‘সুশিক্ষিত মা। ধার্মিকও। শৃংখলায় আপসহীন। বাজপাখির ন্যায় সার্বক্ষণিক নজর রাখতেন। এখনো রাখেন। স্কুল কলেজ জবানায় সন্ধ্যার পর প্রথমে আরবি পড়তে হতো। সামনে অবস্থান করে আরবি পড়া তদারকি করতেন মা। পড়ে স্কুল কলেজের পাঠ্য বই নিয়ে বসতে হতো। মা চলে যেতেন রান্নাঘরে। যাওয়ার সময় বলে যেতেন আওয়াজ করে পড়তে। মায়ের আদেশে উচ্চস্বরে পড়তে হতো। কোনো ধরণের ব্যতিক্রম করা যেত না। এতে আমাদের ভাই বোনের জন্যে ভালো হতো। কেউ ভুল পড়লে রান্নাঘর থেকে ভুল ধরতেন মা। তাৎক্ষণিক ভুল সংশোধণ করে নেয়া সম্ভব হতো।’
সিলেট নগরীর চৌকিদেখীর রংধনু আবাসিক এলাকার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মোমাজ্জাদ আহমদ আল রাজী দৈনিক বায়ান্নর কাছে মমতাময়ী সম্পর্কে ওইভাবে তার বক্তব্য তুলে ধরেন।
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের ইন্ডাসট্রিয়াল এন্ড প্রেডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থ রাজী মায়ের স্নেহ, ভালোবাসা, কঠোর শাসনের মধ্য দিয়ে জীবনের প্রতিটি ধাপে ইর্ষণীয় ফলাফল অর্জন করতে সক্ষম হচ্ছেন। বাবা সিলেটের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আবদুল কাদির সেজন। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করেছেন ১৯৮৯ সালে। শিক্ষা জীবন শেষে ব্যবসায় নিয়োজিত হন তিনি। মমতাময়ী মা হাদি সফা বিনতে উম্মুল খয়ের এমএসএস করেছেন সিলেট এমসি কলেজ থেকে।
রাজী জানান, তাদের গ্রামের বাড়ি সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার আজিজ পুর গ্রামে। কিন্তু পুরো পরিবার বসবাস করেন সিলেট নগরীর বাসায়। তারা দুই ভাই সিলেট পাইলট স্কুল থেকে এসএসসি ও দুই বোন সিলেট অগ্রগামী স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেছেন। সর্বকনিষ্ঠ ভাই কোরআন এ হাফেজ। সব বড় ভাই খুবায়ের আহমদ আল জামি সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করেছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয় থেকে। পরবর্তীতে উচ্চ শিক্ষার্থে তিনি যুক্তরাজ্যে গেছেন। সেখানে তিনি এমএস অধ্যায়নরত। মেজো তিনি নিজে (মোমাজ্জাদ আহমদ আল রাজী)। ছোট বোন সুরাইয়া জাহান সোহা পিএসএস বিষয় নিয়ে অধ্যায়ন করছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ে। ছোট বোন নাঈমা জাহান নুমা পড়ছেন এমবিবিএস। সর্বকনিষ্ঠ ভাই ফারিক আবদুল কাদির কোরআন এ হাফেজ হয়েছেন।
রাজী জানান, শিক্ষা জীবনে গৃহ শিক্ষক ছিল না। বাসায় লেখাপড়ার বিষয় মা তদারকি করতেন। মায়ের তদারকি প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে রাজি বলেন, মা ঘুম থেকে জেগে উঠতেন সাতসকালে। এখনো উঠেন। ফজর নামাজ পড়তেন। পরে ডেকে তুলতেন সবাইকে। যাদের বয়স নামাজ পড়ার উপযোগি ছিল তাদের সবাইকে নামাজ পড়তে বাধ্য করা হতো। এখনত সবাইকে নামাজ পড়তে হয়। নামাজ না পড়লে কঠোর শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়। আমাদের পরিবারের সকল সদস্যের জন্যে নামাজ বাধ্যতামূলক। নামাজ শেষে পড়ার টেবিলে বসতে হতো। প্রথমে আরবি পড়তে হতো। আরবি শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করতেন মা। আরবি পড়ানোর সময় নামাজ পড়া শেখাতেন মা। আরবি পড়া শেষে পাঠ্য বই নিয়ে বসতে হতো। স্কুল কলেজে যাওয়ার সময় প্রস্তুত করে দিতেন মা। স্কুলের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার সময় মা দাঁড়াতেন দরজার সময়। সকলের কপালে চুমো দিতেন, ফু দিতেন বুকে। আজো ওই রীতি চালু রয়েছে। স্কুল কলেজ থেকে ফেরার সময় অপেক্ষায় থাকতেন মা। কেউ দেড়ি করে ঘরে ফিরলে কারণ দর্শাতে হতো। উপযুক্ত কারণ দেখাতে না পারলে মায়ের গলা থেকে কড়া ধমক শুনতে হতো।
মায়ের শাসন সম্পর্কে বলতে গিয়ে রাজি বলেন, আমাদেরকে শাসন করার জন্যে মা-বাবা উভয়ে বিশেষ কায়দা অবলম্বন করতেন। ঘরে সব সময় একটি বেত রক্ষিত থাকত। ওই বেত দেখিয়ে আমাদেরকে ভয় দেখানো হতো। কিন্তু কোনোদিন বেত ব্যবহার করেননি মা। মাঝে মধ্যে ওই বেত লুকিয়ে ফেলতাম আমরা। একদিনের মাথায় বাবা নতুন বেত কিনে আনতেন। এভাবে বেতের চর্চা হতো। কিন্তু বেতের আঘাত কেমন-তা আমরা ভাই বোনেরা জানিনা আজো।
দিনের রুটিন সম্পর্কে রাজি বলেন, বিকেলে বাসায় ফিরে খাবার ও বিশ্রাম শেষে খেলার মাঠে যেতাম। খেলার মাঠে কতক্ষণ থাকা যাবে-তাতেও নিয়ম ছিল। সন্ধ্যার আগে অর্থাৎ মাগরিবের আজানের আগে ঘরে প্রবেশ করতে হতো। নামাজ, সান্ধ্যকালীন নাস্তা শেষে পড়ার টেবিলে যেতে হতো। মায়ের কাছে প্রথমে আরবি শিক্ষা শেষ করতাম। পরে স্কুল কলেজের পড়া। রাত ১১ টার মধ্যে লেখা পড়া শেষে খাবার টেবিলে। খাবার শেষে নিজ নিজ কক্ষে ঘুমাতে যেতাম ভাই বোনেরা। এখানেও মায়ের তদারকি। সকলের ঘুম নিশ্চিত করার পর গভীর রাতে বিশ্রামে যেতেন মা। কিন্তু সাতসকালে মসজিদের মোয়াজ্জিনের আজানের ধ্বনি ভেসে আসার আগে জেগে উঠতেন মা। আমরা ভাই-বোনের উপর কড়া নজর রাখার পাশাপাশি পুরো পরিবারকে সামাল দিতেন মা।
রাজী জানান, এক সময় তাদের পরিবারটি ছিল যৌথ। সদস্য সংখ্যা ছিল অনেক। পরিবারের সকল সদস্যের লেখাপড়া থেকে শুরু করে খাওয়া দাওয়াসহ সকল বিষয়ের নজর রাখতেন। যতœ সহকারে পুরো পরিবার সামাল দিতেন। পরিবারের কোনো সদস্যই মাকে ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করতেন না। আমরা ভাই বোনেরা বিশ^বিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজে অধ্যায়ন করছি। কিন্তু মায়ের সামনে গেলে ছোট শিশুর মতো হয়ে যাই।
রাজী বলেন, শিশু তার কথাগুলো মায়ের কাছে না বলতে পারলে অশান্তিতে থাকে। একই অবস্ধা আমাদের। এই যেমন আমি অনেক দূরে অবস্থান করছি মায়ের কাছ থেকে। যে বিষয় নিয়ে অধ্যায়ন করছি, তাতে অবসর হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু যখনই একটু সময় পাই, তখন মাকে খুব মিস করি। কারণ বিশ^বিদ্যালয় ক্যাপাসে চলার পথে অনেক মজার মজার ঘটনা ঘটে। যা অন্য কারো সাথে শেয়ার করা যায় না। একমাত্র মায়ের সাথে ওইসব বিষয় শেয়ার করা যায়। কারণ মায়ের চেয়ে বড় বন্ধু নেই। শিশু বয়স থেকে মায়ের কাছে সব বিষয় শেয়ার করে আসছি। মা আমাদেরকে ওই পরিবেশ শিখিয়েছেন। মায়ের সাথে গল্প করা যায় সংকোচ ছাড়াই। ক্যাম্পাস জীবনের কারণে ওই গল্প করা থেকে বঞ্চিত হতে হয়। প্রায় সময় মোবাইল ফোনে কথা হয়। কিন্তু তাতে তৃপ্তি মেটে না। মায়ের হাতের রান্না খাবারের স্বাদ পৃথীবির সকল খাবারের চেয়ে সেরা। এই খাবার থেকে বঞ্চিত হতে হয়। মায়ের ভালোবাসা থেকে দিনের পর দিন বঞ্চিত থাকতে হয়। কাছে থাকলে মা হাত বুলিয়ে দেন মাথায়। মুখ দেখে বুঝার চেষ্টা করেন অভাব, অভিযোগ। কিন্তু অন্যায় আবদারকে কখনই সমর্থন করতেন না মা। আর আমরা ভাইবোনেরা কখনও অন্যায় আবদার করিনি। লেখা পড়ার প্রয়োজনে সব ধরণের সমর্থন পেয়েছি আমরা ভাই বোনেরা। বাসার ভেতর ভাই বোনের চঞ্চলতা অতিরিক্ত হলে মা কঠোর হুশিয়ারি দিতেন। ভয় দেখাতেন বাবার। বাবার ভয় দেখানোর পর সবাই চুপ হয়ে যেতাম।
শিশুবেলার স্মৃতিচারণ করে রাজী বলেন, তখন তিনি প্রথম শ্রেণিতে পড়েন। সাতটার সময় ক্লাস শুরু হয়ে যেত। কিন্তু ঘুম ভাঙতে অনেকদিন সাতটা বেজে যেত। ওই অবস্থায় দাঁত ব্রাস করতে করতে স্কুলে রওয়ানা হতাম। সাথে যেতেন মা। গাড়িতে বসে স্কুল ড্রেস পড়তাম। একদিনত তারাহুরো করতে গিয়ে স্কুলের ব্যাগ ফেলে যাই। ক্লাসে গিয়ে দেখি স্কুল ব্যাগ নেই।
রাজী জানান, আমরা ভাই বোনের মধ্যে বিশেষ একটি বিষয় রয়েছে। নামাজ শেষে মোনাজাত করার পূর্ব মূহুর্তে আমাদের কেউ না কেউ মায়ের গলা জড়িয়ে ধরি। আমাদের জন্যে দোয়া করতে বলি। আবেগঘন এই পরিবেশে অনেকদিন মায়ের চোখে পানি দেখেছি। মায়ের দোয়া কবুল হচ্ছে-এমনটা সন্দেহ ছাড়াই বলছি। তাইত মায়ের দোয়া আর মহান সৃষ্টিকর্তার দয়ায় আমরা ভাই বোনেরা এগিয়ে যাচ্ছি উজ্জল স্বাক্ষর রেখে।