেড়েছে ছয়গুণ পর্যন্ত, তবু মিলছে না কনটেইনার

নিজস্ব প্রতিবেদক : | প্রকাশের সময় : বুধবার ২৪ নভেম্বর ২০২১ ১১:২৩:০০ পূর্বাহ্ন | জাতীয়

বাংলাদেশ থেকে সড়ক, নৌ ও আকাশপথে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি হচ্ছে বিদেশে। সড়কে যাওয়া পণ্যগুলোর গন্তব্য কম দূরত্বের দেশগুলো। প্লেন বা উড়োজাহাজে বেশি যাচ্ছে পচনশীল পণ্য। কিন্তু রপ্তানির সবচেয়ে বড় কারবার হচ্ছে জাহাজের মাধ্যমে। বিশ্বের প্রায় ১৪০টি দেশে পণ্য যাচ্ছে নৌপথে। বর্তমানে এ তিন পথেরই বড় সমস্যা বাড়তি ভাড়া। পাশাপাশি অন্য সমস্যাও আছে।

শেষ দফায় দুবাইয়ে বিস্কুট ও স্ন্যাকস রপ্তানি করেছে বনফুল অ্যান্ড কিষোয়ান গ্রুপ। ৪০ ফুটের একেকটি কনটেইনারে গেছে প্রায় ১০ টন করে পণ্য। এজন্য কনটেইনারপ্রতি ভাড়া গুনতে হয়েছে তিন হাজার ২০০ ডলার, যা করোনা হানা দেওয়ার আগেও ছিল এক হাজার থেকে এক হাজার ১০০ ডলারের মধ্যে।

 বিশ্বব্যাপী জাহাজে পণ্য পরিবহনের ভাড়া বেড়েছে। কিন্তু আমাদের শিপিং লাইনগুলো চীন-হংকংভিত্তিক হওয়ায় ভাড়া বেশি বেড়েছে। এ দেশে অন্যান্য শিপিং লাইন থাকলে সেবার মানও বাড়তো। পণ্য প্রক্রিয়াজাতকারীরা সুবিধা পেতেন 

গ্রুপটির সিনিয়র এক্সপোর্ট ম্যানেজার ওমর ফারুক বলছিলেন, কনটেইনার ভাড়া বৃদ্ধির কারণে পণ্যের দাম কেজিপ্রতি ২৫ টাকার মতো বেড়েছে। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে রপ্তানি বন্ধ করে দিতে হবে। অন্য প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে টেকা যাবে না।

করোনার সংক্রমণ কিছুটা কমে আসার পর থেকেই বৈশ্বিক পণ্য পরিবহন ব্যবস্থায় জট লেগে গেছে। এর প্রভাবে বিশ্বব্যাপী জাহাজে পণ্য পরিবহনের ভাড়া আকাশ ছুঁয়েছে। বিশ্বের আটটি প্রধান রুটে ৪০ ফুটের একটি কনটেইনার পরিবহনের খরচ এক বছরের ব্যবধানে ৩৬০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। বাংলাদেশ থেকে পণ্য পরিবহনে সেটা বেড়েছে তারও দ্বিগুণ।

জাহাজে ভাড়া বৃদ্ধির চিত্র উঠে এসেছে বাংলাদেশ অ্যাগ্রো প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশনেরও (বাপা) তথ্যে। তাদের তথ্য বলছে, ৪০ ফুটের একটি কনটেইনারে যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত বর্তমানে ভাড়া গুনতে হচ্ছে ১৪ থেকে ১৭ হাজার ডলার, যা করোনার আগে (২০১৯ সাল) সাড়ে তিন থেকে চার হাজার ডলার ছিল।

সংগঠনটির তথ্য আরও বলছে, অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত ১২শ থেকে ১৫শ ডলারের কনটেইনার ভাড়া এখন সাড়ে ৬ থেকে ৭ হাজার ২০০ ডলার। কাছাকাছি দূরত্বে সৌদি আরব পর্যন্ত ১২০০ থেকে ১৫০০ ডলারের কনটেইনার এখন ৭ থেকে ৯ হাজার ডলার পর্যন্ত উঠেছে।

খালি কনটেইনার পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে রপ্তানিতে দেরি হচ্ছে। এতে খরচও বেড়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি পণ্য যথাসময়ে পাঠানো যাচ্ছে না। কারও কারও ক্রয়াদেশ বাতিলও হচ্ছে 

২০২০ সালের শুরুর দিকে বিশ্বে করোনা মহামারি দেখা দিলে প্রায় ১৮ মাস ব্যবসায় বড় ধাক্কা লাগে। সেই অবস্থা কাটিয়ে ওঠার পর ভাড়ার এমন পরিস্থিতিতে পণ্যের সরবরাহ কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর চাপ এখনো কমেনি। শিগগির যে পরিস্থিতির উত্তরণ হবে এমন সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। এ সময় রপ্তানিখাতে সরকারের কার্যকর উদ্যোগ প্রয়োজন।

কয়েকজন রপ্তানিকারকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশে জাহাজে পণ্য পরিবহন ব্যবসা আছে চীন ও হংকংভিত্তিক কোম্পানিগুলোর। বর্তমানে চীনের সাংহাইয়ের বন্দরের একটি টার্মিনাল বন্ধ। ফলে চীন থেকে উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপে পণ্য পরিবহনের খরচ কয়েক মাস ধরে শুধু বাড়ছে। পাশাপাশি করোনা-পরবর্তী সময়ে চীন তাদের নিজস্ব পণ্যের চাপ অনেক বাড়িয়েছে। এসব কারণে বাংলাদেশে কনটেইনার সেবা ঠিকঠাক দিতে পারছে না কোম্পানিগুলো। সংকটের কারণে ভাড়াও বেড়েছে অনেক বেশি।

রপ্তানিকারকরা বলছেন, পার্শ্বর্তী ভারতের নিজস্ব জাহাজ রয়েছে। তারা নিজেদের পণ্য পরিবহন প্রাধান্য দিচ্ছে। এজন্য সে দেশে ভাড়া বৃদ্ধির হারও কম।

অন্যদিকে বাংলাদেশে গভীর সমুদ্রবন্দর না থাকায় ছোট জাহাজে ট্রান্সশিপমেন্টে খরচ বেশি হচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দর সর্বাধুনিক না হওয়ায় এখানে কার্যক্রম চালাতে আগ্রহ কম দেখাচ্ছে বিদেশি শিপিং কোম্পানিগুলো।

এ বিষয়ে বাপার সাধারণ সম্পাদক মো. ইকতাদুল হক বলেন, বিশ্বব্যাপী জাহাজে পণ্য পরিবহনের ভাড়া বেড়েছে। কিন্তু আমাদের শিপিং লাইনগুলো চীন-হংকংভিত্তিক হওয়ায় ভাড়া বেশি বেড়েছে। এ দেশে অন্যান্য শিপিং লাইন থাকলে সেবার মানও বাড়তো। পণ্য প্রক্রিয়াজাতকারীরা সুবিধা পেতেন।

তিনি বলেন, এখন পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে বেশি টাকা দিলেও মাঝে মধ্যে জাহাজ ভাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। ঠিকঠাক মতো পণ্য পরিবহন করতে বেশিরভাগ সময় বাধ্য হয়ে ভাড়া বেশি গুনতে হচ্ছে। কনটেইনার সংকট তীব্র আকার ধারণ করছে।

 

চট্টগ্রাম বন্দর সর্বাধুনিক না হওয়ায় এখানে কার্যক্রম চালাতে আগ্রহ কম বিদেশি শিপিং কোম্পানিগুলোর

বাপা জানায়, কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে দেশের পাঁচ শতাধিক প্রতিষ্ঠান। রপ্তানি করছে ২০০টির বেশি প্রতিষ্ঠান। তার মধ্যে বড় ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান আছে ২০টি। কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য রপ্তানিতে বর্তমানে ২০ শতাংশ নগদ সহায়তা দিচ্ছে সরকার।

আশির দশকে শুরু হওয়া রপ্তানি কার্যক্রম বর্তমানে ১৪৫টি দেশে পৌঁছে গেছে। ফ্রুট ড্রিংক, পানীয়, বিস্কুট, সস, নুডলস, জেলি, মসলা, সরিষার তেল, আচার, সুগন্ধি চাল, পটেটো ক্র্যাকার্স, চানাচুর, ঝাল-মুড়ি ইত্যাদি পণ্য রপ্তানি হচ্ছে বেশি। এসব পণ্যের ৯৫ শতাংশ জাহাজে রপ্তানি হয়।

ভুগছে প্রধান রপ্তানি পণ্যও

কনটেইনার সমস্যায় সবচেয়ে বেশি ভুগছে দেশের প্রধান রপ্তানিখাত পোশাকশিল্প। করোনা পরিস্থিতির কারণে রপ্তানিখাতে সৃষ্ট সমস্যা দ্রুত সমাধানের দাবি জানিয়ে পোশাক কারখানার মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও চট্টগ্রাম বন্দরে। এছাড়া এ বিষয়ে অর্থ, বাণিজ্য ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়েও তারা চিঠি দিয়েছে।

দ্রুত সমাধান চেয়ে চিঠিতে বলা হয়, দেশের রপ্তানি পণ্যের প্রায় ৯০ শতাংশ ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলোয় যাচ্ছে। সেসব দেশ করোনার নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলা করে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে এনেছে। ব্যবসা-বাণিজ্য পুরোদমে শুরু হয়েছে। এ সময় কনটেইনার সংকট ও অস্বাভাবিক ভাড়া বৃদ্ধির পরিস্থিতি তৈরি হলে দেশের পোশাকশিল্প বড় ধরনের সংকটে পড়বে। এ ধরনের সংকট এড়াতে এখনই জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানাই।

রপ্তানির সবচেয়ে বড় কারবার হয় জাহাজের মাধ্যমে, বিশ্বের প্রায় ১৪০টি দেশে পণ্য যাচ্ছে নৌপথে

এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, খালি কনটেইনার পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে রপ্তানিতে দেরি হচ্ছে। এতে খরচও বেড়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি পণ্য যথাসময়ে পাঠানো যাচ্ছে না। কারও কারও ক্রয়াদেশ বাতিলও হচ্ছে।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক বলেন, বাড়তি জাহাজ ভাড়ার কারণে সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু এ ভাড়া বিদেশি শিপিং এজেন্ট, তাদের দেশি প্রতিনিধি এবং এজেন্সিগুলোর ওপর নির্ভর করে। সরকার বা বন্দর কর্তৃপক্ষ চাইলেও সহজে এটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।

তিনি বলেন, কনটেইনার ও জাহাজ জট নিয়ে যে পরিস্থিতি বা সংকট তৈরি হয়েছে, এটি চট্টগ্রাম বন্দরের কোনো সংকট নয়। এটি ট্রান্সশিপমেন্ট পোর্টগুলোর সংকট। বন্দরের কোনো সমস্যার কারণে দেশের আমদানি-রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে না।