সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার সাত ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন শেষ হয়ে গেলেও আওয়ামী লীগের দুর্গে নৌকার বিপর্যয় নিয়ে চলছে চুলচেড়া বিশ্লেষণ। আগামী নির্বাচনগুলোতে নৌকার এমন বিপর্যয়ের প্রভাব পড়ার শঙ্কায় শঙ্কিত দলের ত্যাগী পরীক্ষিত কর্মীরা।
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, জগন্নাথপুর উপজেলার সাত ইউনিয়নের মধ্যে মাত্র তিন ইউনিয়নে জয় পায় আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা। বাকি চার ইউনিয়নের মধ্যে কলকলিয়া ইউনিয়নে দলের কোন বিদ্রোহী প্রার্থী না থাকলেও নৌকা পরাজিত হয়েছে। অপর ইউনিয়নগুলোর মধ্যে চিলাউড়া হলদিপুর, পাইলগাঁও, আশারকান্দি ইউনিয়নে ব্যাপক ব্যবধানে নৌকার প্রার্থীরা পরাজিত হয়েছেন।
দলের তৃণমূলের ত্যাগী নেতাকর্মীরা ফলাফল বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে দলের অভ্যন্তরিণ কোন্দল, প্রার্থী মনোনয়নে ভুল সিদ্ধান্ত ও সাংগঠনিক দুর্বলতাকে চিহ্নিত করেছেন। তাদের অভিমত এসব দূর করা না গেলে আগামী উপজেলা পরিষদ ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এর প্রভাব পড়তে পারে।
কলকলিয়া ইউনিয়নের নেতাকর্মীরা জানান, আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত কলকলিয়া ইউনিয়নে দলের কোন বিদ্রোহী প্রার্থী ছিল না। বর্তমান সরকারের শাসনামলে ব্যাপক উন্নয়ন হয় এ ইউনিয়নে। তারপরও পর পর দুটি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে দলীয় অভ্যন্তরিণ কোন্দলে নৌকা পরাজিত হয়েছে।
কলকলিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা সাবেক ছাত্র লীগ নেতা এস এম জুয়েল বলেন, দলের কিছু দায়িত্বশীল নেতা দলীয় প্রার্থীর বিরোধিতা করেছেন। এছাড়াও নির্বাচনের সময় একটি মহল নৌকার প্রার্থী আলাল হোসেনের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে বিভ্রান্তি চালায়। জুয়েলসহ দলের নেতাকর্মীদের দাবি দলীয় মীরজাফরদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা না নিলে আগামী উপজেলা নির্বাচনেও নৌকার বিপর্যয় হতে পারে।
চিলাউড়া হলদিপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের দুর্গ হিসেবে পরিচিত। এ ইউনিয়নে জন্ম নিয়েছেন স্বাধীন বাংলার প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য প্রয়াত জাতীয় নেতা আব্দুল সামাদ আজাদ। বর্তমানে তাঁর ছেলে আজিজুস সামাদ ডন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এ ইউনিয়ন নৌকার ঘাঁটি হলেও ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে নৌকা তৃতীয় স্থানে রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচিত হচ্ছে কেন্দ্রীয় নেতা আজিজুস সামাদ ডনের গ্রাম ভূরাখালিতে নৌকায় ৭৫ ভোট প্রাপ্তির বিপর্যয়ের খবর।
চিলাউড়া হলদিপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা আবু তালেব বলেন, আমাদের ইউনিয়নটি আওয়ামী লীগের দুর্গ হিসেবে পরিচিত। দলীয় অভ্যন্তরিণ গ্রুপিংয়ের কারণে এ ইউনিয়নে নৌকার বিপর্যয় হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, এ ইউনিয়নে প্রার্থী মনোনয়ন সঠিক হয়নি। এছাড়াও ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে আওয়ামী লীগ দুই ধারায় বিভক্ত। এক পক্ষে বর্তমান সংসদ সদস্য পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান ও অপর ধারায় আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় নেতা আজিজুস সামাদ ডন। আজিজুস সামাদ ডন ২০১৪ সালে নৌকার বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেন। সেই থেকে দলীয় কোন্দল ভোটে প্রভাব পড়ছে।
পাইলগাঁও ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর ফলাফল বিপর্যয় ঘটেছে। আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংক হিসেবে পরিচিত স্বাধীন বাজারে এলাকায় নৌকা কম ভোট পায়। আবার হেফাজতের ভোট ব্যাংক হিসেবে পরিচিত কাতিয়া এলাকায় আঞ্চলিকতায় নৌকা বিজয়ী হয়। এখানে নৌকা ১৫৭৫ ভোট পেয়ে তৃতীয় হয়।
পাইলগাঁও ইউনিয়নের বাসিন্দা যুবলীগ নেতা রাসেল আহমদ বলেন, ইউনিয়ন নির্বাচন নিয়ে দলীয় নেতাকর্মীরা বিভক্ত হয়ে পড়েন বিভিন্ন প্রার্থীর পক্ষে ফলে দলীয় শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে। ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে দলীয় প্রতীক না হলেই ভালো হতো। আশারকান্দি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুস ছত্তার নৌকা প্রতীকে ভরাডুবি হয়। এখানে দলের সাধারণ সম্পাদক বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে জয় পেয়েছেন। এ ইউনিয়নে গত নির্বাচনেও নৌকা বিজয়ী হয়।
আশারকান্দি ইউনিয়নের বাসিন্দা যুবলীগ নেতা মুহিবুর রহমান রাসেল বলেন, দলের দায়িত্বশীল নেতাকর্মীদের মধ্যে অনেকেই ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে নৌকার বিরোধিতা করেছেন। তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হওয়ায় দলীয় প্রার্থী পরাজিত হয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে জগন্নাথপুর উপজেলা যুবলীগের সহ সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, ইউনিয়ন, পৌরসভা, উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে নৌকার বিরোধিতা করে দলের একটি গ্রুপ নৌকার বিরুদ্ধে ভোট দেওয়া অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও দলের ওই সব নেতাকর্মীদের ভোট দিতে হাত কাঁপবে না। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা দরকার। তিনি বলেন, শুধুমাত্র দলীয় ঐক্য না থাকায় গত উপজেলা পরিষদ নির্বাচন ও পৌরসভা নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীকে পরাজিত হতে হয়।
কলকলিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আলাল হোসেন অভিযোগ করে বলেন, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক সহ দায়িত্বশীল অনেক নেতা নৌকার বিরোধিতা করেছেন। যে কারণে নৌকা পরাজিত হয়েছে। তিনি এ পরাজয়কে নিজের পরাজয় না ভেবে দলের পরাজয় হিসেবে দেখছেন। আলাল অভিযোগ করেন ইউনিয়ন নির্বাচনে নৌকার মনোনয়ন প্রত্যাশী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি ফখরুল হোসেন, সাবেক সভাপতি কুতুবউদ্দিন, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক সুহিন আহমেদ দুদু, উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি হাবিবুর রহমানের কেন্দ্রে নৌকা পরাজিত হয়েছে।
এপ্রসঙ্গে কলকলিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ফখরুল হোসেন বলেন, আমি সর্বোচ্চ আন্তরিকতার সহিত নৌকার পক্ষে কাজ করেছি। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ ভিত্তিহীন। জগন্নাথপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আকমল হোসেন বলেন, ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে যারা বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন তাদেরকে বহিস্কার করা হয়েছে। দলীয় শৃঙ্খলা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয় দলীয় সভায় আলোচনা করা হবে।