জাহানারা কাঞ্চন, ঢালিউডের চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের স্ত্রী। সাদামাটা জীবনের এই নারী ১৯৯৩ সালের ২২ অক্টোবর চট্টগ্রামের পটিয়ায় এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। তার মৃত্যু দেশে নিরাপদ সড়কের আন্দোলনের পটভূমি তৈরি করে, যার পরিক্রমায় ইলিয়াস কাঞ্চন গড়ে তোলেন ‘নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)’। সংগঠনটি নিরাপদ সড়কের দাবি বা আন্দোলনকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে।
জানা যায়, জাহানারা কাঞ্চন ১৯৬৪ সালের ৩ মার্চ পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা আবদুল হাফিজ ও মা নুরবানুর ৫ ছেলে ও ৭ মেয়ের মধ্যে অষ্টম ছিলেন তিনি। ঢাকা সেন্ট্রাল গার্লস স্কুল থেকে ১৯৮০ সালে এসএসসি পাস করে কলেজে ভর্তি হন। তার আগেই ১৯৭৯ সালে ইলিয়াস কাঞ্চনের সঙ্গে বিয়ে হয় তার। দুই বছর নিজেদের জানাশোনার পর পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় তাদের।
বলা হয়ে থাকে, ইলিয়াস কাঞ্চনের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের অন্তরালে শক্তিশালী ভূমিকা ছিল জাহানারা কাঞ্চনের। ১৯৮৮ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় ইলিয়াস কাঞ্চন গুরুতর আহত হলে তার পা কেটে ফেলতে বলেছিলেন চিকিৎসক। জাহানারা কাঞ্চনের বাধার মুখে পরে সিঙ্গাপুরে পাঠানো হয় নায়ককে। দীর্ঘ তিন মাস চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে দেশে ফিরে আবারও অভিনয়ে যুক্ত হন কাঞ্চন।
ওই দুর্ঘটনা কাঞ্চন দম্পতির মনে দাগ কাটলেও ১৯৯৩ সালের ২২ অক্টোবর আরেক সড়ক দুর্ঘটনা সবকিছুকে ওলটপালট করে দেয়। স্বামীকে চমকে দিতে তার শুটিং স্পট বান্দরবানে যাওয়ার পথে চট্টগ্রামের পটিয়ায় এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন জাহানারা কাঞ্চন। তার এভাবে অসময়ে চলে যাওয়া মেনে নিতে পারেননি ইলিয়াস কাঞ্চন। ফলে যে দুর্ঘটনা স্ত্রীকে কেড়ে নিলো, সেটিকে কেন্দ্র করে নিরাপদ সড়কে আন্দোলনে নেমে পড়েন তিনি।
জাহানারা কাঞ্চনের সন্তান ইশরাত জাহান ইমা ও মিরাজুল মইন জয়কে পরম যত্নে মানুষ করার পাশাপাশি ‘তৃতীয় সন্তান’ হিসেবে আন্দোলনটিকে বেছে নেন ইলিয়াস কাঞ্চন। ১৯৯৩ সালের ১ ডিসেম্বর বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা (বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন-এফডিসি) থেকে জাতীয় প্রেস ক্লাব পর্যন্ত ‘নিরাপদ সড়ক চাই' নামে একটি পদযাত্রা করেন তিনি। প্রথম সেই পদযাত্রা থেকে এটিকে সাংগঠনিক রূপ দেওয়ার পরামর্শ দেন বিশিষ্টজনেরা। পথযাত্রা শেষে ২২ দফা সুনির্দিষ্ট দাবি উত্থাপন করেন ইলিয়াস কাঞ্চন।
পরবর্তীকালে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) নিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছুঁটে যান ইলিয়াস কাঞ্চন, আয়োজন করতে থাকলেন পথযাত্রার। সেগুলো থেকে ২২ দফা দাবিতে নিরাপদ সড়কের আন্দোলন প্রসার লাভ করে, তৈরি হতে থাকে জনমত। এটি ইলিয়াস কাঞ্চনকে সামাজিক আন্দোলনের তারকা খ্যাতি এনে দিয়েছে আজ।
কেবল একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা নয়, দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে এর পেছনে মেধা ও মনন দিয়ে এখন নব অধ্যায়ের সূচনা করেছেন ইলিয়াস কাঞ্চন। এটি সামাজিক আন্দোলনের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। নিসচার পক্ষ থেকে প্রতিবছর ২২ অক্টোবর আন্তর্জাতিকভাবে নিরাপদ সড়ক দিবস পালনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ সংক্রান্ত প্রস্তাব উত্থাপন করা হলে ২০০৪ সালের ৭ এপ্রিল একটি সভার আয়োজন করে জাতিসংঘ। সড়ক দুর্ঘটনা ৫০ শতাংশে নামিয়ে আনতে ২০১০-২০ সালকে ‘সড়ক নিরাপত্তা দশক’ ঘোষণা করে সংস্থাটি। এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ায় ২০৩০ পর্যন্ত বাড়ানো হয় সময়সীমা।
এদিকে, নিসচার উদ্যোগে এসএসসি পাস করা বেকার যুবকদের দক্ষ চালক হিসেবে গড়ে তুলতে ‘নিসচা ড্রাইভিং ট্রেনিং ইনস্টিটিউট’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এখান থেকে বিনামূল্যে ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়ে থাকে বলে জানিয়েছেন উদ্যোক্তরা। অপরদিকে, সড়ক দুর্ঘটনা কমানোর লক্ষ্যে ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’ প্রণয়ন করে সরকার। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করে ১ নভেম্বর ২০১৯ থেকে আইনটি কার্যকর হয়। ২০১৭ সালে ২২ অক্টোবরকে ‘জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস’ ঘোষণা করে সরকার।
নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) এর প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, সড়কের ভয়ের থাবা থেকে জাহানারা কাঞ্চনকে বাঁচাতে না পারলেও লাখো প্রাণ রক্ষায় কাজ করছেন তিনি। ফলে এতদিনের ব্রত, সংগ্রাম ও প্রচেষ্টা নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সফল হয়েছে। কিন্তু এখনও সড়কে প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিল, মানুষের আহাজারি তাকে ব্যথিত করে। এ থেকে উত্তরণে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে, সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।